সাফল্য, মানুষের জীবনে খুব আকাঙ্খিত এক জিনিসের নাম। ছোটবেলায় বড়রা শিখিয়ে দিচ্ছেন লেখাপড়ায় সফল হবার মন্ত্র। বড় হবার সাথে সাথে তার সাথে এসে জুটে আরো গোটাকয়েক সাফল্যের তাড়না। কর্মজীবন, সম্পর্ক, শখের কাজ, আরো কতকিছু; সাফল্যের চাহিদা মানুষের সর্বত্রই। কিন্তু, এই জিনিস তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয় যে কেউ একজন চাইলেই তা পেতে পারে।
আপনার চিন্তাজগতে সাফল্যের নিত্য আনাগোনা। সে আনাগোনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে আপনার কর্মকাণ্ডেও সফল হবার সূত্র থাকা চাই। একটু কষ্ট না করলে কি আর কেষ্টরূপী সাফল্য পাবেন? এলোমেলো বেহিসেবী জীবনটা সুখের হতে পারে ঠিকই, কিন্তু সাফল্যের শেখরে পৌঁছাতে গেলে নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিতে হয়। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে নিজেকে জড়াতে না পারলে তা আপনাকে সাফল্যের স্বপ্ন থেকে আরো কিছুটা দূরে নিয়ে আসবে। দ্য ওরাকলসের সদস্য, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তারা এসব নিয়ে নিজেদের ভাবনা জানিয়েছেন। বাতলে দিয়েছেন আত্মশৃঙ্খলা তৈরির উপায়। দেখে নিন এই অভ্যাসগুলো আছে কিনা আপনার মধ্যে। কিংবা নিজের মধ্যে তৈরি করে নিতে পারবেন কিনা এগুলো।
অবিচল থাকা জরুরি
লক্ষ্যে অবিচলই রইলেন না, লক্ষ্যভেদ হবে কী করে? বিজয়ী হতে চাইলে আত্মশৃঙ্খলা এক আবশ্যিক জিনিস। এটা মেনে চলা জরুরী। বেশিরভাগ মানুষই কেবল সফল হতে চায়, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় ছাড় দিতে তারা নারাজ। আপনার অনেকগুলো বাজে অভ্যাস থাকতে পারে। আপনি হতে পারেন খুব খরুচে, অদরকারি ও বাজে খরচ করা আপনার সব সময়ের অভ্যাস। হতে পারেন উড়নচণ্ডী, কিংবা বেজায় অলস। কিংবা সময়ের প্রতি উদাসীন। যে মুহূর্ত থেকে জীবনে সফল হবার আকাঙ্খা রাখছেন, এসব অভ্যাসের মায়া কাটানোটাও শুরু করুন তখনই।
কর্মজীবনে দারুণ সফল হয়ে জীবনটা উন্নতির চূড়ায় নেবেন বলে ভাবছেন অথচ নিজের বাজে অভ্যাসগুলোই ছাড়তে পারছেন না, তবে কিন্তু আপনাকে দিয়ে কিচ্ছুটি হবে না! ছাড় তো দিতে জানতে হবে। তা হোক কাজের ক্ষেত্রে বা নিজের স্বভাব শোধরানোর বেলায়। এ কথাগুলো ভেইনার মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও গ্যারি ভেইনারচাকের। গ্যারি আরো বলেন, যখন কেউ শুরু থেকেই ধৈর্যবান হবে, গ্যারির মতো, সবকিছুই অনেকখানি সহজ হয়ে যায়।
অন্যরা যা করে না তা করার অভ্যাস থাকতে হবে
সকলেরই নিজের মতো কিছু না কিছু শৃঙ্খলা রয়েছে। ভাবুন দেখি, যদি কোনো উপকারেই না আসছে তবে এমন শৃঙ্খলা তৈরি করার কী মানে? শৃঙ্খলা হওয়া চাই এমন, যা আপনাকে উদ্বুদ্ধ করবে। কোনো গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে যেটি আপনার জীবনে ভালো প্রভাব বয়ে আনবে। আরেকটা কথা হচ্ছে, শৃঙ্খলাবদ্ধ হবার কোনো সহজ পন্থা নেই। সেসমস্ত কাজ করুন যা কিনা অন্যরা করছে না। যাতে আপনি সেই জীবন পেতে পারেন যা অন্যরা পাবে না! সফল হবার তাড়না থাকতে হবে আপনার মধ্যে। কথাগুলো গ্রান্ট কার্ডনের, একজন শীর্ষ বিক্রয় বিশেষজ্ঞ যিনি ৫০০ মিলিয়ন ডলারের রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই ভাবনাচিন্তার
ডগলাস এলিম্যানের ব্রোকারেজের প্রেসিডেন্ট এবং টেলস প্রোপার্টিজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার হার্নান্দেজের মতে, শৃঙ্খলাবোধ তৈরি হচ্ছে আপনার মনেই। তাই নিজের ভাবনাগুলোর রাশ রাখা চাই নিজের হাতে। মনে কী চলছে, তা নিয়ে সজাগ থাকা উচিত। নেতিবাচক চিন্তাগুলোর প্রতিটিকে ধরে সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তায় পাল্টে দিতে থাকুন যতক্ষণ না ইতিবাচক চিন্তারা প্রকট হচ্ছে আপনার ভেতর। শৃঙ্খলা এমন এক জিনিস, যা আপনাকে মুক্তি দিতে পারে সেই সবকিছু থেকে যেসব আপনি চান না। ব্যর্থ হওয়ার ভয় থেকে, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে, অপরিপক্ব মানসিকতা আর মানসিক আলস্য থেকেও। নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করাটাই বড় শৃঙ্খলা।
আয়ত্তাধীন হোক যা কিছু সেরা
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, “আমরা তা-ই যা আমরা বারংবার করি। কাজেই শ্রেষ্ঠত্ব কোনো কাজ নয় বরং এটি একটি অভ্যাস।” শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করতে সাধারণ অভ্যাসগুলোই উন্নত করতে হবে। এখন করা সাধারণ জিনিসগুলোই সময়ের সাথে অসামান্য হয়ে ওঠে। শুরুটা করতে পারেন এভাবে, প্রতিদিন সকালে নিজের লক্ষ্যগুলো লিখে রাখুন কাগজে। বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিন-চারটিকে চিহ্নিত করুন এবং সেগুলো কার্যকর করতে মনস্থির করুন। নিজের ভেতর তাড়া থাকতে হবে দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার। এটি কাজের অগ্রগতি ঘটাবে। ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কাটুন, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু বরাদ্দ করুন। যা কিছু পরিকল্পিতভাবে করে করা হবে, তা সম্পন্ন হবেই।পরামর্শগুলো ক্রিমচেকের সিইও টম শিয়েহর।
নিজের উদ্দেশ্যকে ভালোবাসা জরুরি
যে কাজ করতে চাইছেন, তাকে যদি ভালোবাসতেই না পারেন তো কোন সাফল্যের আশা করে আছেন! সিলিকন ভ্যালি স্টার্টআপ মার্কেটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্বেতা প্যাটেলের মতে, যখন আপনার কাজ আপনার মিশন বা উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে তখন আপনি সাফল্য পেতে প্রয়োজনীয় ছাড়গুলো দিতে পারবেন। শ্বেতা যখন ব্যবসা শুরু করার কথা ভেবেছেন, এমন মানুষদের সাথে সময় কাটানো বাদ দিয়েছিলেন যারা তার উদ্দেশ্য পূরণের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। অর্থাৎ ছাড় তো আপনাকে দিতেই হবে যেকোনো দিকে। ভালোবাসার সাথে যদি আত্মশৃঙ্খলার মেলবন্ধন ঘটে তবে আপনি সবসময় এগিয়ে চলবেন, যখন কোনো প্রেরণা থাকবে না তখনও।
দৃষ্টি থাকুক নিজের স্বপ্নের উপর
ক্যাপসকানাডার নির্বাহী পরিচালক এবং ক্যাপসুলাইনের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা জোনাথন গিলিন্সস্কির মতে, অনুসরণ করুন আপনার স্বপ্নকে। এটি আপনাকে সাহায্য করবে প্রলোভনকে পাশ কাটাতে এবং আপনার জন্য অধিক অর্থবাহী জিনিসগুলোর প্রতি মনোযোগী হতে। কোনো নেশা খুঁজে নিন নিজের, এমন একটি আসক্তি যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে এগিয়ে যেতে। এটিকে সঙ্গী করে চলতে থাকুন নিজের লক্ষ্যভেদ করার পথে। যদি আপনি পুরোপুরিভাবে নিজের লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগী দৃষ্টি না রাখেন তবে প্রলোভনের ফাঁদে পড়াটা বেশ সহজ।
উদ্দেশ্য হওয়া চাই স্পষ্ট
কী চাচ্ছেন, এবং কেন সেটা চাচ্ছেন, এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। কোনো সফল কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য দরকারি আত্মশৃঙ্খলার চর্চা করতে এই ধারণাটুকু থাকা বেশ জরুরি। এমপাওয়ার্ড মেডিসিন টিভির প্রতিষ্ঠাতা লেনি গেইলসবির প্রতিদিন নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করেন, “এক, আমি কী চাই? দুই, আমি এটা কেন চাই? তিন, এটা পাওয়ার জন্য আজকে আমি কোন পরিবর্তনটা করতে পারি?”
নিজের পরিকল্পনা মানতে হবে
পরামর্শ গ্রহণ করা মন্দ কিছু নয়, কিন্তু নিজের পরিকল্পনা মাফিক চলার সাহস নিয়েই সাফল্যের সিঁড়ি বাইতে হবে আপনাকে। টম ফেরি ইন্টারন্যাশনালের সিইও টম ফেরির মতে, স্বল্প সময়ে খুব বেশি কিছু অর্জনের চেষ্টা করা উচিত নয়। সময়ের ছোট ছোট ভাগে সঠিক কাজগুলো করাই বড় কিছু নির্মাণের আসল কথা। আর ব্যবসায় যেকোনো কিছুই আপনার চাওয়ার চেয়ে বেশি সময় নেয়। নিজের উদ্দেশ্য স্থির করা হলে তারপর নিত্যদিনের করণীয়গুলো ঠিক করে নিন। এগুলোই আপনাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। হতাশ করার মতো বহু জিনিস সবসময়ই চারপাশে থাকতে পারে। তার জন্য নিজের রোজকার শৃঙ্খলাগুলো কখনো পাল্টাতে যাবেন না। আপনি অবশ্যই নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার মত যথেষ্ট উপযুক্ত।
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা চাই নিজের দিনপঞ্জিকার কাছে
দ্য রিভেরা গ্রুপের সিইও ও বক্তা ইয়েলেন রিভেরা বলেন যে, নিজের দিনপঞ্জিকার কর্তৃত্ব মেনে নিন। এতে নিজের জীবনের উপর আপনার কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। আপনার দিনপঞ্জি যেন আপনার লক্ষ্য ও স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি হয়। সময় নির্ধারণ করতে গেলে নিজেকে তিনটি জিনিসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেন- এক, নিজের ব্যবসার ভিত্তি মজবুত করতে প্রতিদিন ঠিক কী কাজ আপনার করা উচিত? দুই, সামনে এগিয়ে যেতে আপনার ঠিক কী করা উচিত? তিন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে নিজের আকাঙ্খিত জীবন পেতে আপনার কী শিক্ষালাভ দরকার, এবং কাদের সাথে দেখা করা প্রয়োজন? ব্যবসায় যারা আপনার সহচর, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করুন এবং সদ্ভাব রাখুন। আর নিজেকে চাঙ্গা রাখতে অবশ্যই ছুটি নিন কাজ থেকে। ছুটির সে সময়টা উপভোগ করুন, এ ছুটিটা আপনার উদ্যোগের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
কষ্ট কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না, এটা বাস্তব সত্য কথা। এখন আপনিই ভেবে দেখুন, কোন জিনিসগুলো মানতে পারবেন আপনার সাফল্যের গল্প লিখতে হলে।
Featured Image: tndman.ru