সমুদ্রের ধারে অবস্থিত ছয়তলা একটি বাড়ি। এই বাড়ির সামনে প্রতিদিন হাজারো মানুষের সমাগম হয় শুধুমাত্র বলিউড খ্যাত কিং খান খ্যাত শাহরুখ খানকে এক নজর দেখার আশায়। মিডিয়া জগতের মানুষদের ঘিরে সকলের মনেই যেন কৌতূহলের শেষ নেই। তাদের ব্যক্তিগত জীবন তথা জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, তারা কোথায় থাকে- এসব নিয়ে যেন আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। আর তিনি যদি হন বলিউডের বাদশাহ শাহরুখ খান, তাহলে একবার ভাবুন তো আমাদের কৌতূহলের মাত্রাটা ঠিক কতটা হতে পারে! চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক কিং খানের আবাসস্থল সম্পর্কেই।
প্রায় ২৫ বছর ধরে বলিউডে কাজ করে যাচ্ছেন শাহরুখ খান। তার অসামান্য অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন আপামর জনসাধারণের হৃদয়। মানুষও তাকে ভালবেসে বলিউডের বাদশাহর মুকুটটি পরিয়ে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, শাহরুখ খানকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী অভিনেতা।
কিং খান সপরিবারে বসবাস করেন মুম্বাইয়ের বান্দ্রা শহরের পশ্চিমদিকে ব্যান্ডস্ট্যান্ড নামক জায়গায়। মুম্বাইয়ের অন্যতম একটি বিলাসবহুল বাড়িতে তার বসবাস। আরব সাগরের কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিলাসবহুল ও রাজকীয় ছয়তলা একটি বিল্ডিং, যার নাম মান্নাত। হ্যাঁ, এই মান্নাতই হচ্ছে বলিউড বাদশাহের সেই রাজকীয় আবাস্থল। এছাড়াও দুবাইয়ে তার আরেকটি বাড়ি রয়েছে।
এই বাড়িটি অবশ্য কিং খানের নিজ তত্ত্বাবধানে বানানো নয়, তিনি ২০০১ সালে বাড়িটিকে কিনে নিয়েছিলেন। তিনি বাড়িটি নারিমান দুবাস নামক একজন গুজরাটি ব্যক্তির কাছ থেকে কিনেছিলেন, যিনি কিনা একসময় শাহরুখ খানের প্রতিবেশী ছিলেন। তবে এই বাড়িটি কেনার জন্য তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। বহু চেষ্টা ও অনুরোধের পর অবশেষে নারিমান দুবাস রাজি হয়েছিলেন বাড়িটি বিক্রি করতে। পুরো জায়গার পরিমাণ প্রায় ২৬,৩২৮.৫২ বর্গ ফুট। কিং খান সেই সময় বাড়িটি কিনেছিলেন ১৩.৩২ কোটি রুপির বিনিময়ে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি রুপি। কেনার সময় বাড়িটির নাম ছিল ভিলা ভিয়েনা, পরবর্তীতে কিং খান নাম পরিবর্তন করে রাখেন মান্নাত।
প্রচলিত আছে যে, কিং খান সবসময় চাইতেন তিনি এমন একটি বাড়ি নির্মাণ করবেন যেখানে থাকবে একটি স্বতন্ত্র প্রার্থনার ঘর, আর এই কারণেই তিনি এই বাড়িটি কিনেছিলেন।
মূল্যমানের দিক দিয়ে ভারতে এই বাড়িটির অবস্থান তৃতীয় এবং সমগ্র বিশ্বের শীর্ষ ১০ বাড়ির তালিকায় রয়েছে মান্নাতের নাম। জেনে অবাক হবেন যে, ভারতের কিংবদন্তী নায়ক অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি প্রতীক্ষার চেয়েও এর বাজারদর অনেকটা বেশি।
এই বাড়িটির নাম মান্নাত রাখার পেছনে রয়েছে একটি ছোট্ট গল্প। অনেকদিন যাবতই কিং খানের ইচ্ছে ছিল এই বাড়িটি কেনার, কিন্তু সবমিলিয়ে ঠিক হয়ে উঠছিল না। যখন তিনি বাড়িটি কেনার জন্য পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত, মনে মনে নতুন বাড়ির জন্য একটা নামও ঠিক করে ফেললেন- জান্নাত। বাড়িটি কেনার পরপরই তার সাফল্য বহুগুণে বেড়ে গেল। তার সকল ইচ্ছে পূরণ হতে শুরু করল, ক্যারিয়ারেও আগের চেয়েও অনেক বেশি নাম কুড়াতে লাগলেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাহরুখ খান তার মন বদলে ফেললেন, জান্নাতের জায়গায় বাড়িটির নাম দিলেন মান্নাত।
শাহরুখ খান তার স্ত্রী গৌরী খান, বড় ছেলে আরিয়ান, মেয়ে সুহানা ও ছোট ছেলে আবরামকে নিয়ে সপরিবারে এখানে বসবাস করেন। বাড়িটি কেনার পর নিজেদের মনের মতো করে সাজাতে প্রায় ৪ বছর সময় লেগেছিল কিং খান দম্পতির।
৬ তলা এই বাড়িটিতে রয়েছে দারুণ ইটালিয়ান স্থাপত্যের ছোঁয়া, রয়েছে আধুনিক সব জিনিসপত্র ও সৌখিন সামগ্রীর উপস্থিতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনা হয়েছে সেইসব নয়নাভিরাম জিনিসপত্র, রয়েছে এম. এফ হুসেইনের চিত্রকর্ম।
বাড়িতে রয়েছে দুইটি লিভিং রুম এবং দুটি ফ্লোরই লিফট দ্বারা সংযুক্ত। এছাড়া রয়েছে ড্রয়িং রুম, বেড রুম, ডাইনিং রুম, প্রেয়ার রুম, কিচেন, লাইব্রেরী, প্রাইভেট বার, ইন্টারটেইনমেন্ট রুম, গেস্ট রুম, জিম, কিং খানের স্টুডিও ও অফিস।
এখানেই শেষ নয়, বাচ্চাদের খেলার জন্য রয়েছে একটি পুরো ফ্লোর। কিং খানের স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল যে, তাদের বাড়িতে একটি বক্সিং রিং থাকলে ভালো হত, যেমন ভাবা তেমন কাজ। বক্সিং রিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরো রয়েছে টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা, সুইমিং পুল, বেজমেন্ট কার পার্কিং ও বাড়ির সামনে রয়েছে বাগান।
বিলাসবহুল ও দৃষ্টিনন্দন এই বাড়িটির বাইরের দেয়ালে শ্বেত মার্বেলের ব্যবহার এনে দিয়েছে এক রাজকীয় ভাব। বাড়ির জানালাগুলো তৈরি হয়েছে ফ্রেঞ্চ গ্লাস দিয়ে এবং এই গ্লাসগুলোও বুলেটপ্রুফ। বাড়ির ভেতরের দেয়ালে বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই রয়েছে সাদা ক্রিম রংয়ের উপস্থিতি, তবে কিছু কিছু জায়গায় সিলভার এবং কালো রংও ব্যবহার করা হয়েছে।
তোরণদ্বার এবং বাড়ির ভিতরে অবস্থিত অসংখ্য কারুকার্যখচিত পিলারগুলোকে দেখলে বাড়িটিকে রাজপ্রাসাদের ন্যায় বলে মনে হবে। শুধু কী তা-ই? পুরো বাড়ি জুড়ে রয়েছে হাজারো আধুনিক ও মনোমুগ্ধকর সব জিনিসপত্র, আর এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
ঘরের সিলিং ও দেয়ালে রয়েছে ফুলের ডিজাইনসহ নানারকম নজরকাড়া ডিজাইন এবং ঘরের আসবাবপত্রগুলোও তৈরি করা হয়েছে এই ডিজাইনগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে। পুরো বাড়ির আসবাবপত্রেই রয়েছে সোনালী রংয়ের ছোয়া।
কিং খানের এই প্রাসাদের লাইটিংও এক্সক্লুসিভ। পুরো অন্দরমহল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মোমদানিগুলো আপনার চক্ষুদ্বয়কে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আটকে রাখবে। এবার আসা যাক বাদশাহের খানাপিনার স্থান অর্থাৎ ডাইনিং রুমে। এখানে রয়েছে ১২ আসনবিশিষ্ট একটি ডাইনিং টেবিল। টেবিলটি তৈরি করা হয়েছে কাঠ ও মেটাল দিয়ে। বিশ্বের সেরা কিছু রাঁধুনির হাতে তৈরি সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করা হয়।
বাড়িটির এত বর্ণনা শুনে আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগে, বসবাসের জন্য এই বাড়িটির লোক ধারণক্ষমতা কত? জেনে অবাক হবেন, প্রায় ২২৫ জন মানুষ অনায়াসে বসবাস করতে পারবে এই বাড়িটিতে।
ছাদ থেকে ঘুরে আসা যাক এবার। বাড়িটির ছাদে উঠলে আপনি সমুদ্রের এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। কিং খান বিভিন্ন পার্টির আয়োজন প্রায়শই এই ছাদে করে থাকেন। বাড়ির চমক শেষ হয়নি এখনো। শাহরুখ খান এবং গৌরী খানের কফি টেবিলে একজোড়া জুতার ভাস্কর্য দেখলে বিস্ময়ে কপালে কিছুটা ভাজ পড়াই স্বাভাবিক। অবাক হবেন না, শাহরুখ পত্নী টম ডিক্সনের প্রোডাক্টের একজন অন্ধভক্ত এবং গৌরী খানের এমন প্রোডাক্টপ্রীতির কারণেই টম ডিক্সনের ব্রান্ড শ্যু’র আদলে বানিয়ে নিয়েছেন ভাস্কর্যটি। টম ডিক্সনের পরিচয়টা একটু বলে রাখি। টম ডিক্সন একজন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার। লাইটিং, ফার্নিচার ও এক্সেসরিজের ডিজাইনের ক্ষেত্রে রয়েছে তার অনবদ্য ভূমিকা।
মান্নাত শাহরুখ খানের একটি স্বপ্নের বাড়ি। অভিনয় ও ব্যক্তিজীবন, উভয়জীবনে সফল এই মানুষটি এক অদৃশ্য মুকুটধারী বাদশাহ। এমন একটি বাড়ি সাধারণ মানুষের কল্পনাতেই বিচরণ করে। মান্নাত সম্পর্কে কিং খানের একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক। শাহরুখ খান বলেছিলেন, “আমি যদি কোনদিন সবকিছু হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাই, তবুও আমি মান্নাতকে কখনো বিক্রি করবো না।”