জীবন সহজ নাকি জটিল— এ নিয়ে নানাজনের আছে নানা মত। জীবন কারো কাছে বড্ড জটিল অংক। আবার কারো কাছে খুব সহজ হিসাব। তবে যারা জীবনকে সহজ বলছেন, তারা কি অনায়াসেই সহজ জীবন পেয়ে গিয়েছেন, নাকি জীবনকে সহজ করে তুলেছেন? প্রশ্নটি জীবনঘনিষ্ট। তাই এর উত্তরও জীবনঘনিষ্ট হওয়া চাই। ২০১১ সালে টেডএক্স-এর এক বক্তৃতায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন থাইল্যান্ডের কৃষক জন জানদাই। ‘লাইফ ইজ ইজি। হোয়াই উই মেইক ইট সো হার্ড?’ শীর্ষক সেই বক্তৃতার সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
আমি আমার জীবনে সবাইকে একটি কথা বলতে চেয়েছি। সেটি হলো- “জীবন সহজ।” এটা খুবই সহজ ও উপভোগ্য। আমি আগে এভাবে ভাবতাম না। আমি যখন ব্যাংককে ছিলাম, তখন আমার মনে হতো- জীবন খুব কঠিন, খুব জটিল।
থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক দরিদ্র গ্রামে আমার জন্ম। যখন ছোট ছিলাম, তখন সবকিছুই উপভোগ্য আর সহজ ছিল। কিন্তু গ্রামে যখন টিভি এলো, তখন অনেক লোক গ্রামে এলো। তারা বলল, “তুমি গরীব। তোমাকে তোমার জীবনের জন্য সফলতার পথ অনুসরণ করতে হবে। জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য তোমাকে ব্যাংককে যেতে হবে।” জীবনে প্রথমবার গরীব হওয়ার কারণে আমার খারাপ লাগছিল। এরপর আমি ঠিক করলাম, সফলতা অর্জন করতে হলে আমাকে ব্যাংকক যেতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা
আমার ব্যাংকক যাত্রা খুব একটা সুখকর ছিল না। ওখানকার লোকেরা আমাকে বলল, আমাকে শিখতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে এবং খুব পরিশ্রম করতে হবে, তবেই সফলতার মুখ দেখা যেতে পারে। এ কারণে আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম। দৈনিক প্রায় আট ঘন্টা করে কাজ করতাম। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও আমি যা খেতে পেতাম তা হলো- প্রতিবেলা খাবারে এক বাটি নুডলস, ফ্রাইড রাইস, অথবা এরকমই কিছু একটা। আর অনেক লোক একসঙ্গে একটা অস্বাস্থ্যকর, ঘুপচি ঘরে থাকতাম। তার উপর ঘরটি ছিল বেশ গরম। এসব দেখে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আমি যেহেতু কঠোর পরিশ্রম করি, তাহলে আমার জীবন এত কঠিন কেন? আমি বুঝতে পারলাম যে এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। কারণ, আমি অনেক কাজ করতাম কিন্তু এর বিনিময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেতাম না।
আমি জানতে চাইতাম। আমি শিখতে চাইতাম। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আমার জন্য একটা একঘেয়েমি ব্যাপার ছিল। শুরুতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদের বিষয়গুলো মনযোগ দিয়ে দেখলাম। আমার মনে হচ্ছিল, এর বেশিরভাগই ছিল ধ্বংসাত্মক বিদ্যায় পরিপূর্ণ। আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উৎপাদনশীল শিক্ষা ছিল না। একে এভাবে বলা যেতে পারে; যেমন ধরুন, কেউ স্থপতি কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার জন্য পড়ছে। এর মানে সে সবকিছু ধ্বংস করতে শিখবে। এই লোকেরা যত বেশি কাজ করবে, তত বেশি পাহাড় ধ্বংস হবে। চাও ফ্রেয়া নদী (থাইল্যান্ডের বৃহত্তম জলাশয়) অববাহিকার ভালো জমিগুলো আরও বেশি করে কংক্রিটের তলায় ঢাকা পড়বে। তাই বলা যায়, তারা আরও ধ্বংস করতে শিখবে। এখন যদি কেউ কৃষি অনুষদ কিংবা এমন কিছুতে পড়াশোনা করে, এর মানে সে শিখবে কীভাবে বিষ প্রয়োগ করতে হয়, কীভাবে মাটি দূষণ করতে হয়, কীভাবে পানি বিষাক্ত করতে হয়। মোটকথা, সবকিছুই ধ্বংস করতে শিখবে।
আমি ভাবতে লাগলাম, আমরা যা করি তার সবই খুব জটিল, খুব কঠিন। এবং আমরা সকল কিছুকেই কঠিন করে ফেলি। আমি ভাবলাম, জীবন খুব কঠিন। এ কারণে আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে লাগলাম, আমাকে কেন ব্যাংককে থাকতে হবে? আমি ভেবে দেখলাম, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন কেউ দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করত না। সকলে দুই ঘণ্টা কাজ করত। বছরের দুই মাস কাজ করত। এক মাসে ধানের বীজ বপন করত। আর অন্য মাসে ধান কাটত। বছরের বাকি দশ মাস ছিল অবসর সময়। এ কারণে থাইল্যান্ডের লোকেদের উৎসব লেগেই থাকে। প্রতি মাসেই তাদের কোনো না কোনো উৎসব থাকে। এর কারণ, তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। এমনকি তারা দিনের বেলায় একটা ভাত-ঘুম (ন্যাপ) দিয়ে নেয়। এখনও যদি কেউ লাওসে (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ) যায়, যেমন ধরুন, আপনি যদি লাওসে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানকার লোকেরা দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে নেয়। জেগে ওঠার পর তারা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে মশগুল থাকে। গল্পের বিষয়বস্তু হয়তো এমন থাকে, তোমার জামাতা কেমন আছে, তোমার স্ত্রী কেমন আছে, তোমার পুত্রবধূ কেমন আছে ইত্যাদি।
সেখানকার লোকেদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। তাদের কাছে যেহেতু পর্যাপ্ত সময় আছে, তাই তাদের নিজের জন্য ব্যয় করার সময় আছে। তাদের যেহেতু নিজেদের জন্য সময় আছে, তাই তারা নিজেদের বোঝার জন্য সেই সময় ব্যয় করতে পারে। তারা যখন নিজেদের বুঝতে পারে, তখন তারা তাদের জীবনে প্রকৃতপক্ষে কী চায়, তা জানতে পারে। ফলে তাদের অনেকে সুখ চায়, অনেকে ভালোবাসা চায়, অনেকে তাদের জীবনকে উপভোগ করতে চায়।
এমতাবস্থায় লোকেরা তাদের জীবনের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে। তারা সেই সৌন্দর্যকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশও করতে পারে। অনেকে খুব সুন্দর করে ছুরির হাতল খোদাই করে। অনেকে খুব সুন্দর করে ঝুড়ি বুনে। কিন্তু ব্যাংকক শহরের লোকেরা এসব করে না। তারা এমন কিছু করতেই পারে না। তারা সর্বত্র প্লাস্টিক ব্যবহার করে। এজন্য আমার মনে হয়েছে, এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। আমার মনে হতো, আমি এভাবে বাঁচতে পারব না। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, এবং বাড়ি ফিরে এলাম।
আমি যখন বাড়ি ফিরে এসে, শৈশবের দিনগুলোতে যেমন করে বাঁচতাম, যেমনটা আমার মনে পড়ে, আমি ঠিক তেমন করে বাঁচতে লাগলাম। এখন আমি বছরের দুই মাস চাষাবাদ করে সেখান থেকে চার টন চাল পাই। আমরা ছয়জনের পুরো পরিবার মিলে বছরে আধা টনেরও কম চাল খেতে পারি। ফলে আমরা কিছু চাল বিক্রি করতে পারি। এরপরে আমি দুই-দুইটি মাছের পুকুর খনন করি। এখন আমাদের সারা বছর খাওয়ার মতো মাছ আছে। আধা একরেরও কম জায়গা নিয়ে একটি ছোট বাগান করে ফেলি। বাগানের যত্ন নিতে আমি দৈনিক পনেরো মিনিট সময় ব্যয় করি। এখন আমার বাগানে ত্রিশেরও অধিক জাতের সবজি আছে। ছয়জন মানুষ সব খেতে পারে না। বাজারে বিক্রি করার জন্য আমাদের কিছু উদ্বৃত্ত থাকে। আমরা এখন থেকেও কিছু আয় করতে পারি।
আমার মনে হয়, জীবন সহজ। তাহলে আমাকে কেন সাত বছর ধরে ব্যাংককে থাকতে হবে, যেখানে কঠোর পরিশ্রম করেও পর্যাপ্ত খাবার নেই! এখানে বছরে মাত্র দুই মাস, এবং প্রতিদিন পনেরো মিনিট ব্যয় করে আমি ছয়জনকে খাওয়াতে পারি। এ কারণে আমি বলতে পারি, এটা খুব সহজ।
বাসস্থান
আমি আগে ভাবতাম, আমার মতো নির্বোধেরা, যারা কখনও বিদ্যালয়ে ভালো গ্রেড পায় না, তাদের ঘর-বাড়ি গড়তে পারে না। কারণ, যারা প্রতি বছর ক্লাসে প্রথম হয় তারা আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তারা ভালো চাকরি পায়, তবে তাদের বাড়ি পেতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়। এখন ভাবনার বিষয় হচ্ছে, যেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিই পেরোতে পারিনি, সেই আমি কীভাবে বাড়ি গড়ে তুলতে পারি? আমার মতো স্বল্পশিক্ষিত লোকেদের জন্য এটা সত্যিই হতাশাজনক ব্যাপার।
এরপরে আমি মাটির দালান গড়তে লাগলাম। এটা খুব সহজ। আমি প্রতিদিন দুই ঘন্টা ব্যয় করি। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত দুই ঘন্টা কাজ করি। এভাবে আমি তিন মাসের মধ্যে একটি বাড়ি পেয়ে যাই। আমার আরেক বন্ধু, যে ক্লাসে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিল, তারও বাড়ি বানাতে তিন মাস সময় লেগেছে। তবে তাকে ঋণী হতে হয়েছে। তাকে ত্রিশ বছর ধরে তার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। তার তুলনায় আমার ঊনত্রিশ বছর এবং দশ মাস অবসর সময় আছে। যে কারণে আমি অনুভব করতে পারি, জীবন খুব সহজ।
আমি কখনও ভাবিনি, আমি এত সহজে বাড়ি বানাতে পারব। আমি প্রতি বছর অন্তত একটি করে ঘর বানাই। আমার কাছে টাকা নেই, তবে আমার অনেক ঘর আছে। আমি রাতে কোন ঘরে ঘুমাতে যাব; সেটাই আমার সমস্যা। এজন্য বাড়ি করা কোনো সমস্যা নয়, যে কেউ চাইলেই তা তৈরি করতে পারে। ১৩ বছর বয়সী বাচ্চারা, যারা স্কুলে একসাথে খেলনাঘর গড়ে, তারাও ঘর তৈরি করতে পারে। এভাবে কাজ শুরু করলে এক মাস পরে তাদের একটা পড়ার জায়গা হয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসীও নিজের থাকার জন্য একটা কুঁড়েঘর গড়তে পারেন। যে কেউ ঘর গড়তে পারে। অতএব, এটাও সহজ। আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন, যদি কেউ ঘর গড়তে চান, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
বস্ত্র
এরপরের গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো বস্ত্র। আমার মনে হতো, আমি গরিব। আমার মনে হতো, আমি সুদর্শন নই। এজন্য আমি অন্যদের মতো পোশাক পরার চেষ্টা করতাম। নিজেকে সুন্দর দেখাতে, আরও সুদর্শন দেখাতে অনেকটা সিনেমার তারকাদের মতো পোশাক পরার চেষ্টা করতাম।
আমি একজোড়া জিন্স কিনতে প্রায় এক মাস ধরে টাকা সঞ্চয় করলাম। এরপর জিন্স কিনে তা পরলাম। আমি বামদিকে ঘুরলাম, ডানদিকে ঘুরলাম; অতঃপর আয়নার দিকে তাকালাম। আমি যতবার তাকালাম, ততবার দেখলাম- আমি সেই একই ব্যক্তি। আমি বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে দামি প্যান্টও আমার জীবন পরিবর্তন করতে পারবে না। তখন নিজেকে হিতাহিত জ্ঞানহীন মনে হচ্ছিল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমাকে কেন এটা কিনতে হবে? এক জোড়া প্যান্ট কিনতে আমি এক মাস ব্যয় করেছি, অথচ এটা আমাকে পরিবর্তন করেনি!
আমি এ সম্পর্কে আরও ভাবতে লাগলাম। আমি ভাবতে লাগলাম, আমদের কেন ফ্যাশন অনুসরণ করতে হবে? আমরা যখন ফ্যাশন অনুসরণ করি, তখন আমরা নিজেরা কখনোই ফ্যাশনে পরিণত হই না। কারণ, আমরা কেবল এর অনুসরণ করি। তাই এটি আর অনুসরণ করবেন না, এখানেই থামুন। আপনার যা আছে, তা ব্যবহার করুন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই বিশ বছরে আমি কোনো কাপড় কিনিনি। আমার কাছে যে সব জামাকাপড় আছে, সেগুলোর সবই মানুষের উচ্ছিষ্ট। মানুষেরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, এবং তারা যখন চলে যায়, তখন তারা অনেক কাপড় রেখে যায়। এ কারণে আমার কাছে অনেক কাপড় আছে। লোকে যখন আমাকে অনেক পুরাতন কাপড় পরতে দেখে, তখন তারা আমাকে আরও বেশি কাপড় দেয়। এজন্য এখন আমার সমস্যা হলো, এত্ত এত্ত কাপড় আমাকে প্রায়শই লোকেদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হয়। সুতরাং, এটি খুব সহজ।
আমি যখন জামাকাপড় কেনা বন্ধ করে দিই, তখন থেকে আমার মনে হয়, ব্যাপারটি শুধু জামা-কাপড়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে তেমনটি নয়, এটা আমার জীবনের অন্য কিছু সম্পর্কেও প্রযোজ্য হতে পারে। এখান থেকে আমি যা শিখেছি তা হলো, আমি যখন কিছু কেনার সিদ্ধান্ত নেই, তখন আমি ভেবে দেখি, এটা আমার পছন্দ, নাকি প্রয়োজন তাই কিনছি। উত্তরটি যদি হয়, আমার পছন্দ তাই কিনছি, তাহলে এর মানে আমি ভুল করছি। আমি যখন এভাবে চিন্তা করি, তখন আমি সত্যিই আরও মুক্ত বোধ করি।
চিকিৎসা
শেষ কথা হলো, আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কী করব? আমি শুরুতে সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়তাম। কারণ, আমার কাছে যখন টাকা থাকবে না, তখন আমি কী করব। আমি এই নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করি।
সাধারণভাবে বললে অসুস্থতা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা খারাপ না। অসুস্থতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা আমাদের জীবনে কিছু ভুল করেছি। ফলে আমরা অসুস্থ হয়েছি। তাই আমি যখন অসুস্থ হই, তখন আমাকে থামতে হবে এবং নিজের কাছে ফিরে আসতে হবে। এ সম্বন্ধে ভেবে দেখতে হবে, আমি কী ভুল করেছি। আমি শিখেছি কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য জল ব্যবহার করতে হয়। আমি শিখেছি কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য পৃথিবীকে ব্যবহার করতে হয়। আমি শিখেছি কীভাবে আরোগ্য লাভের জন্য প্রাথমিক জ্ঞান ব্যবহার করতে হয়।
পরিশেষে
আমি নিজে যখন এই চারটি জিনিসের (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা) উপর নির্ভর করি, তখন আমার মনে হয়, জীবন খুব সহজ। আমি স্বাধীনতার মতো কিছু একটা অনুভব করি। আমি মুক্ত বোধ করি। আমার মনে হয়, আমি খুব একটা চিন্তা করি না। আমার ভয় কম। আমি আমার জীবনে যা চাই তা-ই করতে পারি। আগে আমার অনেক ভয় ছিল। আমি কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু এখন আমি মুক্ত বোধ করি। আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমি একজন অনন্য মানুষ। আমার মতো কেউ নেই। আমার অন্য কারো মতো হওয়ার দরকার নেই। আমিই প্রথম। এই বিষয়গুলো আসলেই সহজসাধ্য, খুব হালকা।
তারপরে, আমি যখন ব্যাংককে ছিলাম তখন আমি আমার জীবনে খুব অন্ধকার অনুভব করতাম। তখন থেকে আমি ভাবতে শুরু করি যে তখন অনেকেই হয়তো আমার মতো করে ভাবত। এজন্য আমরা চিয়াং মাইতে (উত্তর থাইল্যান্ডের একটি পার্বত্য শহর) ‘পুন পুন’ (জৈব খামার ও শিক্ষা কেন্দ্র) নামে একটি জায়গা করেছি। এর মূল লক্ষ্য বীজ (ফসলের যেকোনো অংশ যা অনুরূপ একটি ফসল পুনঃউৎপাদনে সক্ষম) সংরক্ষণ করা। বীজ সংগ্রহ করতে হবে, কারণ বীজই খাদ্য, আর খাদ্যই জীবন। বীজ না থাকলে জীবন নেই। বীজ নেই তো স্বাধীনতা নেই। বীজ নেই তো সুখ নেই। বীজ না থাকলে আপনার জীবন অন্য কারো উপর নির্ভর করবে। বীজ না থাকলে আপনার কাছে খাবার নেই। অতএব, বীজ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে আমরা বীজ সংরক্ষণে মনোযোগ দিই। এটা পুন পুন-এর প্রধান কাজ।
পুন পুন-এর দ্বিতীয় কাজটি হলো এটা একটা শিক্ষাকেন্দ্র। আমরা নিজেদের শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই। সেখানে জীবনকে কীভাবে সহজ করা যায়, তা শিখতে চাই। কারণ, আমাদের জীবনকে সবসময় জটিল ও কঠিন করতে শেখানো হয়েছে। তাহলে আমরা একে কীভাবে সহজ করতে পারি? জীবন আসলে সহজ, তবে আমরা জানি না একে কীভাবে সহজ করে তুলতে হয়। আমরা জীবনকে সবসময় জটিল করে ফেলি। এখন আমরা শিখতে শুরু করেছি, এবং একসাথে থেকে শিখছি।
আমাদের যেহেতু শেখানো হয়েছিল অন্য সবকিছু থেকে নিজেদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে, স্বাধীন হতে, আমাদের একে অপরের উপর নির্ভর করতে হবে না, তাই আমরা শুধু অর্থের উপর নির্ভর করি। কিন্তু এখন সুখী হওয়ার জন্য, আমাদের ফিরে যেতে হবে। আবার নিজেদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। অন্য লোকেদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। আমাদের মন ও শরীরকে আবার একসাথে সংযুক্ত করতে হবে। এভাবে আমরা সুখী হতে পারব।
জীবন সহজ। শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমি যা শিখেছি তা হলো মৌলিক চাহিদা চারটি: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা। এগুলো সবার জন্য সস্তা ও সহজ হতে হবে, এটাই সভ্যতা। তবে আপনি যদি এই চারটি জিনিসকে সকলের জন্য কঠিন করে ফেলেন, তবে তা হবে বর্বরতা। এখন যদি আমরা আমাদের চারপাশের সকল কিছুর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে- সবকিছু পাওয়া খুব কঠিন। তাই আমার মনে হয় এখন পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বর্বর যুগ চলছে।
আমাদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে। পৃথিবীতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পৃথিবীতে অনেক দক্ষ লোকও আছে। তবে জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর। আমরা একে কার জন্য কঠিন করছি? এই মুহূর্তে আমরা কার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি? আমি মনে করি, এটা ভুল। এটা স্বাভাবিক নয়। এজন্য আমি শুধু স্বাভাবিকের দিকে ফিরতে চাই। আমি একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি হতে চাই, হতে চাই প্রাণীদের সমকক্ষ। পাখি দু-এক দিনের মধ্যেই বাসা তৈরি করে ফেলে। ইঁদুর এক রাতের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে ফেলে। অথচ আমাদের মতো দক্ষ মানুষেরা বাড়ি তৈরি করতে ত্রিশ বছর সময় পার করে দেয়। অনেকে সারা জীবনে বিশ্বাসই করতে পারে না যে তার নিজের একটা বাড়ি হতে পারে। অতএব, এটা ভুল।
আমরা কেন আমাদের অন্তরাত্মাকে ধ্বংস করি? আমরা কেন আমাদের কার্যক্ষমতাকে এতটা ধ্বংস করি? আমি মনে করি, অস্বাভাবিকের চেয়ে স্বাভাবিক উপায়ে জীবনযাপন করা আমার জন্য যথেষ্ট। এজন্য আমি এখন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। তবে লোকেরা আমাকে অস্বাভাবিক ভাবে। আমাকে পাগল ভাবে। তাতে আমি পাত্তা দিই না। কারণ, এটা আমার দোষ নয়। এটা তাদের দোষ। কারণ, তারা এরকম ভাবে। আমার জীবন এখন সহজ-সরল। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। মানুষ যা খুশি ভাবতে পারে। আমি নিজের ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারি না। আমি যা করতে পারি তা হলো, আমার মন পরিবর্তন করতে পারি। আমার মনকে পরিচালনা করতে পারি। এখন আমার মন সহজ ও সরল। আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। কেউ পছন্দ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আপনারও পছন্দ থাকতে পারে। সেই পছন্দ সহজ নাকি জটিল হবে সেটা শুধু আপনার উপরই নির্ভর করে।