শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী পৃথিবীতে যে বিপ্লবটি ঘটেছে তাকে তথ্য বিপ্লব বলা হয়। তবে তথ্য বিপ্লব ঘটেছে আদতে প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণেই। প্রতি মূহুর্তে পৃথিবী এর আগের মূহুর্তের চেয়ে অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে প্রযুক্তির উপর। এই নির্ভরশীলতা বর্তমান সময়ে এমন পর্যায়ে গেছে যে তা নিয়ে সচেতন মানুষেরা কথা না বলে পারছেন না। প্রতিনিয়ত লেখালেখি হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভরশীলতার কুফল নিয়ে, তাতে কাজ কিন্তু খুব একটা হচ্ছে না।
ফেসবুক, টুইটারের এযুগে জ্ঞানগর্ভ সমালোচনামূলক লেখা পড়ার সময় কই আসলে? তাই কার্টুনিস্টরা এগিয়ে এসেছেন এই সমস্যার সমাধান দিতে। গুগল ঘাটলে মানুষের প্রযুক্তির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে শত শত ব্যঙ্গচিত্র পাওয়া যাবে। তবে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত আর মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করা ৩০টি ছবি নিয়ে সাজানো হলো এই ফটোব্লগটি।
ফেরিস্কোপ
নিজের চোখে পৃথিবীটাকে দেখা প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছে মানুষ। ঘরে বসে ফেসবুক নামক ‘পেরিস্কোপ’ দিয়ে বাইরের জগত পর্যবেক্ষণ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে মানুষ। আর তাই ব্যঙ্গকরে এর নাম দেয়া হয়েছে ফেরিস্কোপ!
অনলাইন বনাম অফলাইন
ছবিটিতে চমৎকার পারদর্শীতায় কয়েকটি বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন না, তারা দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কিন্তু যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেশায় বুঁদ, তাদের জীবনটা অনলাইন আর অফলাইনের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে। তাছাড়া অনলাইনে যাওয়া মানে তলিয়ে যাওয়া দিয়ে বোঝানো হয়েছে বাস্তব জগত থেকে দূরে সরে যাওয়া।
প্রজন্মের বিবর্তন
কাগুজে পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়া, সে তো ‘ওল্ড ফ্যাশন’। এই দৃশ্য আধুনিক প্রজন্মের কাছে যেন রীতিমতো বিস্ময়কর এক ঘটনা!
কৃত্রিম খুশি
প্রাত্যহিক জীবনে যতই দুঃখ দুর্দশা থাকুক না কেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের একটি কৃত্রিম হাসিমাখা ছবি দিয়েই যেন সেসব দুঃখ ভুলে থাকতে চায় মানুষ! এরূপ মিথ্যা হাসির অন্তরালে প্রতিনিয়ত নিজের আবেগটাই হারিয়ে ফেলছে মানুষ।
পাখির গানের পরিপূরক টুইটার
পাখির কিচিরমিচির শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ কী? উত্তর ‘টুইটার’। আর অন্যতম জনপ্রিয় একটি মাইক্রোব্লগ সাইটের নাম হচ্ছে টুইটার। তাহলে আর পাখির কিচিরমিচিরের কী দরকার, কৃত্রিম টুইটার তো আছেই!
খেলার সঙ্গী প্রযুক্তি
মোবাইল আর কম্পিউটারে চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্সের সব ভিডিও গেমসের ভিড়ে মাঠে খেলার সময় কই?
পশুর মতো বাঁধা পড়েছে মানুষ
পশুর গলায় বাঁধা দড়ির মতো মানুষের হাত পা বাঁধা পড়ছে মোবাইল ফোনের চার্জারের লম্বা তারে!
প্রযুক্তিই ওষুধ
এই ছবির কোনো ক্যাপশনের প্রয়োজন আছে কি? তাবৎ রোগের ওষুধ তো এখন এসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোই!
ফেসবুকই সব
আকাশের নীল কিংবা সাগরের নীলের চেয়ে ফেসবুকের নীলই মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে, তাই নয় কি?
মোবাইলে বাঁধা মানুষ
স্মার্টফোনের এই সময়ে একজন মানুষের সচরাচর কয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি থাকে বলুন তো? সংখ্যাটা একের বেশিই হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর প্রতিটিতে কয়েকঘন্টা করে সময় দিলে দেখা যায় দিনের একটা বড় অংশ কেটে যায় মোবাইল ফোনে ডুবে থেকেই।
নিঃসঙ্গতা
কার্ল মার্ক্সের ‘এলিয়েনেশন’ তত্ত্ব আজকের যুগে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সত্য। যার যার স্মার্টফোনই তার তার পৃথিবী, এর বাইরে বাকি সব যেন মিথ্যা!
ফেসবুকীয় জাদুর বাক্স
কমেন্টে আর ইনবক্সে প্রতিনিয়ত তর্কবিতর্ক, ছবি আপলোড দেয়া আর তা নিয়ে খুনসুটি করতে করতে মানুষগুলো কখন যে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে, তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না।
বইপত্রের দিন কী তাহলে শেষ?
মুঠোফোন আর গ্যামপ্যাডের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকতে না পারা বইয়ের তাই কবরেই জায়গা হচ্ছে!
মুঠোফোনের শিকড়
কখনো ভালো করে নিজের মুঠোফোনের নিচের দিকটা পর্যবেক্ষণ করেছেন কি? করলে দেখতে পাবেন তাতে শিকড় গজিয়েছে যা আপনার হাতের সাথে আষ্টপৃষ্ঠে বাঁধা! শিকড় না গজালে এই যন্ত্রটি আপনার হাত থেকে সরছে না কেন?
সকাল সন্ধ্যা মোবাইল
মানুষের যৌনজীবনও বিঘ্নিত হচ্ছে মোবাইলফোনের প্রভাবে!
মিথ্যা উপস্থাপন
‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’, এই উক্তিটি সবচেয়ে ভালো প্রতিফলিত হয়েছে এই ছবিতেই। ফটোশপ আর বিভিন্ন অ্যাপের কারিশমায় নিজেকে ফেসবুকে অধিকতর সুন্দর করে উপস্থাপন করার প্রতিযোগীতায় মানুষের ব্যক্তিত্ব নড়বরে হয়ে পড়ছে।
সাহিত্যের মৃত্যু
‘ডেডপয়েট সোসাইটি’ ছবিটির অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক মিস্টার কিটিংয়ের সাহিত্য নিয়ে করা উক্তিটি মনে আছে?
চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, ব্যবসায় শিক্ষা, প্রকৌশলবিদ্যা- এগুলো মহৎ পেশা এবং জীবনের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু সাহিত্য, সৌন্দর্য, প্রেম, ভালোবাসা এগুলো হচ্ছে এমন কিছু যার জন্য আমরা বেঁচে থাকি।
আর সেই সাহিত্যেরই মৃত্যু ঘটিয়ে দিয়েছে প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো।
নিজেকে দেখি মোবাইলফোনে
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ নিজেকে নিয়ে ভেবেছে, নিজেকে নতুন করে জানার আর উদঘাটন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্মার্টফোনের যুগে স্মার্টফোনই একজন ব্যক্তিকে তার চেয়ে বেশি জানে, চেনে! তাই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনেই যেন মানুষ নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়ায়।
চোখ থাকিতে অন্ধ!
প্রযুক্তির ছড়াছড়ির এ যুগে মানুষের চোখ সুস্থ হলেও তারা একরকম অন্ধ। হ্যাঁ, রাস্তা পারাপারের সময় মানুষ রাস্তায় না দেখে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলে তাদের তো অন্ধ বলতেই হয়।
দেহের পেছনে শিকড়
সারাদিন সোফায় বসে টিভির স্ক্রিনে বুদ হয়ে থাকলে এই ছবিটির মতো সত্যি সত্যি পশ্চাদ্দেশে শিকড় হয়ে যেতে পারে!
লাইকোহোলিক
এখন ‘অ্যালকোহোলিক’ মানুষের চেয়ে অধিক নেশাগ্রস্ত থাকে ‘লাইকোহোলিক’ মানুষ। প্রতিটি ছবি, স্ট্যাটাস, চেকইনে পর্যাপ্ত লাইক হলো কিনা, না হলে কেন হলো না, কীভাবে আরো লাইক বাড়ানো যায়, এসব ভাবনায় সদাব্যস্ত থাকেন লাইকোহোলিক মানুষেরা।
স্বীকারোক্তি
প্রেম প্রস্তাব থেকে শুরু করে নিজের কোনো অপরাধ বা ভালো কাজ কিংবা অন্যের দোষ-গুণ প্রচার করার সবচেয়ে ভালো প্রচার মাধ্যম এখন ফেসবুক। মাইকে প্রচার করার চেয়ে ফেসবুকে প্রচার করলেই অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ব্যাপারগুলো।
ব্যতিক্রম
সংখ্যায় কম হলেও স্মার্টফোনের নেশা নেই, এখনো এরকম মানুষ আছে সমাজে। আর তাদের অবস্থা কিছু ক্ষেত্রে এই ছবিটির মতো। বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা যানবাহনে চড়ার সময় স্মার্টফোন ছাড়া ব্যক্তিটিকে যেন এলিয়েন মনে হয়!
বাস্তবতার সাথে দূরত্ব সৃষ্ট
মহিষটির হাতের পত্রিকাটি প্রতিকী অর্থে বাস্তব জগতকে নির্দেশ করছে। আর এর বিষ্ঠা, যা কিনা টিভিতে দর্শকরা দেখছেন, তা দ্বারা বাস্তবতা বিবর্জিত, রংচঙে আর অর্থহীন সব টেলিভিশন প্রোগ্রামকে বোঝানো হচ্ছে, যেগুলোর কৃত্রিমতা আমাদেরকে ভুলিয়ে রাখছে।
মানুষও পোষ মেনেছে
পৃথিবীর তাবৎ পশুপাখিকে বশ বশ করতে পেরেছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। তবে এখন আর মানুষও স্বাধীন নেই। মানুষের গলায়ও দড়ি দিয়ে পোষ মানিয়ে ফেলেছে প্রযুক্তি।
মানসিক সমস্যা
আগে একাকীত্বে ভুগলে মানুষ পরিবারের সদস্যদের সাথে না হোক বন্ধুদের সাথে সব খুলে বলে নিজেকে মানসিকভাবে হালকা করার চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। নিঃসঙ্গতায় ভোগা মানুষটি এখন ফেসবুকে ‘আই অ্যাম এলন’ কিংবা ‘নোবডি কেয়ারস’ এর মতো লেখা পোস্ট করে সহমর্মিতা কুড়াতে চায়। তাতে সাময়িকভাবে সে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে সে একাকীত্বের চক্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে প্রতিনিয়ত সমাজে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্থূলতা
প্রযুক্তি মানুষকে অলস করে তুলেছে তাতে কারোরই সন্দেহ নেই। আর এই আলস্যের কারণে আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের মাঝে স্থূলতার হার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
গুরুত্ব হারাচ্ছে অনেক কিছুই
যখন প্রযুক্তির প্রাচুর্য ছিল না, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ছিল না, তখন ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যাদির গুরুত্ব অসীম ছিল। মানুষ আগ্রহভরে সেগুলো গ্রহণ করতো। এখন ইন্টারনেটে তথ্যের প্রাচুর্য সীমা ছাড়িয়েছে, যে কারণে সেগুলো গুরুত্বও হারাচ্ছে প্রতিদিন।
সময়ের মূল্য নেই
খেলার সময় নেই, পড়ার সময় নেই, ঘুমানোর সময় নেই, খাওয়ার সময় নেই, গোসলের সময় নেই, সময় তাহলে যাচ্ছে কোথায়? কেউ গিলে ফেলছে সময়টা? সেই ‘কেউ’ আর কেউ নয়, সে সময়খেকো মহাখাদকের নাম ‘ফেসবুক’। ফেসবুকের স্থলে আরো অনেক নামই যোগ করা যেতে পারে।
ব্রেইনওয়াশ প্রজন্ম
স্মার্টফোন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেড়ে নিচ্ছে, ধ্বংস করছে আমাদের মেধা, নষ্ট করছে আমাদের সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ আর বই পড়ার ইচ্ছা, ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে অনুৎসাহী করে ঘরে বসিয়ে তার ছোট্ট স্ক্রিনে ধ্যানমগ্ন করে রাখছে। আর এসবের মাধ্যমে আমরা সবচেয়ে মূল্যবান যে বস্তুটি হারাচ্ছি, তা হলো আমাদের মস্তিষ্ক!
ফিচার ছবি: pinterest.com