ভাগ্যের চাকার রকমফেরে জীবন পরিবর্তনের নজির আমাদের চারপাশে অসংখ্য। বহমান এই জীবনে নিরন্তর ঘোরে ভাগ্যের চাকার এপিঠ-ওপিঠ। কখনও সুবাতাস, আর কখনওবা মন্দ। খারাপ কিছুর জের ধরে মন্দ ভাগ্যের অজুহাত দিতে আমাদের কখনোই ভুল হয় না। অনেক সময় নিজের অপারগতা ঢাকার আরও একটি অন্যতম মাধ্যম এটি। তা সত্ত্বেও এমন অনেক ঘটনা অনেকের জীবনে ঘটে যায় যা হয়তো কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করা হয়নি। অন্য অনেকে হয়তো তা পাওয়ার পেছনে ছুটেছে অনেকটা সময়। কিন্তু ভাগ্যদেবীর সুপ্রসন্ন হাত কখন কার উপর পড়ে বোঝা মুশকিল। খুব সম্প্রতি এমনই এক ভাগ্য সুপ্রসন্নার কথা বলতে যাচ্ছি যিনি ৬৩ বছর বয়সে আচমকা হয়ে গেলেন জনপ্রিয় এক মডেল তারকা।
পুরো নাম লিন স্লেটার, আমেরিকার অধিবাসী। পেশায় নিউইয়র্কের ‘ফোরডাম’স স্কুল অফ সোশাল সার্ভিস’ নামে একটি স্কুলের অধ্যাপক। পিএইচডি করেছেন; আছে দুটি মাস্টার্স ডিগ্রীও। শিশু নির্যাতন এবং পারিবারিক কলহ নিয়ে কাজ করে আসছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন মা; হয়েছেন দাদীমাও। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার। খুব একটা বেশি চাওয়া-পাওয়ারও কিছু ছিল না। তবে একটা ব্যাপারে খুব দুর্বলতা ছিল, আর তা হলো ফ্যাশন। নিজের পোশাক আর চলাফেরার ব্যাপারে খুব সচেতন তিনি। রাস্তায় আর চার-পাঁচজন বৃদ্ধা মহিলা থেকে বেশ আলাদা করেই চোখে পড়ে তাকে। আর এই গুণের জন্যই তার ষাটোর্দ্ধ বয়সটি বিশ্বের মাঝে ধরা পড়ল অন্যরূপে।
মানুষের জীবনে নাটকীয় মোড় আসতে পারে যেকোনো সময়। আর লিনের কাছে এসেছিল আমেরিকায় অনুষ্ঠিত নিউইয়র্কের ফ্যাশন উইককে কেন্দ্র করে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। নিউইয়র্কের লিঙ্কন সেন্টারে চলছিল নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। লিনেরও এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। কাছের কিছু বন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে গেলেন অনুষ্ঠান উপভোগ করার আমন্ত্রণ। দ্বিধা করলেন না তিনি; চলে গেলেন অনুষ্ঠানে। বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন লিঙ্কন সেন্টারের সামনে। দেশ-বিদেশের প্রচুর ফটোগ্রাফার, মডেল, অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক থেকে শুরু করে মিডিয়া জগতের অনেকেই আমন্ত্রিত সেই অনুষ্ঠানে। সেসময় দুই জাপানি ফোটোগ্রাফারের নজরে আসেন লিন। জাপানি ফটোগ্রাফাররা ভেবে নেন বেশ নামীদামী কোনো মডেল হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন। তাই তারা ঝটপট ছবি তুলতে শুরু করেন।
আসলে লিনের স্টাইল এবং আধুনিক রূপ দেখে ঐ ফটোগ্রাফাররা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও বেশ কিছু ফোটোগ্রাফার এবং সাংবাদিক লিনের পাশে জড়ো হতে থাকে আর তার ছবি তুলতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকে আশেপাশের অনেক পর্যটক। তার প্রতি তখন সকলের চরম কৌতূহল। লিন কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও বেশ উপভোগ করছিলেন চারপাশের ঘটনাগুলোকে। এই সুযোগে অনেক সাংবাদিক তার ছোটখাট সাক্ষাৎকার নিতেও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। লিনও বেশ প্রতিষ্ঠিত মডেলের মতোই তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন।
এই ছোট ঘটনাটি হয়তো তার জীবনে শুধুমাত্র একটি সুখস্মৃতি হয়েই রয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ভাগ্য যেন তার জন্য অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিল। পরদিনই সোশ্যাল মিডিয়ার সবচাইতে আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠলেন এই ষাটোর্দ্ধ যুবতী। যুবতী বলছি কারণ চিরাচরিত রীতি মেনে নিয়ে বৃদ্ধা হতে তিনি নারাজ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি উপভোগ করতে চান। তাই তো বয়সের সাথে সাথেই পরিবর্তন করে ফেলেছেন নিজের পোশাকের ঢং। এমন পোশাকগুলোই বেছে নেন যা তার চরিত্রের সাথে মানানসই।
বয়সকে হার মানিয়ে হঠাৎ যেন সকলের নজর কেড়ে নিলেন তিনি। এই ঘটনাটির পরেই লিনের জীবন বদলে যায় অনেকটাই। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান তিনি। বিভিন্ন মডেলিং সংস্থার কাছ থেকে একের পর এক ফোন পেতে শুরু করেন এই অধ্যাপক। এর পরেই মডেলিং জগৎ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে তারকার সম্মান পেতে থাকেন লিন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার লক্ষাধিক ফলোয়ার রয়েছে যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বিধি যেন এরকমই এক নাটকের চিত্রপট লিখে রেখেছিলে তার জীবনে যা শুধু নাটক বা সিনেমার চিত্রকল্পেই পাওয়া যায়!
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিনকে। কিছুদিন আগেই বিশ্বখ্যাত মডেলিং সংস্থা ‘এলিট লন্ডন’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন লিন। কথা চলছে আরও বেশ কিছু প্রথম সারির ফ্যাশন হাউজের সাথে। প্রায় প্রতিদিনই তাকে বের হতে হচ্ছে ফটোশ্যুটের জন্যে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার জন্যও ডাক পাচ্ছেন। এছাড়াও ব্যস্ত আছেন বিভিন্ন রকম কনফারেন্স, মিটিং এবং ফাংশনে। নিজের বদলে যাওয়া জীবন এবং তারকা তকমা বেশ সানন্দে উপভোগ করছেন লিন।
ইংল্যান্ডের পত্রিকা ‘ডেইলি মেইলে’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি অনেক অল্পবয়সী মেয়েদের কাছ থেকে ই-মেইল পাচ্ছি যারা আমাকে জানাচ্ছেন যে আমি তাদের জীবনকে একটু অন্যভাবে ভাবতে সাহায্য করছি। বয়স হওয়াটাও যে এক ধরণের আনন্দের এবং স্বাভাবিক এটা তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছেন। আর বয়স যাই হোক না কেন নিজের ইচ্ছাশক্তিটাই আসল। এই ধরণের অভিজ্ঞতা আমাকে খুব পুলকিত করে।”
অনেক ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হলেও তাদের পছন্দমত পোশাক পড়তে নারাজ এই মডেল। তার পছন্দের ব্যাপারে এক চুল ছাড় দিতেও তিনি রাজি নন। নিজের পছন্দ, সীমাবদ্ধতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে পোশাক বেছে নেন লিন। সময়ের হুজুগে না পড়ে নিজের সামর্থ্যকেই প্রাধান্য দিতে পছন্দ করেন এমনই জানিয়ে দিয়েছেন আমেরিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ওয়েবসাইট ‘রিফাইনারি২৯’ কে।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা যিনি শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে আসছিলেন হঠাৎ যেন কাজের এক নতুন ধারার হদিস পেলেন। এক বন্ধুর পরামর্শে তৈরি করে ফেললেন নিজের ব্লগ ‘এক্সিডেন্টাল আইকন’ যেখানে তিনি বিভিন্ন ফ্যাশন আইডিয়াগুলোকে আর্কাইভ হিসেবে রাখতে চান। সকল বয়সের মানুষের কাছে পৌঁছাতে চান তিনি যাতে করে সকলে আরও বেশি ফ্যাশন সচেতন হয়ে উঠতে পারে।
তার ব্লগের নামকরণের আইডিয়াটাও বেশ চমকপ্রদ। মডেল হওয়ার পর ক্লাসে এবং পরিচিত মহলে সকলে তাকে ‘এক্সিডেন্টাল আইকন‘ বলে সম্বন্ধ করতে থাকে। তখনই তার মাথায় ধরে নামটি আর ব্লগের নাম দিয়ে দেন ‘এক্সিডেন্টাল আইকন’। নতুন নতুন ফ্যাশনের খবর, ফ্যাশন টিপস, ফ্যাশনের ধারণা এসব নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বয়সের ব্যাপারটিকে এড়িয়ে চলেন তিনি। খুব অস্বাভাবিকভাবে ২৫ থেকে ৩৫ বছরের ফলোয়ারের সংখ্যাই তার ব্লগে বেশি যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমেরিকার দৈনিক পত্রিকা ‘দি ডেনভের পোস্টে’র সাথে সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলছিলেন লিন, বয়সকে হার মানিয়ে যিনি এখন হাজারো মানুষের এক অনন্য আইকন।