একসময় ভাষা ছিলো না। মানুষ সাংকেতিকভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতো। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ভাষা এলো। মানুষের মুখের ভাষা ভাব প্রকাশের কতই না চমৎকার একটি মাধ্যম। আমরা কথা বলে আরেকজনের সাথে মনের ভেতরকার অবস্থা ব্যক্ত করতে পারি। কত ধরনের মাত্রা আছে মানুষের মুখের এ কথার। তাই আমরা কীভাবে কথা বলবো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা একই কথা নানাভাবে বলতে পারি। “তুমি কোথায় যাচ্ছো?” এই কথাটাই শুধুমাত্র বলার ধরনের উপর অর্থের পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আমরা অনেকেই নিজের জীবনে একটা অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছি। আর তা হলো, মানুষ আমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমরা সবাই চাই আমার কথাটি গুরুত্ব পাক। এই হীনম্মন্যতা থেকে বাঁচতে আমরা অনেক সময় সীমা অতিক্রম করে ফেলি। নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য আমরা অনেক সময় রাগারাগি করি, চিৎকার চেঁচামেচি করি, মারপিট করি। আমাদের এই আক্রমণাত্মক আচরণ আমাদের দুর্বলতারই পরিচয় বহন করে। এই জন্যই লেখক আইজাক আসিমভ বলেছেন,
“Violence is the last refuge of the incompetent.”
আবার অনেকসময় আমরা এই হীনম্মন্যতায় নিজেকে গুটিয়েও ফেলি। লোকজনকে এড়িয়ে চলি। যদিও কোনোটিই সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়। তাহলে আমাদের কী করা উচিত? কথার গুরুত্ব ঠিক রাখার জন্য প্রথমে সেসব জিনিস বাদ দেয়া উচিত, যা আমাদের কথাকে গুরুত্বহীন করে তোলে। জুলিয়ান ট্রেসার তার টেড টকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন এ সম্বন্ধে। সে দিকগুলো নিয়েই একে একে কথা বলা যাক।
পরনিন্দা ছেড়ে দিন
আমাদের কথা বলার অন্যতম একটি বিষয় হলো অপরের নিন্দা করা, সমালোচনা করা। কে কোনটা খেলো, কে কোনটা পরলো এসব নিয়ে কথা বলেই আমরা একধরনের বিকৃত আনন্দ পাই। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হলো যে অন্যের নামে আমার সামনে খারাপ বলছে, সে মানুষটাই আরেকজনের কাছে আমার নামে খারাপ বলবে। আমরা অবচেতন মনে এই সত্য জানি। ফলে যে লোকটি এমনভাবে অন্য কারো পরচর্চা করে, লোকের কাছে তার সম্মান এমনিতেই কমে যায়। তাই প্রথম শর্ত হলো- পরচর্চা ছেড়ে দিন। বলিউড তারকা শাহরুখ খান একবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,
“কখনও আরেকজনের জীবনকে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে নেই। এতে নিজেরই অপমান হয়। নিজের কাজ করো। নিজের ভুবনে ডুবে থাকো।”
না ভেবে, না বুঝে মানুষকে বিচার করবেন না
কাউকে আগে থেকে বিচার করে কোনোকিছু বলবেন না। মানে কাউকে একটি ছাঁচে ফেলে কথা বলবেন না। ‘সে তো কম বোঝে’ বা ‘সে গুরুত্বপূর্ণ না’- এভাবে ছাঁচে ফেলে কথা বলবেন না। কারণ যিনি আপনার কথা শুনছেন, তিনিও বুঝতে পারবেন আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফলে তিনিও আপনাকে গুরুত্ব নিয়ে শুনবেন না।
নেতিবাচকতা ও সবসময় অভিযোগের অভ্যাস পরিহার করুন
মানুষ নেতিবাচক কথা পছন্দ করে না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সব কথাই নেতিবাচকভাবে বলতে পছন্দ করে। কিন্তু এতে করে আপনার কথা ও আপনি- দুটোই মানুষের কাছে গুরুত্ব হারাবে। মানুষ সবসময় ইতিবাচক কথা শুনতে পছন্দ করে। যা কিছু তার জন্য ভালো, সেটার সংস্পর্শই মানুষ চায়। কেউ কেউ আছেন সব কিছুতেই অভিযোগ করেন। আবহাওয়া থেকে শুরু করে বড় কিছু, সবকিছুতেই অভিযোগ! এ ধরনের মানুষ থেকে সবাই দূরে থাকতে চায়। মানুষ তার পাশেই থাকতে চায়, যার উপর সে নির্ভর করতে পারে। তাই অভিযোগ পরিহার করুন। আপনার কথায় যেন মানুষ ভরসা খুঁজে পায়।
বাতুলতা পরিহার করুন
অনেকের স্বভাব আছে সব কিছুকেই বাড়িয়ে বলা। রংচঙ মাখিয়ে ভালোকে আরও ভালো, খারাপকে বেশি খারাপ বলা। এর ফলে আমাদের প্রকৃত সত্য থেকে সরে আসতে হয়। এভাবে যারা কথা বলে, তারা মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়। আর একজন মিথ্যাবাদী সবার প্রথমে মানুষের বিশ্বাস হারায়। ফলে আপনি যদি চান আপনার কথা মানুষের বিশ্বাসের জায়গা হোক, তাহলে প্রথমেই বাতুলতা পরিহার করুন।
অন্যের মতকে গুরুত্ব না দেয়া
আমরা যদি কথার মধ্যে নিজের মতামতকেই শুধু গুরুত্ব দিই, অন্যের মতের প্রতি সম্মান না দেখাই, আমাদের কথাও মানুষের কাছে গুরুত্ব হারাবে। সবাই আপনার কথার মাঝে নিজেকে দেখতে চায়। যদি চান আপনার মতামত গুরুত্ব পাক, তাহলে অন্যের মতকেও গুরুত্ব দিন।
কী করা উচিত না, তা তো জানলাম। এখন আমরা দেখি কীভাবে কথা বললে আপনার কথা সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
সততার সাথে কথা বলুন
আপনার সততা আপনার শ্রোতাকে প্রভাবিত করবে। সবাই আপনার ভেতরকার মানুষটাকে শুনতে চায়। আমাদের মধ্যে নানা কপটতার ফলে এই গুণ ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। তাই বলে কিছু সত্য কিন্তু বললে বিপদও হতে পারে। যেমন আপনি যদি আপনার প্রেমিকাকে বলেন, “তোমাকে আজকে জঘন্য লাগছে”, তাহলে হিতে বিপরীতও হতে পারে! তাই সততার সাথে কথা বলুন, কিন্তু সততাকে ঘিরে রাখবে ভালোবাসা ও সহনশীলতা। ভালোবাসা আর সহনশীলতা মেশানো সততা আপনাকে করে তুলবে সবার থেকে আলাদা।
নিজস্বতা বজায় রাখুন
আপনার নিজস্বতাই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। নিজের সত্যিকারের বিশ্বাস ধ্যান-ধারণা আপনার কথার মাধ্যমে প্রকাশ করুন। আরেকজনকে নকল করে কথা বলবেন না। এতে আপনার আত্মবিশ্বাসের অভাব হবে। আপনার নিজস্বতাই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। এটিই আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। আপনি হয়ে ওঠেন অনন্য।
কথা আর কাজে মিল রাখুন
একবার এক মা তার সন্তানকে হযরত ওমর (রা) এর কাছে নিয়ে আসেন। কারণ হলো তার ছেলে অধিক মিষ্টি খায় এবং হযরত ওমর (রা) যাতে ছেলেটিকে মিষ্টি কম খাওয়ার জন্য উপদেশ দেন। ওমর (রা) কোনো উপদেশ না দিয়ে তাদের এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেন। এক সপ্তাহ পরে আসলে তিনি ছেলেটিকে মিষ্টি কম খেতে উপদেশ দেন। তখন ছেলেটির মা বলেন, “আপনি তো এক সপ্তাহ আগেও এ উপদেশ দিতে পারতেন।” তখন ওমর বলেন, এক সপ্তাহ আগে তিনি নিজেও মিষ্টি বেশি খেতেন, তাই তিনি উপদেশ দেননি। এই এক সপ্তাহে তিনি মিষ্টি খাওয়া কমিয়েছেন, তারপর উপদেশ দিয়েছেন। এ ঘটনাটি থেকে আমাদের শেখার আছে। যে কাজ আমরা করি, তা নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন সে কথাটি অন্য একটি মাত্রা পায়। তাই আমাদের কথায় আর কাজে সবসময় মিল রাখা উচিত। এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যা আমরা নিজেরা পালন করি না।
মানুষের মঙ্গল কামনা করুন
মানুষের মঙ্গল কামনা করুন, ভালোবাসুন। তাহলে আপনার কথাতেও সে উষ্ণতা ও আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে। মনের ভেতর থেকেই সে বুঝতে পারবে আপনি তার শুভাকাঙ্ক্ষী। ফলে সে আপনার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠবে। আপনি ভালোবাসলে মানুষও আপনাকে ভালোবাসবে। আপনার কথাকেও ভালোবাসবে।
কন্ঠস্বরের দিকে খেয়াল রাখুন
আপনার কণ্ঠস্বর এক অমূল্য সম্পদ। আপনি এটা কীভাবে ব্যবহার করছেন, তার উপরও আপনার কথার গুরুত্ব নির্ভর করে। আমরা অনেকে কথা বলি নাক দিয়ে, যা শুনতে খারাপ শোনায়। অনেকে কথা বলি গলা থেকে। কিন্তু আমাদের কথা যখন বুকের ভেতর থেকে আসে, তখন কথা ভারি শোনায়। আর ভারি আওয়াজ সবসময় সবার দৃষ্টি কাড়ে। আপনার গলার স্বর কেমন শোনাচ্ছে, তা-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কথার মধ্যে ছন্দ রাখাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব কথা এক লয়ে বললে শুনতে একঘেয়ে লেগে যায়। কথার বিষয় অনুসারে আমরা বলার ধরন পাল্টিয়ে ফেলতে পারি। একই কথা বলার বিভিন্ন ধরনের উপর নির্ভর করে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আর কথা আমরা কতটুকু উচ্চস্বরে বলছি, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেকেই সবসময় উচ্চস্বরে কথা বলি। কিন্তু এটা ঠিক নয়। অবস্থা অনুযায়ী আমাদের কখনও উচ্চস্বরে, আবার কখনো নিম্নস্বরে কথা বলতে হবে। আর আরেকটি বিষয় আমরা ভুলে যাই, তা হলো নীরবতা। সবসময় কথা বলতে হবে, এমন কোনো কথাও নেই। কখনো নীরবতাও অনেক শক্তিশালী হতে পারে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সম্পর্কে যত সমস্যা হয় তা আমাদের কথা বলার উপরেই। আমরা যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বলতে পারি এবং কথা যদি একই মনোযোগের সাথে শোনা হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র কথার মাধ্যমেই হয়ে যাবে। আমাদের কথা বলার ভুলের কারণেই অনেক সময় আমাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বলা উচিত। এতে আমাদের জীবন আরও অনেক সহজ, সুন্দর ও সফল হবে।
ফিচার ইমেজ- news.fiu.edu