• আজ আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইব…বিবাহ হইব।
• লীলাবালি লীলাবালি ভর যুবতী সই গো কি দিয়া সাজাইমু তোরে…।
• হলুদ বাঁটো মেন্দি বাঁটো বাঁটো ফুলের মৌ…।
যখনি ‘বিয়ে’ শব্দটা মাথায় আসলো তখন থেকেই এই গানগুলো মনের রেডিওতে বেজে চলেছে। হ্যাঁ, এই বিয়ে, শাদি, বিবাহ বা ওয়েডিং যা-ই বলুন না কেন, তা আমাদের সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। বিয়ের অনুষ্ঠান পালনের রীতি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। এখনকার বিয়ের অনুষ্ঠানের অন্যতম মূল আকর্ষণ বা অবিচ্ছেদ্য অংশও বলা চলে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকে। আমাদের আজকের লেখাটিও সেই আনন্দমুখর ফটোগ্রাফিকে কেন্দ্র করেই।
সাধারণ কথায় বিয়েতে যে ফটোগ্রাফি করা হয় তা-ই হলো ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। অথবা এভাবেও বলা যায়, বিয়ের সাথে সম্পর্কিত কর্মসমূহের আলোকচিত্রই হলো ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। এর আবার নানা সময় ভাগ রয়েছে। এই যেমন প্রি-ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। এক্ষেত্রে ছবিগুলোকে ব্যবহার করা হয় দাওয়াত পত্র কিংবা প্রদর্শনীতে। এছাড়াও রয়েছে ওয়েডিং এবং পোস্ট-ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। এই ওয়েডিং ফটোগ্রাফি বাণিজ্যিক ফটোগ্রাফির এক অন্যতম শাখা।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফির সূচনা ফটোগ্রাফি প্রযুক্তি আবিষ্কারের সময় থেকেই, ১৮২৬ সালে জোসেফ নিস্ফোর নীপ্স-এর হাত ধরে। এর ঠিক ১৪ বছর পর ১৮৪০ সালে প্রিন্স আলবার্টের সাথে রানী ভিক্টোরিয়ার বিয়েতে আনন্দের বিষয় হিসেবে ক্যামেরা ব্যবহার এবং ফটোগ্রাফি করা হয়। যদিও ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রচলন অনেক পুরোনো, তবে আগেকার দিনে শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান রেকর্ডের জন্য ফটোগ্রাফার ভাড়া করে এখনকার মতো ফটোগ্রাফির প্রচলন ছিল না।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য যে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পোজ দিয়ে বিয়েতে ছবি তোলারও চল ছিল না। তবে হ্যাঁ, বিয়ের আগে বা পরে দম্পতি ভালো পোশাকে পোজ দিয়ে ফরমাল ছবি তোলার চল ছিল। ১৮৬০ সালের শেষের দিকে অনেক দম্পতিই বিয়ের পোশাকে পোজ দিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন। এমনকি ফটোগ্রাফারকে বিয়ে বাড়িতে ভাড়া করে আনার রীতিও দেখা যায়।
ফটোগ্রাফিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তখন অনেক ভারী হওয়ায় এবং পর্যাপ্ত আলোর প্রয়োজনে বিয়ের ফটোশুটগুলো তখন স্টুডিওতেই করা হত। বেশিরভাগ দম্পতি একটিমাত্র ছবি তুলতো তখন। ওয়েডিং অ্যালবামের সূচনা ঘটে ১৮৮০ সালের দিকে এবং তখন স্টুডিওতে ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠান চলার স্থানেই ফটোগ্রাফি করা শুরু হয়। ১৮৮৭ সালে ফ্ল্যাশ পাউডার আবিষ্কারের পর থেকে ছবি তোলার পর তা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হত এবং বিক্রিও করা হতো।
রঙিন ফটোগ্রাফির সূচনা হয় ২০ শতকে এসে। কিন্তু সেই সময়ে রঙিন ফটোগ্রাফি এতটাই ব্যয়বহুল ছিল যে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি তখনো সাদা-কালোই থেকে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয় ইভেন্টের ছবি তোলা। যদিও তখন ফটোগ্রাফির মান ততটা ভাল ছিল না, তবুও বিভিন্ন জায়গায় ওয়েডিং ফটোগ্রাফি একধরনের প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ফটোগ্রাফারদের মধ্যে। ১৯৭০ এর পর থেকে এটি আধুনিক হতে শুরু করে এবং সম্পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানই সংরক্ষণ করার চল আসে।
সেই ১৯ শতক থেকে ওয়েডিং ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে যে প্রথা মানা হয় তাকে বলা হয় ‘ট্রাডিশনাল ফটোগ্রাফি’। ফটোগ্রাফির এ ট্রাডিশনাল দিকটি হলো এমন যে কিছু পূর্বপরিকল্পিত পোজে এবং কিছু ইভেন্টের ছবি তোলা হয়। এখানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে ফটোগ্রাফারের হাতে। কিন্তু দেখা গেল সকলে এমন গৎবাঁধা পোজে ছবি তোলাকে পছন্দ করছে না, বরং সকলে সমসাময়িক বা নতুন কিছু চাইছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়‘ওয়েডিং বুম’ এবং ঠিক সেই সময়েই অনেকটা নাটকীয়ভাবে অনেকেই নিজস্ব স্টুডিও খোলেন। আবার এই সময়েই ‘ফটোজার্নালিজম’-এর সূচনা ঘটে। এটি এমন এক ধরনের সাংবাদিকতা যেখানে ছবির মাধ্যমেই ঘটনা বর্ণিত হয়। যদিও এর দ্বারা স্থির চিত্রকেই এখন বোঝানো হয়, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ভিডিও দ্বারাও প্রকাশ করা হয়। এ ধরনের ফটোগ্রাফিগুলো অনেকটা সৃজনশীলতার প্রকাশ বলা চলে।
এই ফটোজার্নালিজমের স্বর্ণালী যুগ বলা হয় ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ এর মাঝের সময়টাকে। তো এই নতুন ধরণটি যখন ওয়েডিং ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে পরিচিতি পেল, তখন যেন পালে নতুন হাওয়া এসে লাগল। এবং তখনই ফটোগ্রাফাররা বিয়ের ক্ষেত্রে এ ফটোজার্নালিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করল। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে সেই সময় যে ধারণাটা প্রবেশ করে সেটি ছিল অনেকটা এমন– “ফটোগ্রাফি মুদির দোকানের তাকে থাকা কোনো কৌটাজাত পণ্য নয়, বরং সেগুলো সত্যিকারের আবেগ এবং দৃশ্যমান আবহকে তুলে ধরবে।”
ফটোজার্নালিস্টিক ধরনের ফটোগ্রাফিতে ফটোগ্রাফারের যতটা সম্ভব কম নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং অকপট ছবি তোলা হয়। এক্ষেত্রে ছবি তোলা হয় দ্রুততার সাথে, পর্যাপ্ত আলো না থাকলে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে। ‘ওয়েডিং ফটোজার্নালিস্ট সংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে, যেটি ফটোজার্নালিস্টদের জন্য আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা। এ সংস্থাটি সকল ফটোজার্নালিস্টের মাঝে যোগাযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম বলা চলে। আরেক ধরনের ওয়েডিং ফটোগ্রাফি হলো সমসাময়িক বা ফ্যাশন ভিত্তিক ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। এ ধরনের ফটোগ্রাফিতে ইভেন্টের ক্যান্ডিড বা অকপট ছবির সাথে পোজ দেয়া ছবির মিলবন্ধন সৃষ্টি করা হয়। এ ফটোগ্রাফিতে ফটোগ্রাফারের ছবি তোলার পরবর্তী উদ্ভাবনী এবং চমকপ্রদ প্রতিভার প্রকাশ ঘটে।
আরো এক ধরণের ওয়েডিং ফটোগ্রাফির চল রয়েছে।এটি এশিয়ার দেশগুলোতে জনপ্রিয়, বিশেষ করে চীনে। সেটি হলো‘ওয়েডিং স্টুডিও ফটোগ্রাফি’। এক্ষেত্রে যা হয় তা হলো দম্পতিরা স্টুডিওর সাথে ইন-স্টুডিও বা লোকেশন ফটোশুটের জন্য যোগাযোগ করে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন মেক-আপ ও কেশবিন্যাস এবং কয়েকবার পোশাক পরিবর্তন করে ফ্যাশন ভিত্তিক ফটোগ্রাফির মতোই ছবি তোলা হয়। সবমিলিয়ে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি ছবির জগতের এক অভিনব আকর্ষণ।
এখন আসি ফটোগ্রাফি প্রযুক্তি নিয়ে। যখন ফিল্মের যুগ ছিল, তখন ফটোগ্রাফাররা রঙিন নেগেটিভ ফিল্ম এবং মিডিয়াম ফরম্যাটের ক্যামেরা ব্যবহার করাটাই পছন্দ করতেন। আর এখন প্রায় সকল ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে ডিজিটাল SLR ক্যামেরাব্যবহার করা হয়, কেননা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত আলোক শনাক্তকরণের মাধ্যমে যথাযথ ছবি তোলা এবং তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা সম্ভব। এখন কথা হলো ফটোগ্রাফারতো বিয়ের অনেক ছবিই তুললো, কিন্তু তা ডেলিভারি করেন ঠিক কোন উপায়ে? এক্ষেত্রেও রকমফের রয়েছে। তবে এর কোনোনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয় তা হলো ফটোগ্রাফার তার ক্লায়েন্টকে কিছু নমুনা দেখান অথবা অনলাইন গ্যালারী তৈরি করেন। ছবিগুলোতে অনেক সময় ওয়াটারমার্ক বা কোম্পানির লোগো থাকে। কোনো কোনো ফটোগ্রাফার নমুনাগুলো ক্লায়েন্টকে দেন। আবার অনেকে ক্লায়েন্টকে নমুনা থেকে পছন্দনীয় ছবিগুলোকে প্রিন্টের জন্য নির্বাচন করতে বলেন এবং এর জন্য আলাদা খরচ প্রদান করতে হয়।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে ফটো অ্যালবামও তৈরি করা হয়। এরও রকমফের রয়েছে- ট্রাডিশনাল, ডিজিটাল, শক্ত মলাটে বাঁধানো ইত্যাদি। অনেক ফটোগ্রাফার এই অ্যালবামের জন্য আগেই টাকা নেন, অনেকে আবার বিয়ের অনুষ্ঠানের পর আলাদাভাবে টাকা নিয়ে থাকেন।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণের জন্য উদ্যোক্তা ফটোগ্রাফারকে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি অর্থাৎ ডিজিটাল ক্যামেরা, এডিটিং সফটওয়্যার, কম্পিউটার, বিজনেস কার্ড, ওয়েবসাইট ইত্যাদি। এর পরেই আসে প্রচার। একজন ভাল ফটোগ্রাফারকে সকলে চেনে তার প্রচারের মাধ্যমেই। এই ডিজিটাল যুগে প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এছাড়াও বিয়ে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেও সেটি হতে পারে। চলতি সময়ে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। তবে শুধু অনেক টাকা আছে বলেই যারা এ পেশায় আসেন, তারা সাময়িকভাবে সফল হলেও সেটা টিকিয়ে রাখতে পারেন না। একজন ভালো ওয়েডিং ফটোগ্রাফারকে তার কাজে উৎসাহী হতে হবে এবং নিজের ভিতরে এমন একটি উদ্দীপনা কাজ করতে হবে যে ক্লায়েন্টের জীবনের অন্যতম একটি দিনের ভাগীদার তিনি।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ওয়েডিং ফটোগ্রাফি অনেক এগিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফির সাথে যুক্ত এমন ফটোগ্রাফারের সংখ্যা অগণিত, যদিও সকলে পেশাদার নন। অনেকে শখের বশেও ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করে থাকেন। বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন পেশা হিসেবে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকে বেছে নিচ্ছেন। একটা সময় ছিল যখন বিয়ে ছিল কেবলই পারিবারিক অনুষ্ঠান। এখন সেই বিয়ের অনুষ্ঠানকে সামাজিক ইভেন্ট বলা হয়। আর সেই ইভেন্টকে স্মরণীয় করে রাখতে সকলেই উন্মুখ। এখনকার ওয়েডিং ফটোগ্রাফাররাও তাদের বিভিন্ন প্যাকেজগুলোকে ক্লায়েন্টদের আগ্রহের মাত্রা অনুযায়ী সাজিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে আছে বিভিন্ন অংশ; যেমন- গায়ে হলুদ, বিয়ে ও বৌভাত। এছাড়াও আজকাল মেহেদি সন্ধ্যা, ব্যাচলর’স নাইটের মতো আরও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিক থেকে বলতে গেলে বাংলাদেশের ওয়েডিং ফটোগ্রাফাররা অনেক বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ পান অন্যান্য দেশের ফটোগ্রাফারদের তুলনায়।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফি পেশার জগতে এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আগ্রহী ফটোগ্রাফাররা খুব সহজেই এই ক্ষেত্রটিতে নিজেদের সৃজনশীলতা প্রকাশের পাশাপাশি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডও গড়ে উঠছে এদেশে। Dream waver, Bibahagraphy, Wedding diary সহ আরও নানা প্রতিষ্ঠান এখন রয়েছে। আজকাল বাংলাদেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এর অনেক ট্রেনিং সেন্টারও গড়ে উঠেছে। প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের পাশাপাশি প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে এ পেশায় নিজেকে গড়ে পারেন যে কেউ।