গোসল, খাবারদাবার, ধোয়ামোছা- পানি ছাড়া এসব কোনোকিছুই কি ভাবা সম্ভব? পানিই তো জীবন। অথচ র্যাচেলের বেলায় এই পানিই জ্বলজ্যান্ত মৃত্যুর মতো। বলছিলাম র্যাচেল ওয়ারউইকের কথা। প্রতিদিন সকালবেলা যেখানে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান না করলে আমাদের চলে না, সেখানে অনেক কষ্টে একটু পানি ঢোক করে গিলে নেন র্যাচেল। একটু একটু করে লালচে দাগ রেখে গলার ভেতরে চলে যায় সেই পানি। বুঝতে পারেন র্যাচেল, কষ্ট পান। কিন্তু কিছুই করার নেই। পানি একেবারে না পান করে কি থাকা যায়? অথচ এই পানিই র্যাচেলের জন্য বিষের সমান।
অন্যরা যেখানে গরমের দিনে একটু পানির জন্য হাহাকার করে, চায় সোজা বাড়ি ঢুকেই গোসলটা সেরে নিতে, বৃষ্টির দিনে ভিজতে, র্যাচেল সেখানে চুপ করে বসে থাকেন বাড়ির মধ্যে। কেবল পানি নয়, নিজের শরীরের ঘামটুকুও তার জন্য যন্ত্রণা কেবল। পানি, ঘাম বা তরল কিছু র্যাচেলের ত্বকের স্পর্শ পেলেই সেখানে র্যাশ উঠে যায়, দাগ সৃষ্টি হয় আর যন্ত্রণা শুরু হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য এই অ্যালার্জি থাকে র্যাচেলের শরীরে। সে সময় প্রচণ্ড অবসন্ন হয়ে পড়েন র্যাচেল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটাও থাকে না তার। কান্না আসে। কিন্তু কাঁদলেও যে গাল ভিজে যাবে। তাই কাঁদতেও পারেন না তিনি।
প্রচণ্ড কষ্টের এই সমস্যার নাম অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া। এই রোগে আক্রান্তদের ত্বক পানির সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে ছত্রাকে ভর্তি হয়ে যায়। কাঁটা কাঁটা কিছু একটার উপস্থিতি পাওয়া যায়। সেইসাথে শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ তো আছেই। সাধারণত নারীদের ক্ষেত্রে এই অ্যালার্জি বেশি দেখতে পাওয়া যায়। বয়ঃসন্ধিকালে সমস্যাগুলো জন্ম নিতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন প্রথমে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া নিয়ে। পরে বুঝতে পারেন তারা, এটি আমরা সচরাচর যে অ্যালার্জি দেখি, তেমন কিছুই নয়। অনেকের বিভিন্ন খাবার খেলে, যেমন- বাদাম, চিংড়ি মাছ বা বেগুন ইত্যাদি খেলে শরীরে অ্যালার্জি দেখা দেয়। এ ব্যাপারে আমরা সবাই-ই জানি। তবে বাইরের কোনো উপাদান নয়, অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া তৈরি হয় শরীরের প্রতিষেধক ক্ষমতা থেকেই।
কীভাবে সেটা হয়? এ নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত আছে। কারো মতে, শরীরের উপরের স্তরে অনেক ময়লা, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি জমে থাকে। তাই পানির স্পর্শ পেলেই সেগুলো ত্বকের ভেতরে চলে যায় আর ত্বক তার প্রতিক্রিয়া জানায় অ্যালার্জির মাধ্যমে। আবার অনেকে বলেন, পানির সংস্পর্শে আসলে এই রাসায়নিক পদার্থগুলো ক্ষতিকারক রাসায়নিক রূপ ধারণ করে এবং চামড়ায় অ্যালার্জির দাগ দেখা দেয়। মূল কথা হলো, এখন পর্যন্ত কেউই এই রোগের আসল কারণ কিংবা প্রতিকার বের করতে পারেননি। র্যাচেলও একই রোগে আক্রান্ত। তবে তার ক্ষেত্রে প্রকোপটা অনেক বেশি। আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, র্যাচেল তাহলে বেঁচে থাকে কীভাবে?
সাধারণত, মানুষের শরীরের শতকরা ৬০ শতাংশ পানি। ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের শরীরে অন্তত ৪০ শতাংশ পানি থাকে। তাই মানুষ পানি না পান করলে শুরুতেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়বে এমন না। তবে ধীরে ধীরে একসময় মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে আপনাকে পানি না পান করার মতো ছোট্ট কাজটি। শুধু তা-ই নয়, মৃত্যুর চাইতেও বড় যে সমস্যা তৈরি করে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া, সেটি হলো মানসিক অসুস্থতা। একটু একটু করে উদ্বিগ্নতা আর অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয় রোগটি মানুষকে, তৈরি হয় হতাশা। একবার অ্যালার্জির প্রভাব শেষ হতে না হতেই অপেক্ষা শুরু হয় পরের আঘাতের। জার্মানিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর অ্যালার্জির প্রতিষ্ঠাতা মার্কাস মাউরের জানান, তার দেখা এমন অনেক মানুষ আছে, যারা ৪০ বছর ধরে এই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া ত্বকের সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড় অসুখ মনে করেন তিনি অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়াকে।
১২ বছর বয়সে র্যাচেলের শরীরে ধরা পড়ে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া। র্যাচেল সেবার পানিতে সাঁতার কেটে মাত্র উঠেছেন। গায়ে কেমন যেন লাল লাল দাগ দেখা গেলো। পরবর্তীতে চিকিৎসকের কাছে গেলে জানা যায়, তার অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খানিক পরীক্ষার পর চিকিৎসক নিশ্চিত হলেন, তার সন্দেহই সত্যি। তারপর থেকেই শুরু। রোগ নিয়ে এক কিংবা দু’দিন নয়, প্রতিটি দিন সাবধানে কাটাতে হয় র্যাচেলের।
প্রতিদিন বাইরের আকাশ দেখে তারপর বের হন র্যাচেল। বৃষ্টির দিনে বেরুতে পারেন না। সারাদিনের পানি সংক্রান্ত সব কাজ র্যাচেলের স্বামীই সামলে নেন। খুব হালকা কাপড় পড়েন র্যাচেল। শরীরচর্চা করেন না। তাতে করে ঘাম কম হয়। সপ্তাহে একবার গোসল করেন তিনি। আর পানীয়ের মধ্যে দুধ পান করতে পারেন অনেকটা। দুধ পান করলে পানির মতন মারাত্মক প্রভাব পড়ে না র্যাচেলের শরীরে। কেন? চিকিৎসকেরা সেটাও জানেন না।
অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়াকে দমানোর একমাত্র উপায় অ্যান্টি-হিস্টামিনের ওষুধ গ্রহণ করা। হিস্টামিন আমাদের শরীরের জন্য ভালো। সাধারণত আমাদের ত্বকে থাকা প্রতিষেধক কোষ, মাস্ট কোষ এই হিস্টামিন প্রোটিন নিঃসরণ করে। এটি রক্তপ্রবাহকে সচল রাখতে এবং শরীরে শ্বেতকণিকাকে কার্যকর করতে সাহায্য করে। তবে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়ার ক্ষেত্রে হিস্টামিন হয়ে পড়ে মারাত্মক ক্ষতিকারক উপাদান। তখন এর কারণেই তরলের পরিমাণ বেড়ে যায় আর চারপাশের চামড়া ফুলে যায়। একইসাথে হিস্টামিন আমাদের শরীর চুলকানি সৃষ্টি করে।
র্যাচেলের ক্ষেত্রে অবশ্য এটি কোনো কাজই করেনি। ২০১৪ সালে র্যাচেলকে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর অ্যালার্জিতে নিয়ে যাওয়া হয় আর বড় এক ডোজ অ্যান্টি হিস্টামিন দেওয়া হয়। এরপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় পানিতে। কোনো কাজই করেনি সেবার এই ওষুধটি র্যাচেলের ক্ষেত্রে। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপরও এটিই ছিল চিকিৎসকেদের একমাত্র আশার নাম। অবশেষে ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর অ্যালার্জির চিকিৎসকেরা মাস্ট কোষকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন। স্বাভাবিক মানুষের মতোই মাস্ট কোষ থাকে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যেও। তাহলে তাদের কোষ কেন অন্যরকম আচরণ করে দরকারের সময়? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘আইজিই’-এর নাম খুঁজে পান চিকিৎসকেরা। আইজিই-কে অ্যালার্জির মূল কারণ বলে মনে করা হয়। আর বাইরে থেকে আসা কোনো উপাদান নয়, নিজেদের মধ্যেই এই আইজিই তৈরি করে অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়ায় আক্রান্তদের মাস্ট কোষেরা।
২০০৯ সালে প্রাথমিক চিকিৎসা (ওমালিজুমাব) শুরু করা হয় ৪৮ বছর বয়স্ক এক নারীর উপরে। আইজিই-এর প্রভাব দূর করতে পারে এমন ওষুধ দেওয়া হয় তাকে আর এক সপ্তাহের মধ্যে অনেকটা দূর হয়ে যায় তার অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়ার সমস্যা। এক মাস পরে পুরো রোগটাই একেবারে হাওয়া! তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়ার জন্য অ্যাজমার ওষুধ ব্যবহার করা। সেইসাথে কিছুদিন বাদেই বাজার থেকে এই ওষুধ উঠে যাওয়ার ভয় আছে। ফলে অনেকেই এখনো ওষুধ ব্যবহার করতে পারছেন না। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি ২৩০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র একজন অ্যাকুয়াজেনিক আরটিকারিয়াতে আক্রান্ত। সারা পৃথিবীতে এ রোগে আক্রান্ত মানুষ আছেন মোট ৩২ জন। আর এই ৩২ জনের মধ্যে র্যাচেল একজন। পারবেন তো র্যাচেল নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে আবার? চিকিৎসকেরা তো আশাবাদী। বাকিটা নাহয় ভবিষ্যৎ বলে দেবে!
ফিচার ইমেজ- Minds of Malady