পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মা-বাবার সাথে সন্তানদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে আমাদের বাঙালিদের প্রায়ই হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে মা যেন এক চিরকালীন আত্মত্যাগী নারীর পরিচায়ক আর অন্যদিকে বাবা যুগ যুগান্তরে এক ভয়ংকর, বদমেজাজি এক পুরুষ। বাঙালি পরিবার একটি একক সত্ত্বা হিসেবে একই সমতলে আসতে পেরেছে, এরকম নজির খুব বেশি নেই। তবে ইদানিং এ ধারা পাল্টে যেতে শুরু করছে। বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে পজিটিভ প্যারেন্টিং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পজিটিভ থাকতে পারছে না। প্যারেন্টিংয়ের ইতিবাচকতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা-বাবা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনছে।
অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা তাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবা সন্তানের সাথে কী ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, দু’পক্ষের পারস্পরিক বোঝাপড়া কতটা ইতিবাচক ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সন্তানরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কতটা আত্মবিশ্বাসী হবে এবং মানুষের সাথে মেলামেশায় কতটা উদারপন্থী আচরণ করবে। সমকালীন বাস্তবতায় যারা মা-বাবা হচ্ছেন বা হয়েছেন, তারা সাধারণত বাচ্চাদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে চিৎকার, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছেন। পজিটিভ প্যারেন্টিংয়ের চ্যালেঞ্জগুলো এবং কীভাবে এটি সন্তানদের জীবনের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে কাল হয়ে দাঁড়ায়, সেসব নিয়েই এ আলোচনা।
সন্তানের নিজস্ব জীবনে ব্যর্থতা
পজিটিভ প্যারেন্টিং কখনও কখনও এর সীমারেখা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। মা-বাবা সন্তানদের নিরন্তর উৎসাহ দিতে গিয়ে কখনও কখনও এতটাই নিমগ্ন হয়ে যান যে তারা এটা ভুলে যান, তারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন না। শিশুরা ছোটবেলা থেকে নিজেদের ভুলগুলোকে দেখতে না শিখলে, নিজেদের ব্যর্থতাকে বুঝতে না পারলে, নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলে পরবর্তী জীবনে এটি তাদের জন্য গুরুতর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ কখনোই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। শৈশবকাল থেকেই একজন সন্তানকে তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া, ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেওয়ার শিক্ষা দেওয়া মা-বাবার একান্ত দায়িত্ব।
মা-বাবা হিসেবে কারও ধারণা এতটাই চরমে পৌঁছে যায় যে তারা হাজার কষ্টসত্ত্বেও নিজেদের মন খারাপ, দুশ্চিন্তা, অবসাদ ইত্যাদি সন্তানদের সামনে প্রকাশ তো করেনই না, বরং সবসময় হাসিমুখ করে থাকেন। তারা ভেবে থাকেন, নিজেদের নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর বহিঃপ্রকাশ সন্তানদের জন্য হয়তো মঙ্গলজনক কিছু হবে না। বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে এমন হওয়া উচিত নয়। সন্তানদের কাছে নিজেদের জীবনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, ভুল-ত্রুটি ইত্যাদির খোলামেলা আলোচনা সন্তানদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা প্রদান করে; প্রত্যেকের জীবন আক্ষরিক অর্থেই সাফল্য-ব্যর্থতার সমষ্টি। অভিভাবকদের ভুল, দুর্বলতা, সংগ্রাম, কষ্ট, আক্ষেপ, বিষণ্ণতা সন্তানদেরকে জীবনের সামগ্রিকতা সম্পর্কে বার্তা প্রদান করে। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের অজান্তেই নিজের জীবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বুঝে নিতে সচেষ্ট হয়।
এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সন্তানের বয়স অনুযায়ী তাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে হবে। সন্তানের বয়স একেবারেই কম হলে মা-বাবার উচিত হবে না তার সামনে নিজেদের নেতিবাচক অনুভূতি খুব প্রগাঢ়ভাবে প্রকাশ করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার প্রতি শিশু বয়সের অতি কোমলতা, আদুরে মনোভাব বজায় রাখাটাও উচিত হবে না, কেননা তাতে করে পৃথিবীর বাস্তবতা সম্পর্কে সে সচেতন হতে পারবে না। আরও উল্লেখ করা দরকার যে, যেসব নারী সাংসারিক জীবনে নিজেদেরকে পরিবারের জন্য পুরোপুরিভাবে উৎসর্গ করে থাকেন, তারা নিজেদের ব্যক্তিজীবনে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসন্তুষ্টিতে ভুগে থাকেন ক্লান্তির জন্য। মায়েদের এহেন ভূমিকাকে গবেষণার ভাষায় বলা হয়ে থাকে অদৃশ্য পরিশ্রম। অর্থাৎ পজিটিভ প্যারেন্টিং শুধু সন্তানের জন্যই নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে মায়ের জন্যও অত্যন্ত নেতিবাচক পরিণাম বয়ে আনতে পারে।
মা-বাবাদের যত্ন-আত্তি
মা-বাবার জীবনের নানা বিষয়াদি সন্তান প্রতিপালনের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। অভিভাবকরা কোন সংস্কৃতিতে বাস করছেন, তাদের কর্মক্ষেত্র, আর্থিক স্বচ্ছলতা, ব্যক্তিজীবনের মানসিক চাপ, হতাশা ইত্যাদি নানা কিছু থেকে প্রাপ্ত বাধা পার করে পজিটিভ প্যারেন্টিং সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। নানা নেতিবাচক ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সন্তানদের সাথে একটি সুস্থ, ইতিবাচক, নির্ভরশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সেটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া বাবা-মায়েদের জন্যও অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। পজিটিভ প্যারেন্টিংয়ের দোহাই দিয়ে বার বার বাবা-মাকে যখন তাদের ভুলগুলো মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তখন এটি তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ অবস্থা বিবেচনায় পজিটিভ প্যারেন্টিং মা-বাবার জন্য ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়।
সার্বক্ষণিক প্রশংসা
একটা সময় ছিল, যখন অথরিটারিয়ান (কর্তৃত্ববাদী) প্যারেন্টিং অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। অর্থাৎ, সন্তানের জীবনে মা-বাবা সর্বদাই শাসনকারীর ভূমিকা পালন করতেন। পরামর্শ, আদেশ, নিষেধ, শাস্তি ইত্যাদির মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠত। এরপর একটা পর্যায়ে এলো পারমিসিভ (অনুমোদন) প্যারেন্টিং। প্যারেন্টিংয়ের এই ধারাটির তুমুল জনপ্রিয়তার কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। লাগামহীনভাবে ছেলে-মেয়েকে সকল বিষয়ে উৎসাহ প্রদান প্রকারান্তরে তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তুমুল প্রশংসা সমালোচনার প্রতি শিশুকে অত্যন্ত দুর্বল করে দেয়।
নির্দিষ্ট বয়সের পর শিশু বাস্তব পৃথিবীর মুখোমুখি হবে, যেখানে সবাই স্বাভাবিকভাবেই তার শুভাকাঙ্ক্ষী হবেন না। বয়সের সাথে সাথে তাকে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে, যখন সে নিজের ভুল, ব্যর্থতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত কথা শুনবে। শৈশবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশংসা পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাস্তব পৃথিবীতে সন্তান নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। তাহলে সমাধানটা কী? অথরিটারিয়ান এবং পারমিসিভ প্যারেন্টিং, দুটিই কি তবে বর্জনীয়?
গবেষণা অনুযায়ী নেতিবাচক মন্তব্যের (সন্তানের ভুল সম্পর্কে) তুলনায় ইতিবাচক মন্তব্য যদি চারগুণ বেশি প্রদান করা যায়, তবে সেটি হতে পারে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। এখানে খেয়াল রাখা দরকার যে, নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় মন্তব্য অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে। অর্থাৎ, সন্তানের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে সত্যিই সে প্রশংসার যোগ্য দাবিদার, এমন পরিস্থিতিতে তার প্রতি যথার্থ মন্তব্য পোষণ করতে হবে। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য নেতিবাচক মন্তব্যের ক্ষেত্রেও। অযথা শাসন কিংবা বকাঝকা নয়, বরং তার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই, সচেতন করার উদ্দেশ্যেই তাকে নেতিবাচক মন্তব্য প্রদান করতে হবে। মানসিক বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যদি তুলনামূলকভাবে সমালোচনার চেয়ে প্রশংসার পরিমাণ বেশি থাকে, তবে সেটি সন্তানের পরবর্তী জীবনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে।
সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রত্যেক অভিভাবকের একান্ত স্বপ্ন। কিছু ক্ষেত্রে বাবা-মা সন্তানের প্রতি অতি দুর্বল হয়ে তাদেরকে শুধু আদর আর মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রাখেন এবং সন্তানের যেকোনো কাজ, আচরণকেই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন। অন্যদিকে কিছু বাবা-মা শাসন আর নিয়মের মাঝে সন্তানকে আবদ্ধ করে রাখেন। মূলত দু’পক্ষই অনুভূতির প্রেক্ষাপটে একপ্রকার চরমপন্থী। মানুষের সর্বোত্তম বিকাশে অতি ইতিবাচকতা কিংবা চরম নেতিবাচকতা দুটোই ক্ষতিকর।
ইতিবাচক অনুভূতি (আদর, যত্ন, আলিঙ্গন, উৎসাহ, ভালোবাসা) সন্তানকে মানুষ হিসেবে আন্তরিক, মিশুক, আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। অন্যদিকে নেতিবাচক অনুভূতি (শাসন, বকা, ভর্ৎসনা) তার চিন্তন দক্ষতা, পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাবা-মায়ের আদর-শাসনে গড়ে উঠুক প্রতিটি সন্তান- একজন সম্ভাবনাময় মানুষ হিসেবে।