“আমি এমন একটি লোকের প্রেমে পড়েছি, যে একদম পারফেক্ট, শুধু একটি বিষয় ছাড়া: তার সাথে আমার বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা নেই। সে ভীষণ ভালো, আমার অনেক যত্ন নেয়, এবং সবকিছু যা একজন মানুষ চাইতে পারে। কিন্তু হৃদয়ের গহীনে কোনো একটা জায়গায়, আমি তাকে বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমাদের সম্পর্ক একদিন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে। তার পরিবার কর্মজীবী শ্রেণির, আর আমার পরিবার ধনী ও শিক্ষিত। সে মোটেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, এখন যে কাজ সে করছে, সেটিই সারাজীবন করে যেতে চায়।
কিন্তু আমি চাই পৃথিবীর বুকে নিজের চিহ্ন ছেড়ে যেতে। আমি খুবই দ্বিধার মধ্যে আছি। আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি, এবং তার সাথে সুখেই আছি। কিন্তু তারপরও মনে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে: এমন কারো সাথে কি জীবনে পরিপূর্ণতা লাভ করা যায়, যার সাথে আপনি অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজন বোধ করছেন? এই বিভাজনকে অতিক্রম করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?”
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত WBUR 90.9 রেডিও চ্যানেলে ঠিক এমনই একটি প্রশ্ন করেছিলেন এক নারী শ্রোতা। অনেকের কাছেই তার কথাকে অনেকটা বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো মনে হতে পারে, যেখানে নায়িকা উচ্চশিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবার থেকে আগত, অন্যদিকে নায়ক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ বাংলা সিনেমায় আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সম্পর্ক তৈরির পথে যে দ্বান্দ্বিক সংঘাতের চিত্র দেখতে পাই, এটিকেও সেটিরই একটি প্রতিচ্ছবি মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে চলুন, এত সহজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে না গিয়ে, একটু তলিয়ে ভাবি। বাংলা সিনেমায় আমরা কী দেখি? সেখানে আমরা দেখতে পাই, চৌধুরী সাহেব তথা নায়িকার বাবা নায়ক-নায়িকার প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং তার কাছে নিজেকে প্রমাণ করাই নায়কের সামনে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নায়ক-নায়িকা একবার পরস্পরের প্রেমে পড়ার পর কিন্তু তাদের মনে আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। অর্থনৈতিক ব্যবধান ব্যতিরেকে আর সকল ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থান বিরাজ করছে। তাই একবার সেই অর্থনৈতিক ব্যবধানটি ঘুচে গেলেই নায়ক-নায়িকার ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ হতে আর কোনো বাধা থাকছে না।
কিন্তু আমরা শুরু করেছি যে নারীর বক্তব্য দিয়ে, তার কাছে কিন্তু অর্থনৈতিক বিভাজনের চেয়েও আরেকটি বিভাজন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সেটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের সিনেমায় এই বিভাজনটির উপর কখনোই সেভাবে আলোকপাত করা হয়নি। এবং সামগ্রিকভাবেও, আমাদের দেশের মানুষ এতদিন এই বিষয়টি নিয়ে খুব কমই ভেবেছে। কারণ ‘সম্পর্ক’ ধারণাটি নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ সুদূরপ্রসারী চিন্তা কখনোই সেভাবে করেনি।
তারা ভেবেছে, দুজন মানুষের মনের মিল হলেই বুঝি সম্পর্ক চিরদিনের, চিরকালের হয়ে যায়। সম্পর্ক যে কোনো স্প্রিন্ট নয়, এটি একটি ম্যারাথন, এবং দীর্ঘদিন ধরে দু’জন মানুষ একত্রে থাকতে গেলে তাদের মাঝে নানা ধরনের বিভাজনেরই উৎপাত দেখা দিতে পারে, এ বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে তেমন একটা আলোচনা বা চর্চা হয়নি। তাই যখনই আপাতসুন্দর একটি সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটেছে, সবাই বলেছে জগতে ‘ট্রু লাভ’ বলে নাকি কিছু নেই।
আশাজাগানিয়া বিষয় হলো, দেরিতে হলেও আমাদের দেশের মানুষ মুদ্রার উল্টো দিকটাও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। তারা এখন ভাবতে শুরু করেছে, একটি সম্পর্কে তথাকথিত প্রেমই কি সব, নাকি সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক সহাবস্থানেরও গুরুত্ব রয়েছে? শুধু ভালোবাসার মধুর আলাপ করেই কি গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়, নাকি সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, কিংবা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, অথবা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মতো গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন?
এই প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ ও তর্কসাপেক্ষ। তাই শুরুতেই সেদিকে না যাই। বরং আমরা বোঝার চেষ্টা করি, সম্পর্ক কী। তাহলে সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সহাবস্থান ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসতে পারে, যেগুলো নিয়ে এখনো সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না।
সম্পর্কের অবশ্যই নানারকম শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। তবে আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব কেবল নারী-পুরুষের রোমান্টিক বা প্রণয়মূলক সম্পর্কে। এ ধরনের সম্পর্কও, অন্য আর সব সম্পর্কের মতো, সৃষ্টি হয় দু’জন মানুষের মধ্যকার সমতার উপর ভিত্তি করে। বলা যেতে পারে দু’জন মানুষের মধ্যকার এই সমতার মিলনই হলো সম্পর্ক; এবং তা হতে পারে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে, কিংবা সেটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সমতাগুলো কী কী। সম্পর্কে অর্থনৈতিক সমতা জরুরি কি না, সেটি যেহেতু ইতোমধ্যেই বহুলচর্চিত একটি বিষয়, তাই আমরা সেটিকে বাদ দিতে পারি। এর বাইরেও সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে চার ধরনের সমতার কথা উল্লেখ করেছেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেগুলোর ব্যাপারে।
আবেগিক সমতা
এটিকে বলা যেতে পারে যেকোনো সম্পর্কের আদিমতম ভিত্তি। আমরা প্রায়সময়ই শুনে থাকি, ভালোবাসা কোনো যুক্তির ধার ধারে না। ভালোবাসার এই অযৌক্তিক দিকটির উৎসারণ ঘটে আবেগের কারণে। আবেগের বশবর্তী হয়েই একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবেসে ফেলে, এবং তার কাছে মনে হতে পারে ওই মানুষটি ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। যেহেতু আবেগ প্রাথমিকভাবে অযৌক্তিক হয়ে থাকে, সে কারণেই পরস্পর সাযুজ্যহীন, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুইজন মানুষ প্রথম দেখাতেই একে অপরকে ভালোবেসে ফেলতে পারে, কিংবা যেকোনো একজনের দিক থেকেও সেই ভালোবাসার উৎপত্তি ঘটতে পারে, পরে যা অপরজনের মধ্যে সংক্রমিত হয়।
শারীরিক সমতা
অন্যান্য সম্পর্কে শারীরিক আকর্ষণ গুরুত্বহীন হলেও, প্রণয়মূলক সম্পর্কের একটি বড় জায়গাজুড়ে থাকে শারীরিক আকর্ষণ— এটিকে চাইলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। মনের মিলন হলো আবেগিক ব্যাপার, কিন্তু সেটিকে আরো শক্ত কাঠামো প্রদান করে শারীরিক মিলন। জৈবিক চাহিদা থেকেই নারী ও পুরুষ শারীরিকভাবে মিলিত হয়। তাই সম্পর্ক অনেকাংশে শারীরিক সমতার উপরও নির্ভরশীল হয়ে থাকে, এবং এই সমতার ক্ষেত্রে ‘শারীরিক সৌন্দর্য’ একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অবশ্য সৌন্দর্যের মূল্যায়ক দর্শকের চোখ, এবং সৌন্দর্যের প্রশ্নে প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা পছন্দ ও অভিরুচি বিদ্যমান, যার উপর ভিত্তি করে সে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা
শুধু আবেগিক ও শারীরিক সমতাই যথেষ্ট নয় সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করতে। কারণ অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই আবেগ যেমন ক্ষণস্থায়ী একটি ব্যাপার, শারীরিক আকর্ষণও সর্বদা বিদ্যমান নয়। কিন্তু জীবনে চলার পথে একজন মানুষকে প্রতিনিয়তই তার বুদ্ধিবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। সে যা করে, যা বলে, কিংবা যা করে না, যা বলে না, সেগুলো সবই তার বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিফলন ঘটায়। তাই পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ দুজন মানুষের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সমতাও জরুরি। এই সমতা হতে পারে দু’জনের একই ধরনের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত।
আবার এই বিষয়গুলোতে ভিন্নতা থাকলেও, পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আবশ্যক। দু’জন মানুষের চিন্তাভাবনা সবসময় একই খাতে প্রবাহিত হবে এমন আশা করা বোকামি, তবে দুজন মানুষ সব বিষয় না হলেও, অধিকাংশ বিষয়ে পরস্পরের সাথে আলাপ ও ধারণা বিনিময় করে মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে— এমনটিও বুদ্ধিবৃত্তিক সমতায় কাম্য। সবসময়ই যদি এমন হয় যে একজন তার পছন্দের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে অন্যজন তাতে পর্যাপ্ত আগ্রহ, কিংবা প্রত্যাশিত মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, সেটি ওই ব্যক্তির জন্য বড় ধরনের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শাশ্বত সমতা
আগের তিনটি সমতার গুরুত্বকে কোনোভাবেই ছোট করা হচ্ছে না, কিন্তু একটি সম্পর্কে আরো একটি সমতাও খুবই প্রয়োজন, যেটি ওই সম্পর্ককে একদম ভিন্ন একটি মাত্রায় নিয়ে যায়। এই সমতাটি হলো শাশ্বত সমতা। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কী এই শাশ্বত সমতা? শুধু পরস্পরকে চিরদিন ভালোবেসে যাওয়াতেই সেটি সীমাবদ্ধ নয়। বরং দু’জন মানুষের জীবন থেকে অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা, এবং জীবনে অভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর স্পৃহাও ভাগাভাগি করে নেয়া। এটিকে আত্মিক সমতাও বলা যেতে পারে।
আরেকটু সহজ করে বলা যাক। আজ থেকে তিন দশক পর একটি দম্পতি নিজেদেরকে কোথায় দেখতে চায়? এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। হয়তো ছোটখাটো কিছু ভিন্নতা থাকবেই। কিন্তু স্থূলভাবে দুজনের প্রায় অভিন্ন লক্ষ্যই থাকা আবশ্যক। যদি একজন খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়, আরেকজন ‘যেমন আছি তেমন’ থাকাকেই প্রাধান্য দেয়, তাহলে তাদের মানসিকতায় খুব বড় রকমের একটি ব্যবধান থেকে যায়। এই ব্যবধানকে পাশে ফেলে রেখে পাশাপাশি থাকা যায় বটে, এমন অনেক দৃষ্টান্তও রয়েছে, কিন্তু সেই সম্পর্কে ঘুণ ধরার, কিংবা সম্পর্কটি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
অথচ যদি জীবনে চলার পথে একটি দম্পতির একই ‘ভিশন’ ও ‘মিশন’ থাকে, সেক্ষেত্রে তারা বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলোর সাথে আপোষ করে, কিছুটা ছাড় দিয়েও একসাথে থাকতে পারে; এবং সময়ের সাথে সাথে, দীর্ঘদিন ধরে একে অন্যকে জানা ও বোঝার মাধ্যমে, সেই অসঙ্গতিগুলোর তীব্রতাও কমিয়ে আনতে পারে।
সুতরাং আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আবেগিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমতার পাশাপাশি, একটি দম্পতির এমন কোনো একটি ‘কারণ’ দরকার, যেজন্য তারা চিরদিন একসাথে থাকবে। তাই যেকোনো দম্পতির কর্তব্য হলো, “আমাদের ভেতর এই বিষয়গুলোতে মিল নেই, তাহলে কি আমরা একসাথে থাকব না?” জাতীয় প্রশ্নের বদলে,“আমরা কী কারণে সারাজীবন একসাথে থাকব?” এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
সম্পর্ক এমন একটি জিনিস, যেটি ভাঙার জন্য হাজারটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সেটি টিকিয়ে রাখতে একটি কারণই যথেষ্ট। এখন আপনাকে দেখতে হবে, আপনার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ রয়েছে কি না।
জীবনের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/