বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফুয়াদ ও রাকিব একই ফ্রেন্ড সার্কেলের অংশ। কিন্তু তারপরও কোনো এক বিচিত্র কারণে, তাদের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা নেই। ফুয়াদের প্রায়ই মনে হয়, রাকিব তাকে সহ্য করতে পারে না। অথচ এর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ সে খুঁজে পায়নি।
বন্ধুবৎসল স্বভাবের ফুয়াদ বেশ কয়েকবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চেষ্টা করেছে রাকিবের সাথে একটি উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার। যখনই রাকিবের কোনো দরকার হয়েছে, সে চেয়েছে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে। কিংবা নিজে থেকেই রাকিবের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছে, রাত-বিরাতে তাকে মেসেঞ্জারে নক দিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তার কাছ থেকে সাহায্য নিতে সংকোচ বোধ করেছে রাকিব। মেসেঞ্জারে চ্যাটও করেছে দায়সারা গোছের। আন্তরিকতার বিন্দুমাত্র রেশ সেখানে ছিল না।
কিন্তু এরপর একদিন তাদের কাহিনীতে আকস্মিকভাবেই একটি টুইস্ট আসলো। জ্বরে পড়ে গেলো ফুয়াদ। অবস্থা এমন যে, কিছুতেই তার পক্ষে সম্ভব না ক্যাম্পাসে যাওয়া বা ক্লাস করা। অথচ এটেনডেন্স তার খুবই প্রয়োজন। নইলে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারবে না। তাই কে কে অনলাইনে আছে তা দেখতে মেসেঞ্জারে ঢুকল সে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউই অনলাইনে নেই, শুধু রাকিব ছাড়া!
উপায়ান্তর না দেখে রাকিবকেই মেসেজ পাঠাল সে, “দোস্ত, একটা উপকার কর না প্লিজ। যেভাবেই হোক আজকের ক্লাসে আমার প্রক্সিটা দিয়ে দিস। আমার অনেক জ্বর, ক্যাম্পাসে যাওয়া সম্ভব না।” তার এই মেসেজের জবাবে রাকিব লিখলো,“হায় হায়, জ্বর বাঁধালি কীভাবে! আচ্ছা চিন্তা করিস না, দিয়ে দেব প্রক্সি। তুই রেস্ট নে।”
রাকিব যে এত সহজেই রাজি হয়ে যাবে, তা ছিল ফুয়াদের কল্পনারও বাইরে। কিন্তু তার জন্য আরো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। সেদিন সন্ধ্যায় রাকিব নিজেই তাকে মেসেজ দিয়ে খোঁজ-খবর নিলো। জানালো, প্রক্সি দিয়েছে সে। ফুয়াদ পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত প্রতিদিনই দেবে। এ নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। ফুয়াদ যেন শুধু নিজের শরীরের খেয়াল রাখে।
এরপর থেকে পরের তিনদিন সত্যি সত্যিই সব ক্লাসে ফুয়াদের প্রক্সি দিয়ে দিল রাকিব। নিয়মিত খোঁজও নিতে থাকল। তার এমন আমূল পরিবর্তনে ফুয়াদ যারপরনাই অবাক। জ্বর সারার পর যেদিন সে ক্যাম্পাসে ফিরলো, ফ্রেন্ড সার্কেলের অন্য সবার সামনে রাকিবকে ধন্যবাদ জানালো সে। বললো, রাকিবের এই ঋণ আজীবন মনে রাখবে। জবাবে রাকিব তার পিঠে চাপড় মেরে বলল, “আরে বোকা, আমরা আমরাই তো!”
এভাবেই ফুয়াদ ও রাকিবের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরবর্তী কয়েকটা বছরে তারা পরিণত হলো হরিহর আত্মায়। সবাই তাদেরকে ডাকে ‘মাণিকজোড়’ বলে।
অনেকের কাছেই উপর্যুক্ত কাহিনী অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তারা ভাবছেন, এমনটা আবার কখনো হয় নাকি! তবে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এমন অনেকেও আছেন, যারা এই কাহিনীর সাথে নিজেদের জীবনের কোনো ঘটনার মিল খুঁজে পেয়েছেন। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো এমনই হয়, যে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা প্রাথমিকভাবে অসম্ভব মনে হয়, পরবর্তীতে তারাই ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।
ভালো বন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে অসংখ্য কারণ থাকতে পারে। তবে ফুয়াদ আর রাকিবের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি কাজ করেছে, তার নাম বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্ট।
বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্ট কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্ট হলো একধরনের মানসিক অবস্থা, যার সারকথা হলো: কোনো ব্যক্তি যদি একবার অন্য কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করে থাকে, তবে সে সেই ব্যক্তিকে পুনরায় সাহায্য করতে চাইবে। এমনকি সেই ব্যক্তিটিকে সে প্রাথমিকভাবে পছন্দ না করলেও।
অর্থাৎ, একবার কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করার পর, আমাদের মনে সেই ব্যক্তির প্রতি একধরনের ভালোলাগা জন্মাবে, এবং সেই ভালোলাগার সূত্র ধরে পরবর্তীতে আবারো আমরা তাকে সাহায্য করতে চাইব। এভাবে সেই ব্যক্তির সাথে আমাদের সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হতে থাকবে, এবং এক পর্যায়ে আমরা খুব ভালো বন্ধুতে পরিণত হব।
যেভাবে নামকরণ
বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্টের নামকরণ হয়েছে আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের নামানুসারে। তার আত্মকথা থেকেই আমরা এর নেপথ্যের কাহিনী জানতে পারি।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একজন ‘হেটার’ ছিলেন, অর্থাৎ যিনি তাকে পছন্দ করতেন না। ফ্রাঙ্কলিনের ভাষ্যমতে, সেই ব্যক্তিটি ছিলেন খুবই ধনী ও উচ্চশিক্ষিত, এবং সম্ভবত তৎকালীন সরকারের উপর তার যথেষ্ট প্রভাবও ছিল।
ফ্রাঙ্কলিন চাইতেন ওই ব্যক্তিকে নিজের দলে ভেড়াতে। কিন্তু আর সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ওই ব্যক্তির কাছে কোনো একটি সাহায্য চাইবেন। এমন ভাবনা থেকেই, তিনি ওই ব্যক্তিকে অনুরোধ করলেন যে তিনি তার লাইব্রেরি থেকে তাকে কিছু দিনের জন্য একটি বই ধার দিতে পারবেন কিনা।
ফ্রাঙ্কলিনের এমন অনুরোধে ওই ব্যক্তি মনে মনে বেশ খুশি হলেন, এবং উদারতার পরিচয় দিয়ে ফ্রাঙ্কলিনকে বইটি ধার দিয়ে দিলেন। এক সপ্তাহ বইটি নিজের কাছে রাখলেন ফ্রাঙ্কলিন। এরপর যখন তিনি বইটি ফেরত দিলেন, ভেতরে একটি চিরকুট রেখে দিলেন, যেখানে লেখা ছিল, “আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।”
এরপর থেকে তাদের মধ্যে যখনই দেখা হতো, ওই ব্যক্তি ফ্রাঙ্কলিনের সাথে খুবই বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করতেন। এভাবেই তারা ক্রমশ সত্যিকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যান, এবং তাদের এই বন্ধুত্ব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
এই ঘটনার কথা স্মরণ করে ফ্রাঙ্কলিন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
যিনি একবার আপনার প্রতি মহানুভবতা দেখিয়েছেন, তিনি আবার তা দেখাতে প্রস্তুত থাকবেন। কিন্তু যাদেরকে আপনি নিজেও ইতিপূর্বে মহানুভবতা দেখিয়েছেন, তাদের বেলায় এ শর্ত খাটবে না।
গবেষণা
ফ্রাঙ্কলিনের এ বক্তব্যটি আসলেই কতটুকু সত্য, তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালে মনোবিদরা একটি গবেষণা চালান। গবেষণায় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী অংশ নেন, যাদেরকে বলা হয়েছিল যে তাদের লটারি জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে তাদের প্রত্যেককে কিছু অর্থ প্রদান করা হয়। এরপর তাদেরকে মোট তিনটি দলে ভাগ করা হয়।
- একজন সেক্রেটারি প্রথম দলের সদস্যদের কাছে গিয়ে বলেন, এই গবেষণার জন্য মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনুদান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের অর্থ ফুরিয়ে গেছে। তাই তারা তাদের প্রাপ্ত অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারবেন কি না।
- দ্বিতীয় দলের কাছে গবেষক নিজে হাজির হন, এবং ব্যক্তিগতভাবে সবার সাথে কথা বলেন। তিনি জানান, গবেষণার পেছনে ব্যয়কৃত অর্থ তিনি নিজের পকেট থেকে খরচ করেছিলেন, কিন্তু এখন তিনি অর্থসংকটে পড়েছেন। তাই তাদের পক্ষে তাকে তাদের প্রাপ্ত অর্থ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব কি না।
- তৃতীয় দলটিকে কিছুই জানানো হয় না, এবং তাদের কাছে অর্থ ফেরতও চাওয়া হয় না।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবীরা গবেষককে তখনই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে, যখন তিনি নিজে তাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, এবং তারা তাকে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় দলটি গবেষককে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে।
সিদ্ধান্ত
এ থেকে গবেষকরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্ট আসলেই কাজ করে। যখন কেউ আমাদের কাছে নিজে থেকে কোনো সাহায্য চায়, তখন আমরা তাকে পছন্দ করতে শুরু করি। গবেষকদের অনুমান, এর পেছনে মূল কারণ হলো আমাদের ‘অবধারণগত অসঙ্গতি’। অর্থাৎ আমরা কাউকে সাহায্য করলাম, অথচ ওই ব্যক্তিকে আমরা পছন্দ করি না, এ বিষয়টি আমরা মন থেকে মেনে নিতে পারি না। তাই ওই ব্যক্তিকে সাহায্য করার পর আমাদের মন চায়, আমরা যেন তাকে পছন্দ করি, কারণ তখন আমাদের মন এটা ভেবে স্বস্তি পায় যে, “আমরা তো তাকেই সাহায্য করেছি যাকে আমরা পছন্দ করেছি।”
অন্যান্য কারণ
কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করার পর তাকে যে আমরা পছন্দ করতে শুরু করি, এর পেছনে অবধারণগত অসঙ্গতি ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে।
- প্রথমত, যখন কেউ নিজে থেকে আমাদের কাছে সাহায্য চাইলো, তার মানে এই দাঁড়ালো যে আমরা ওই ব্যক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এবং ওই ব্যক্তি বিশ্বাস করে আমরা তাকে সাহায্য করার যোগ্য। এমন ধারণা আমাদের মনে ভালোলাগা সৃষ্টি করে। এবং স্বাভাবিকভাবেই, যাদের কাছে আমাদের গুরুত্ব রয়েছে, তাদেরকে আমরা পছন্দ করি। এমনকি ইতোপূর্বে সেই মানুষটি আমাদের শত্রু বা অপছন্দের ব্যক্তি হলেও!
- দ্বিতীয়ত, যখন আমরা কাউকে সাহায্য করলাম আর তার জবাবে সে আমাদেরকে মন থেকে ধন্যবাদ জানালো, তখন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে সে আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ, এবং তার মনে আমাদের ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক একটি ধারণা জন্মেছে। আমরা চাই, এই ইতিবাচক ধারণা যেন সবসময় বজায় থাকে, অর্থাৎ তার কাছে আমাদের ভাবমূর্তি কখনো যেন নষ্ট না হয়। এ কারণেই আমরা পুনরায় তাকে সাহায্য করতে চাই, এবং পরবর্তীতে তার সাথে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভালো ব্যবহার করতে শুরু করি।
বিপরীত চিত্র
এতক্ষণ তো কথা বললাম বেন ফ্রাঙ্কলিন ইফেক্ট নিয়ে। কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিক অবস্থাও বিদ্যমান। যখন আমরা কারো ক্ষতি করে ফেলি, তা সে ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে, তারপর থেকে আমাদের মনে ওই ব্যক্তির সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাতে শুরু করে। এর পেছনে মূল কারণও সেই অবধারণগত অসঙ্গতি। কোনো কারণ ছাড়াই আমরা একজন ব্যক্তির ক্ষতি করে ফেলেছি, এ বিষয়টি আমাদের মন মানতে চায় না। তাই আমরা মনে মনে ওই ব্যক্তির সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা করতে থাকি, এবং তার মাধ্যমে নিজেদের মনকে প্রবোধ দিই এই ভেবে যে, “ওই মানুষটা তো আসলেই খারাপ। সুতরাং তার ক্ষতি করে আমরা কোনো অন্যায় করিনি!”
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই জেনে গেছেন কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মূলমন্ত্র। নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন, কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলে অযাচিতভাবে তার উপকার করে তাকে মুগ্ধ করার চেয়েও, নিজেই তার কাছে সাহায্য চাওয়া বেশি কার্যকর। কারণ এর মাধ্যমে কেবল সাধারণ কারো বন্ধুত্বই নয়, এমনকি ঘোর শত্রুর বন্ধুত্বও অর্জন করা সম্ভব!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/