আপনি কি একজন সুখী মানুষ? আপনার মাথায় আসতে পারে সুখ বলতে আমি কী বুঝচ্ছি। সুখ বলতে যে যা-ই বোঝাক এবং সুখী যে যেভাবেই হোক না কেন (অবশ্যই মন্দ কাজ করে সুখী হওয়ার কথা বলছি না), সুখের অনুভূতিটা সবারই এক। সুখের কথা বললে আমাদের অনেকের চোখে ভেসে উঠে দীর্ঘ ক্লান্তিময় এবং ব্যস্ত একটা সপ্তাহ পার করার পর সমুদ্রের টানে সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া কিংবা পাহাড়ের মায়ায় ধরা দিয়ে পাহাড়ি অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া, খুব ভালো করে একবেলা খাওয়া, একটা ভালো বই পড়া কিংবা বন্ধুদের নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া। ছোট ছোট এই বিষয়গুলো সুখী মানুষ হতে কাজে লাগে।
পেনসিলভানিয়ার মনোবিজ্ঞানী সেলিগম্যান পৃথিবীর সব মানুষকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন।
The Pleasant Life
যারা মনে করেন- এত ক্ষুদ্র জীবনে যতটুকু সময় পাওয়া যায় ততটুকু উপভোগ করতে হবে তারা এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ শ্রেণীর মানুষগুলো জীবনের প্রায় প্রতিটি সৌন্দর্যের এবং প্রতিটা মুহূর্তের স্বাদ নিতে চান। অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের সবটুকু সুখ নিয়ে এ শ্রেণীর মানুষ বাঁচতে চায়।
The Engaged Life
উদ্যোক্তা এবং নিজের স্বপ্নকে পূর্ণতা দানকারী মানুষ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের মানুষকে সমাজ আপাত চোখে অনেক অসুখী বলে মনে করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা সুখী মানুষ বটে। তারা নিজের স্বপ্নকে পূর্ণতা দেবার জন্য এতটাই কাজের মাঝে ডুবে থাকেন যে সমাজ এদের অসামাজিক বলেও আখ্যায়িত করতে পারে।
The Meaningful Life
এ শ্রেণীর মানুষদের আমরা জনসাধারণ মহৎ হৃদয়ের মানুষ কিংবা সাদা মনের মানুষ বলে থাকি। এরা সমাজের নানা ধরনের উন্নয়ন করে থাকেন এবং সমাজ এবং দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেন।
আপনি যদি এই তিন শ্রেণীর কোনটির মাঝেই না পড়েন তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। সুখী হতে হলে কিছু অভ্যাস আপনাকে কব্জা করতে হবে। চলুন দেখে নেই সুখী হওয়ার কয়েকটি কৌশল –
নিজেই নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করুন
আপনি যতই ভাবছেন যে কেউ আপনাকে হাসি খুশি আর সুখে রাখার চেষ্টা করবে ততই ভুল করছেন। নিজের খুশিটা নিজেরই তৈরি করে নিতে হবে। আপনার চারপাশের পরিবেশটাকে সেভাবে সাজানোর চেষ্টা করুন। আর তা যদি না পারেন তবে সেই পরিবেশ থেকে খুশি, সুখ আর আত্মতৃপ্তিটুকু নিজেই খুঁজে নিন। একটা কথা মনে রাখবেন, সৌন্দর্য এবং সুখ কখনোই আপনার কাছে এসে ধরা দিবে না, বরং নিজেকেই তা কুড়িয়ে নিতে হবে। তাহলে এখনই থেকে লেগে পড়ুন নিজেকে সুখী করতে এবং সুখী দেখতে।
পছন্দের পরিবেশে পছন্দের মানুষদের সাথে থাকুন
এতটুকু পড়ে পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন খুব তো ভারি ভারি উপদেশ দেয়া হচ্ছে, চাইলেই কি নিজের চারপাশটা বদলানো যায়? না, অবশ্যই না। চাইলেই আপনি আপনার চারপাশটা আমূলে বদলে দিতে পারবেন না। তবে ধীরে ধীরে আপনার অন্তর্নিহিত সুখী মানুষটা ঠিকই পরিবেশ বদলে ফেলতে থাকবে। তাই ভালো লাগে এমন মানুষদের সংসর্গে থাকুন, ভালো লাগে এমন কাজ করুন এবং নিজের অসুস্থ অসুখী পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে এসে আবার নিজের পুরোনো ‘আমি’টাকে খুঁজে নিন। দেখবেন আপনা আপনি মন ভালো হতে শুরু করেছে।
অনেক সময় বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে এমন হয়, বিয়ের পর পরিবারের স্বার্থে নিজেকে উজাড় করে দেন এবং একটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ কিংবা শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যদের মাঝে নিজেকে বেশ অসুখী এবং বড্ড একলা মনে হয়। তাদের জন্য এই পদ্ধতিটা বেশ কাজের।
পর্যাপ্ত ঘুম
ঘুম আপনার শারীরিক ক্লান্তিকে দূর করতে সাহায্য করে। ঘুম কম হলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটে। এতে Stress Hormone এর কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। সুখী মানুষদের খুব ভালো ঘুম হয় কিংবা চাইলে উল্টোটাও ঘটতে পারে আপনার ক্ষেত্রে, ঘুম হোক আপনার সুখের কারণ।
বাঁচার মতো বাঁচুন
আপনি বর্তমানে বাস করছেন। অতীতকে অতীতের মতো থাকতে দিন, অতীতের ভুল ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিন, কিন্তু কখনোই বর্তমানকে ভুলে গিয়ে অতীতের জমানো কষ্টগুলোকে নাড়াচাড়া করবেন না। যা গেছে, তা গেছেই; তাকে যেতে দিন। আর ভবিষ্যৎ মানেই অনিশ্চয়তা। অযথা ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করবেন না। ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার মানেই হলো যে ধার আপনি করেন নি তার সুদ দেয়া। তাই অতীত এবং ভবিষ্যতকে তাদের মতো থাকতে দিয়ে নিজে বর্তমানটাকে উপভোগ করুন। কারণ সময় একবার গেলে তা আর ফিরে আসে না। তাই যতদিন বাঁচবেন প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করে বাঁচুন। আর ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুন্দর স্মৃতি এবং সুন্দর মুহূর্তকে তুলে রাখুন।
নিজেকে নিয়ে খুশি থাকুন এবং নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন
নিজেকে এবং নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। মনের মাঝে সন্তোষ পোষণ করলে কোনো কিছু না পাওয়ার অপূর্ণতা তেমন কষ্টদায়ক হয় না। মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। এতে Stress Hormone Cortisol-এর নিঃসরণ প্রায় ২৩% হ্রাস পায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মাঝে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অভ্যাস আছে, তাদের মাঝে করটিসল হরমোনের প্রভাব অনেক কম এবং তাদের মেজাজ বেশ ভালো থাকে।
ব্যায়াম
Gamma – Aminobutyric Acid (GABA) নামক এক ধরণের নিউরোট্রান্সমিটার, দুশ্চিন্তা দূর করে মস্তিষ্ককে কাজ করার উপযোগী করে তোলে। মোটামুটি ১০ মিনিটের শরীর চর্চায় এটি নির্গত হয়, যা ব্যায়ামের পর আপনাকে দিবে শান্তি এবং কাজ করার ক্ষমতা। অযথা দুশ্চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দেয় বলে আপনি থাকবেন সতেজ এবং হাসি খুশি।
ক্ষমা করুন, কিন্তু ভুলে যাবেন না
সুখী মানুষদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা খুব সহজেই ক্ষমা করে দিতে পারে, কারণ ক্ষমা না করলে অযথা অসন্তোষের সৃষ্টি হবে আর অসন্তোষ সুখী লোকজনের নিকট বেশ পীড়াদায়ক। আর ক্ষমা করলেও সুখী মানুষটা পরবর্তীতে যাতে ঝামেলায় না জড়াতে না হয় তাই এই ধরণের মানুষের সংস্রব এড়িয়ে চলে। কিন্তু তারা অপরাধী এবং অপরাধকে ভোলে না। কারণ ক্ষমাকে অপরাধী অনেক সময় মানুষটির দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করে। ফলশ্রুতিতে যা হয়, সেই ব্যক্তি একই অপরাধ করে। সুখী মানুষদের একটা নীতি হলো- “Fool me once, shame on you; fool me twice, shame on me.”
নিজের হৃদয়ের কথা শুনুন
নিজে মনে প্রাণে যা চান তা প্রকাশ করুন এবং তা বাস্তবে পরিণত করুন। না পাওয়ার তীব্র বেদনা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কখনোই কাম্য নয়। আমরা অধিকাংশ মানুষই অন্যে কি বলবে তা চিন্তা করেই অর্ধেক জীবন পার করে দেই। এতে অন্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, আপনিই বরং ভেতরে ভেতরে তড়পে মরছেন। একটি কথা মাথায় রাখবেন, ন্যায় সঙ্গতভাবে আপনি যা-ই করুন না কেন, তা যদি সমাজ প্রথম প্রথম মেনে না-ও নেয়, দেখবেন সময়ে সব সয়ে যাবে। তাই আর দেরি না করে নিজের স্বপ্নগুলোকে ডানা মেলতে দিন। নিজেকে একজন সম্পূর্ণ সুখী মানুষরূপে দেখতে পাবেন।
জীবনে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে, অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখও পাবেন কিন্তু কখনোই ভেঙ্গে পড়া যাবে না। নিজের যত্ন নিজে নিন, নিজেকে সুখী রাখুন, হাসি খুশি রাখুন দেখবেন পৃথিবীটা খুব সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে আপনার কাছে। বাবা মায়েদের বলছি, নিজেরা সুখী হয়ে, সন্তানদের মাঝে চিরসুখের বুনিয়াদ গড়ে দিন।