চার বার অস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার পর অবশেষে ২০১৬ সালে আরাধ্য পুরস্কারটি নিজের ঝুলিতে তুলতে সক্ষম হন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ও মেধাবী অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করার জন্য পুরস্কৃত হন তিনি। কানাডা ও আর্জেন্টিনার বৈরি পরিবেশে সিনেমাটির দৃশ্যধারণ করা হয়েছিল। এতটাই বিরূপ পরিবেশে শ্যুটিং করা হয়েছিল যে, ক্রু-দের কেউ কেউ সেটাকে ‘জাহান্নাম’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, ক্যারিয়ার ও জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে ডিক্যাপ্রিও’র এই সাক্ষাৎকারটিতে। পাঠকদের জন্য থাকল সেই আলাপচারিতার অংশবিশেষ।
‘দ্য রেভেন্যান্ট’ সিনেমার একটি দৃশ্যে আপনাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাঁচা কলিজা খেতে গেছে। দৃশ্যটি চিত্রায়ন করতে আপনি কি সত্যি কাঁচা কলিজা খেয়েছিলেন?
হ্যাঁ, খেয়েছিলাম। কারণ ওরা প্রথমে আমাকে যে নকল কলিজা দিয়েছিল, একদম কৃত্রিম দেখাচ্ছিল ওটা। তাই আসল কলিজা ব্যবহার করতে হয়েছিল। দৃশ্যটি ধারণ করতে মোট দু’বার খেতে হয়েছিল আমাকে। খাওয়ার সময় আমার যে অভিব্যক্তি আপনারা পর্দায় দেখেছেন সেটা একদম খাঁটি। আমাকে কোনো অভিনয় করতে হয়নি।
দেখে মনে হয়েছে সিনেমাটি বেশ কঠিন ছিল। আপনাকে যদি ১০-এর স্কেলে রেটিং করতে বলা হয় তাহলে আপনি ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ নির্মাণের ব্যাপারটিকে বিবেচনা করে কত দেবেন?
দশে দশ দেব। কাজে নামার আগে আমরা সবাই জানতাম আমরা কী করতে যাচ্ছি। সিজিআই ব্যবহার করে কাজটা করা সম্ভব ছিল না। তাই বৈরি আউটডোর লোকেশনে কাজ করতে হয়েছে।
সিনেমাটির কাজ করতে গিয়ে কোন অংশে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে?
ভোগান্তি পুরো শ্যুটিং জুড়েই ছিল। সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ঠাণ্ডা। আমার সাথে একটি বিশেষ মেশিন নিয়ে গিয়েছিলাম, দেখতে বড় হেয়ারড্রায়ারের মতো। আটটা শুঁড় ছিল ওতে। তাই নাম দিয়েছিলাম ‘দি অক্টোপাস’। শটের বিরতিতে ওটা দিয়ে নিজের শরীর গরম করতাম।
ব্যক্তিজীবনে আপনি অন্তর্মুখী নাকি বর্হিমুখী?
অবশ্যই বর্হিমুখী। আমি প্রকৃতি ভালবাসি। যেখানে কোনোদিন কোনো মানুষের পা পড়েনি সেরকম আদিম স্থানে যেতে ইচ্ছে করে। আমাজনের মতো জায়গায় গেলে প্রায় সন্ন্যাসীর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা হয়, যেখানে কয়েক হাজার মাইলের মধ্যে কোনো মানব সভ্যতা নেই।
ভ্রমণ করতে গিয়ে আপনি কয়েকবার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় হাঙর আক্রমণ করেছিল আপনাকে। তার আগে একবার প্যারাস্যুট না খোলায় দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। ওই মুহূর্তগুলোতে আপনার কেমন লেগেছিল? কী চলছিল মনের ভেতর?
ব্যাপারটা অদ্ভুত। কারণ সেরকম বিশেষ বা নাটকীয় কিছু মনে আসেনি। স্রেফ এতটুকু মনে হচ্ছিল: ধ্যাত, আজকেই কেন এরকমটা হতে হবে? আমার বয়স কম, সামনে সুন্দর জীবন পড়ে রয়েছে, খুব বাজে হলো এটা। আসলে তখন প্রাণ বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো গভীর চিন্তা বা আবেগ কাজ করে না।
তাহলে চোখের সামনে নিজের অতীত জীবনের ছবি ভাসতে দেখেননি?
হ্যাঁ, তা দেখেছি। আমার জীবনে এরকম দুটো ঘটনা আছে, যেখানে আমার পুরো অতীত জীবনের মুহূর্তগুলোকে চকচকে ছবি হয়ে সেকেন্ডের মধ্যে চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখেছি। এরকম সত্যিই ঘটে জীবনে। প্যারাস্যুট দুর্ঘটনার সময় এরকম দেখেছিলাম।
মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসার কারণে আপনার কি মৃত্যুভয় কমে গেছে?
না, মারা যাওয়া নিয়ে আমার এখনও ভয় কাজ করে।
অস্কার জেতার বিষয়টি আপনার কাছে কতটুকু গুরুত্ব রাখে?
সত্যি বলব? যখন থেকে সিনেমায় কাজ করছি কখনও এটা নিয়ে ভাবিইনি। একটা পুরস্কার জেতাকে উদ্দেশ্য করে আমি জীবনে কোনোকিছুই করিনি। প্রতিবার যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি।
আপনার বয়স যখন ১৯ বছর তখন প্রথমবারের মতো অস্কারের জন্য মনোনীত হন ‘হোয়াট’স ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। তখন পুরস্কারটা পেয়েও যেতে পারেন ভেবে কোনো স্পিচ তৈরি রেখেছিলেন?
না! আমি মোটেও কোনো কিছু তৈরি করিনি তখন। তখন অস্কার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। আর যদি পেতামও সেটা খুব বাজে হতো।
লস অ্যাঞ্জেলেসে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আপনি ছোটবেলা পার করেছেন। সেই বয়সে নিজেকে বহিরাগত ভাবতেন। এখন হলিউডে জায়গা করে নেয়ার পরও কি নিজেকে তখনকার মতো বহিরাগত মনে হয়?
তখনও মনে হতো, এখনও মনে হয়, সামনেও মনে হবে। মার্টি (মার্টিন স্কর্সেস; স্বনামধন্য পরিচালক) আর আমার একই অবস্থা। সে নিউ ইয়র্কের রাস্তা থেকে উঠে এসেছে। নিজেকে কখনও হলিউডের বাসিন্দা হিসেবে অনুভব করতে পারেনি। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় কাস্টিং ডিরেক্টররা আমাকে কাজে নিতেন না। বাদ দিতেন। তখন নিজেকে সবচেয়ে বেশি বহিরাগত মনে হয়েছিল আমার। ভাবতাম, আমি এসবের যোগ্যই নই। কিন্তু এটাও মনে হতো, এমন একদিন আসবে যখন তারাই আর্শীবাদ করে আমাকে বলবে, তুমি এখন থেকে আমাদের অভিজাত বাসিন্দাদের একজন, বিশেষ ব্যক্তি।
পরবর্তীতে আপনি কি সেই আর্শীবাদ পেয়েছেন?
তা আর বলতে!
আপনারা পুরনো সিনামাগুলোর মাঝে কোনটি সবচেয়ে পছন্দের?
‘দ্য বয়ে’স লাইফ’। ২৫ বছর আগের কথা, তখন আমার বয়স ১৫ বছর। এখনও প্রতিটি ঘটনা পরিস্কার মনে আছে। সবকিছু তখন আমার কাছে একদম নতুন ছিল। রবার্ট ডি নিরো-কে সেটে পরিশ্রম ও একাগ্রতা নিয়ে কাজ করতে দেখাটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতা।
লোকমুখে শোনা যায়, একজন অভিনেতা ও একজন মুভি স্টারের মাঝে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। আপনি তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছেন। একজন মুভি স্টার হিসেবে বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন? স্টার হওয়ার পর কি আপনার সিনেমা বাছাই করার ধরন বদলে গেছে?
সত্যি বলতে কী, সিনেমার প্রতি আমার যে ধ্যান-ধারণা, সেটা কখনওই বদলায়নি। আমি ১৫ বছর বয়সেও এ ব্যাপারে যেমন ছিলাম, আজও তেমন আছি।
টাইটানিকের ব্যাপারে কিছু বলুন…
আমার মনে হয় ‘টাইটানিক’ আমাকে স্বাধীন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের চেয়ে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ভাল পরিচালক কিংবা ভাল স্ক্রিপ্ট চেনার দক্ষতা বাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো সময়ের সাথে সাথে একজন অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ে আমার দক্ষতা বেড়েছে। কিন্তু যে ধরনের কাজ আমি করতে চাইতাম, সেখানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
লিও-ম্যানিয়া’র বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকালে কেমন অনুভব করেন?
কী? বুঝতে পারলাম না…
দ্য লিও-ম্যানিয়া, টাইটানিক মুক্তির সময়টায়, ৯০ দশকের শেষের দিকের কথা বলছি। ইন্টারনেট সেই বছরগুলোকে লিও-ম্যানিয়া বলে থাকে।
তাই নাকি? খুব অদ্ভুত সময় কেটেছে তখন। তখন উত্তেজনার আঁচ এতটাই বেশি ছিল যে, নিজেকে পুনরায় কাজে মনোযোগী করার জন্য কয়েক বছর অভিনয় জগত থেকে বিরতি নিয়েছিলাম।
আপনার বয়স এখন ৪৩ বছর। ভবিষ্যতে করতে চান এমন কাজের তালিকায় এখনও কী কী বাকি রয়েছে?
এই মুহূর্তে তালিকায় রয়েছে আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে।
ফিচার ইমেজ- timeout.com