স্কুলে পড়ার সময় ‘সময়ের মূল্য’ নিয়ে একটা রচনা সবারই শেখা হয়। তখন তো এটা পরীক্ষায় আসার মতো একটি রচনা। খুব ভালোমতো শেখে সবাই। কিন্তু সেই সময়ের মূল্য আসলে পরীক্ষার খাতাতেই আটকে আছে। বাস্তবিক জীবনে আর সময়ের মূল্য বা গুরুত্বের উপলব্ধি করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু দিনরাত কাজ করতে গিয়ে যখন সময়ের হিসাব মেলাতে পারি না, তখন ঠিকই উপলব্ধি করি, “ইশ! আর অল্প একটু সময় যদি বেশি পেতাম!” কিন্তু সেই সুযোগ আর কোথায়?
নিজেদের কাজ কিংবা পড়ার সময় তো আমাদের নিজেদেরই গুছিয়ে নিতে হবে। আমরা অনেকেই নিজেদের সময় নিজেরা গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি এবং চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই হাল ছেড়ে দিই। একটি জিনিস কি কখনও লক্ষ করেছেন? আমাদের কর্মক্ষেত্রে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবা অন্য যেকোনো কাজে যে সময়ের হিসাব দেয়া হয়, তা আসলে ঘড়ির কাঁটা মেপে হিসাব করা। কিন্তু আমাদের জীবন তো আর ঘড়ির কাঁটায় আটকে থাকে না! সময়ের হেরফের হতেই পারে। আমরা যেই বাস্তব জীবনে বাস করি, তার সময়সীমা সম্পূর্ণ মানসিক। আমরা আমাদের কাজ কীভাবে শেষ করবো, তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আমাদের আছে। আর যেই জিনিস নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আমাদের আছে, তা অবশ্যই আমরা চাইলে পরিবর্তন করতে পারবো! অর্থাৎ, আমরা চাইলেই আমাদের সবকাজের জন্য নিজেদের পছন্দমতো বাস্তবসম্মত সময়সীমা বানিয়ে কাজ শেষ করে ফেলতে পারি! তাহলে চলুন আজ সময়ের উপর কীভাবে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, সেই বিষয়েই আলোচনা করি।
শুরুতেই একটি প্রক্রিয়ার কথা বলি। RAC প্রক্রিয়া। R = record, A = analyze, C = change। অর্থাৎ, সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সময়ের উপর একটি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারি। কিন্তু কীভাবে? আপনি আপনার সামনের এক সপ্তাহে কী কী করছেন এবং কোন কাজে কীরকম সময় ব্যয় করছেন, তা লিখে রাখুন। এবার সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখুন আপনি কোন কাজে সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট করেছেন। হতে পারে আপনি বেশি ঘুমিয়েছেন। ঘুমের আদর্শ সময়সীমা হলো দিনে ৬-৮ ঘণ্টা। এর বেশি ঘুমিয়ে থাকলে আপনার অবশ্যই ঘুম বেশি হচ্ছে। কিংবা হতে পারে আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি সময় অযথাই কাটিয়ে দিয়েছেন। এরকম ৫টি কাজ খুঁজে বের করুন, যা আপনার না করলেও চলতো। এরপর আসুন পরিবর্তনের জন্য। যেই সমস্যাগুলো বের করেছেন, তা পরিবর্তন করার জন্য অনেক উপায় আছে। কিছু হয়তো আপনি আগে থেকেই জানেন। এবার আসুন পরিবর্তনের জন্য কয়েকটি উপায় জেনে নিই।
সাপ্তাহিক কাজের তালিকা করে রাখুন
মনে হতে পারে যে, সামনের ৭ দিন আমার সাথে কী কী হবে, তা আগে থেকেই কীভাবে জানবো? সেটা না হয় না জানলেন। কিন্তু আপনার কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে, তার কিছু হলেও তো আগে থেকে জানা থাকার কথা। আপনার শিক্ষাক্ষেত্রে পুরো এক সপ্তাহের কার্যক্রম সূচী দেয়া থাকে। সেখান থেকে আপনি জানতে পারেন যে, আপনার সামনে কোনো পরীক্ষা আসছে কিনা। এখানে পরীক্ষাটি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে তালিকা করে রাখলেন। তেমনি আপনার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের তালিকা করে রাখলে, কোনো কাজ ভুলে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সেইসাথে, যদি কোনো কাজের জন্য সময়ের পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তাও আগে থেকে ধারণা করতে পারবেন। একইসাথে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার থাকলে, তার জন্য আলাদা সময় ঠিক করে রাখুন।
আগের কাজ আগে করুন
লেখন মার্ক টোয়েনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। “যদি ব্যাঙ খাওয়া আপনার কাজ হয়, তাহলে এটি সকালে করা ফেলাই ভালো। আর যদি দুটো ব্যাঙ খেতে হয়, তাহলে বড়টি আগে খান।” এর মানে হলো, আপনার যেই কাজ আগে করা উচিত, যেই কাজ না করলেই না সেটি আগে শেষ করে ফেলুন। এটি পরবর্তিতে আপনাকে বাড়তি কাজের চাপ থেকে মুক্তি দেবে।
দিনের শুরুতে ৩০ মিনিট দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে কী করেন? দাঁত ব্রাশ করেন, কাজে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য তৈরি হন। এই কাজগুলোর মাঝে ৩০ মিনিট সময় বের করে নিন। এই ৩০ মিনিট চিন্তা করুন আজকে দিনে আপনার কী কী করতে হবে, কোন কাজ আগে করা উচিত, কীভাবে কাজ করলে কষ্ট কম হবে। এই ৩০ মিনিট আপনার দিনের কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারে। তবে এমন না যে, আপনাকে ঘড়ি ধরে ৩০ মিনিট বসে থাকতে হবে। রাস্তায় গাড়িতে বসে কিংবা সকালের নাস্তা করার সময়ও এগুলো চিন্তা করতে পারেন।
সবকিছুর গুরুত্ব সমান নয়
কাজ করছেন কিংবা কোনো পড়া পড়ছেন। এমন সময় কেউ ফোন করলো। অথবা একটি ইমেইল আসলো। কিংবা ফেসবুকে একটি মেসেজ আসলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেটি করি, হাতের কাজটি ফেলে দিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে পড়ি। দেখলে মনে হয় যে, “আরেহ! দুই মিনিটই তো। দুই মিনিট নষ্ট হলে আর এমন কী হবে!” কিন্তু এই দুই মিনিট যে আমাদের কাজের গতি ত্রিশ মিনিট কমিয়ে দিতে পারে, সেটি আমরা ভুলেই যাই। তাই এখন থেকে যখন কোনো ফোন কল কিংবা ইমেইল আসবে অথবা কেউ ডাক দেবে, আমরা সাথে সাথেই সেটি না দেখে, যতটুকু কাজ আগে শেষ করা দরকার তা শেষ করে, তারপর দেখতে যাবো। এতে করে আমাদের কাজের গতি কমে যাবে না এবং আমরা সময়ের উপরও একটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবো।
বিরক্ত করবেন না!
এমনও হয় যে, কাজের মাঝে কেউ আপনাকে ডাক দিলো। তখন আমরা সাথে সাথেই তার কথা শুনতে শুরু করে দেই। কিন্তু ভদ্রলোক তো জানেন না যে, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। তার কথা শুনতে গিয়ে আপনার যে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা তো তিনি জানেন না। তবে যদি এটা কোনো উচ্চ পদস্থ কারও ডাক হয় বা আরো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ হয়, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। সাধারণভাবে যদি আপনি চান যে, কাজে মাঝে কেউ আপনাকে বিরক্ত না করুক, তাহলে টেবিলে আপনার সামনে একটি কথা লিখে রাখতে পারেন যে, “বিরক্ত করবেন না।” তাহলে হয়তো আপনি শান্তিমতো আপনার কাজ শেষ করতে পারবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকা
পড়ালেখা কিংবা কোনো কাজ করার সময় যে ভুলটি আমরা সবচেয়ে বেশি করে থাকি তা হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে যাওয়া। একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে এটি আসলেই অনেক ক্ষতি করে। আপনি যদি দিনে ৩-৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো দরকার ছাড়াই কাটিয়ে দেন, তাহলে তা অনেক ক্ষতিকর। ধরে নিন, আপনি ৩০ মিনিটের মধ্যে একটি কাজ শেষ করবেন। এই ৩০ মিনিট আপনি চান না কেউ আপনাকে বিরক্ত করুক। কাজ শুরু করার আগে মোবাইল ফোনটি হাত থেকে দূরে কোথাও রেখে দিন। এতে করে, মোবাইলে কোনো বার্তা এলেও আপনি কাজ ফেলে উঠবেন না। কারণ মোবাইলটি আনতে হলে আপনাকে চেয়ার ছেড়ে উঠা লাগবে। তাই, এটি একটি ভালো উপায় হতে পারে নিজেকে মোবাইল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে রাখার।
এই উপায়গুলো সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য বেশ কার্যকর। তবে একটি জিনিস আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমরা দিনের ২০% যে কাজ করি, তার উপর ভিত্তি করে দিনের বাকি ৮০% আমরা ফলাফল পাবো। তাই আমরা আমাদের দিন কীভাবে পরিচালনা করবো, তা ঠিক করা সম্পূর্ণ আমাদের উপর। আমরা যে সময় হারাবো, তা আর ফিরে পাবো না। কথায় আছে না, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না!
Feature image: Elegant Themes