খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন গাড়ি বলতে মানুষ বুঝত গ্যাসোলিন ও ডিজেলচালিত গাড়িকেই, এবং টেসলা ছিল শুধুই একজন মহান উদ্ভাবকের নাম। কিন্তু দিন বদলেছে। দেশে দেশে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। গাড়ি কেনার সময় গ্যাসোলিনের পাশাপাশি ইলেক্ট্রিক গাড়ির ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে মানুষ। এই দিন বদলের পেছনে যে নামটি সবচেয়ে জোরেশোরে উচ্চারিত হয় তা হলো টেসলা, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইলেক্ট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি।
টেসলা মোটর্স কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০০৩ সালের ১ জুলাই। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ছিলেন মার্টিন এবারহার্ড এবং মার্ক টার্পেনিং নামক দুই স্বপ্নবাজ ইঞ্জিনিয়ার। মানুষের দোরগোড়ায় আরও উন্নত, দ্রুতগতির এবং গ্যাসোলিন চালিত গাড়ির চেয়েও আকর্ষণীয় বৈদ্যুতিক গাড়ি পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন টেসলা মোটরর্স। প্রতিষ্ঠার পর এবারহার্ড হন কোম্পানির সিইও এবং টার্পেনিং কাজ শুরু করেন সিএফও হিসেবে।
শুরুর দিকে নিজেদের গাটের পয়সা দিয়েই কোম্পানি চালাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু গাড়ি উৎপাদনে যেতে হলে প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের অর্থ, যা তাদের একার পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই তারা টেসলার জন্য নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করেন। গল্পের এই জায়গায় আবির্ভাব ঘটে এলন মাস্কের।
এলন মাস্ক তখন সদ্য বিলিয়নিয়রে পরিণত হয়েছেন। পেপালে থাকা নিজের শেয়ার বিক্রি করে তিনি ১৬৫ মিলিয়ন ডলারের মালিক বনে গিয়েছিলেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি তখন এই অর্থ নতুন কোথাও বিনিয়োগের কথা ভাবছিলেন। এসময় টেসলার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি টেসলায় বিনিয়োগে আগ্রহী হন। প্রাথমিকভাবে মাস্ক ৬.৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ করেন টেসলাতে। এই বিনিয়োগের পর তিনি টেসলার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর পরের বছর ২০০৫ সালে ব্রিটিশ স্পোর্টস্ কার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লোটাসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় টেসলা। চুক্তি অনুযায়ী টেসলার প্রথম গাড়ি রোডস্টার তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সহায়তা দেবে লোটাস। এই চুক্তির এক বছর পর ২০০৬ সালে টেসলাতে বিনিয়োগ করেন টেক জায়ান্ট গুগলের দুই প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন এবং ল্যারি পেইজ।
ঐ বছরই কোম্পানির চেয়ারম্যান এলন মাস্ক এক অভিনব কান্ড করে বসেন। কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বেশ ঘটা করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন তিনি! একে তিনি আখ্যা দেন ‘সিক্রেট মাস্টারপ্ল্যান’ হিসেবে।
মাস্টারপ্ল্যানটি ছিল অনেকটা এরকম: প্রথমে টেসলা একটি বিলাসবহুল বৈদ্যুতিক স্পোর্টস্ কার তৈরি করবে যেটি শুধুমাত্র ধনীরাই কেনার সামর্থ্য রাখে। সেই স্পোর্টস্ কার বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে মিড-বাজেটের আরেকটি মডেল তৈরি করা হবে। সেই মডেল থেকেও যে অর্থ আসবে তা ব্যয় করা হবে আরও স্বল্পমূল্যের অপর একটি কার মডেল তৈরির পেছনে যা কিনা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। একই সাথে ইলেক্ট্রিক পাওয়ার ব্যবহার করে জিরো এমিশন নিশ্চিত করা হবে গাড়িগুলোতে।
এলন মাস্কের সেই তথাকথিত সিক্রেট মাস্টারপ্ল্যান মিডিয়াতে বেশ হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিল। কারণ মাত্র তিন বছর বয়সী একটি কোম্পানির কাছ থেকে এত সুদূরপ্রসারী ঘোষণা কেউ আশা করেনি। তাছাড়া স্বল্পমূল্যের টেকসই বৈদ্যুতিক গাড়িও তখন চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ টেসলা একেই তাদের মূল পরিকল্পনা হিসেবে দাবি করে বসে! তাই চারদিক থেকে আসা বিদ্রূপের ঝড়টাও মাথা পেতে নিতে হয় তাদের।
পরিকল্পনা তো হলো। এখন তা সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ। এই পাহাড়সমান চাপ ও বিশাল প্রত্যাশা কাঁধে নিয়ে কাজ শুরু করে টেসলা। দ্রুতই তারা রোডস্টারের প্রোটোটাইপ মডেল জনসাধারণের সামনে উন্মুক্ত করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে মালিকানা নিয়ে।
প্রায়শই দেখা যায় যে প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে একটি স্টার্ট-আপ শুরু করতে পারলেও প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে তা আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না উদ্যোক্তাদের পক্ষে। টেসলার ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকম কিছুই ঘটেছিল।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সিইও পদ লাভ করলেও একটি বড় কোম্পানি চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছিল না মার্টিন এবারহার্ডের। তাছাড়া তিনি অটোমোবাইল ব্যাকগ্রাউন্ডেরও ছিলেন না। ফলে তার অধীনে চলমান টেসলার রোডস্টার প্রজেক্ট শেষ হতে অতিরিক্ত সময় লেগে যায় এবং একই সাথে গাড়ির উৎপাদন খরচও বাজেট ছাড়িয়ে যায়। আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয় টেসলার সামনে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং চেয়ারম্যান এলন মাস্ক এবারহার্ডকে সিইও পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এবারহার্ডকে চিফ এক্সিকিউটিভ পদ থেকে অব্যহতি দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক কমিটিতে পাঠিয়ে দেন।
নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে পদাবনতি মানতে পারেননি এবারহার্ড। ফলে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি টেসলার সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেন। তার সাথে বেরিয়ে যান আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মার্ক টার্পেনিং। এ সময় এলন মাস্ক জেভ ড্ররি নামের এক ব্যক্তিকে সিইও হিসেবে নিযুক্ত করেন।
মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চললেও থেমে থাকেনি রোডস্টার তৈরির কাজ। প্রাথমিক বিলম্বকে পেছনে ফেলে ২০০৮ সালের মার্চে ড্ররির নেতৃত্বেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় রোডস্টারের। এটি ছিল টেসলার জন্য এক অভুতপূর্ব মূহুর্ত। কারণ প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় তারা রোডস্টারের মতো অসাধারণ একটি বৈদ্যুতিক স্পোর্টস্ কার তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার ডলারের মধ্যে।
৬,৮৩১টি পৃথক লিথিয়াম-আয়ন সেল সম্বলিত রোডস্টারের ব্যাটারি সিস্টেমটি ছিল অনবদ্য। একবার পূর্ণাঙ্গ চার্জে প্রায় ২৫০ মাইল অতিক্রম করতে পারত এটি। ০-৬০ মাইল/ঘন্টা গতি তুলতে পারতো মাত্র ৪ সেকেন্ডে। এর ব্যাটারির স্থায়িত্বকাল ধরা হয় প্রায় পাঁচ বছর এবং নষ্ট হওয়ার আগে এর দ্বারা প্রায় ১ লক্ষ মাইল অতিক্রম করা সম্ভব।
বাজারে আসার পর থেকেই রোডস্টার রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে কোম্পানিতে। অথচ রোডস্টার প্রজেক্ট শেষ হতে বিলম্ব হওয়ায় তখন তাদের আর্থিক অবস্থাও ছিল তথৈবচ। মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারের মতো নগদ অর্থ ছিল কোম্পানির হাতে। এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে, গ্রাহকের অর্ডারকৃত রোডস্টারগুলো ডেলিভারি দেয়ার মতোও সামর্থ্য ছিল না টেসলার।
কোম্পানির এই দুরবস্থায় একে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাস্ক। তাই ড্ররিকে সরিয়ে ২০০৮ সালের অক্টোবরে নিজেই হয়ে যান টেসলার সিইও এবং একইসাথে ছাঁটাই করেন কোম্পানির ২৫% কর্মচারীকে।
এলন মাস্কের মতো ক্যারিশমাটিক মানুষ কোম্পানির সরাসরি নেতৃত্বে আসায় টেসলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ফলস্বরূপ ২০০৯ সালে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে টেসলার ১০% শেয়ার কিনে নেয় ডাইমলার এজি। একই বছর আমেরিকার এনার্জি ডিপার্টমেন্ট টেসলাকে ৪৬৫ মিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণ প্রদান করে। এই দুটি বড় বিনিয়োগের ফলে নিশ্চিত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় টেসলা।
রোডস্টার বিক্রি করে এবং ২০১০ সালে শেয়ার মার্কেটে প্রবেশের করে টেসলা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে। এই সাফল্যের উপর ভর করে তারা ২০১১ সালে মডেল এস’ নামে নতুন একটি গাড়ির প্রটোটাইপ উন্মুক্ত করে। এর মূল্য নির্ধারিত হয় ৭৬,০০০ ডলার, যা রোডস্টারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। মডেল এস’ বাজারে আসে ২০১২ সালে।
রোডস্টারের মতো মডেল এসও সবার মন জয় করে নেয়। বিভিন্ন অটোমোটিভ ইভেন্ট থেকে অর্জন করে বেশ কিছু সম্মানজনক পুরস্কার। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল প্রায় ২৪৯কি.মি/ঘন্টা এবং মাত্র ৩.২ সেকেন্ডেই এটি ৬০ মাইল/ঘন্টা গতি তুলতে সক্ষম।
২০১২ সালে মডেল এস এর পাশাপাশি টেসলা প্রথমবারের মতো আমেরিকাতে তাদের ছয়টি দ্রুতগতির চার্জিং স্টেশন চালু করে। এগুলোর নাম রাখা হয় সুপারচার্জার। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা তারা বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ১,২০০টি সুপারচার্জার রয়েছে টেসলার, যেখানে একজন টেসলার মালিক দ্রুতগতিতে চার্জিংয়ের কাজ সেরে নিতে পারেন।
বৈদ্যুতিক স্পোর্টস কারের মতো ‘গিগাফ্যাক্টরি’ হলো টেসলার আরেকটি মাস্টারস্ট্রোক। বাজারে টেসলা কারের ক্রমশ বেড়ে চলা চাহিদার ফলে এসব গাড়ির ব্যাটারি ও ইলেক্ট্রিক মোটরের সাপ্লাইও দ্রুততার সাথে যোগান দেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সমস্যা দূরীকরণে ২০১৪ সালে আমেরিকার নেভাডায় টেসলা তাদের প্রথম গিগাফ্যাক্টরির নির্মাণ শুরু করে। বর্তমানে এতে ব্যাটারি, মোটর, পাওয়ারওয়াল, পাওয়ারপ্যাক ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
২০১৫ ও ২০১৭ সালে মডেল এক্স এবং মডেল থ্রি নামে আরও নতুন দুটি মডেলের গাড়ি বাজারে আনে টেসলা। এর মধ্যে মডেল থ্রি ছিল তাদের তৈরি সবচেয়ে কম মূল্যের গাড়ি। পূর্বঘোষিত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী এর শুরুর দিকে মূল্য ছিল মাত্র ৩৬,২০০ ডলার! এই দুটি গাড়িও ক্রেতাদের মন জয় করে নেয়।
শতভাগ সফল চারটি গাড়ির মডেল তৈরি করা টেসলার যেখানে আকাশে ওড়ার কথা সেখানে এলন মাস্কের কিছু বেফাঁস কথাবার্তা কোম্পানিকে বিপদে ফেলে দেয়। এর জের ধরে ২০১৮ সালে টেসলা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্য হারায় এবং এলন মাস্ককেও কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যেতে হয়। অবশ্য সিইও পদে তিনি থেকে যান বহাল তবিয়তে।
২০১৯ সালে সিক্রেট মাস্টারপ্ল্যানের শেষ গাড়ি হিসেবে টেসলা বাজারে আনে মডেল ওয়াই। এর মূল্য শুরু হয় ৪০,০০০ ডলার থেকে। অর্থাৎ মাত্র তেরো বছরের মাথায় টেসলা উচ্চমূল্যের বৈদ্যুতিক গাড়িকে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
টেসলার সর্বশেষ চমকপ্রদ উদ্ভাবনের নামসাইবারট্রাক। সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের এই ট্রাক প্রথমবার দেখে সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে গিয়েছিল। যেন ভবিষ্যত থেকে চলে আসা অদ্ভুত কোনো বাহন এটি! ইতোমধ্যে সাইবারট্রাক কেনার জন্য প্রায় আড়াই লক্ষ অর্ডার চলে এসেছে টেসলাতে!
শুরুর দিকে আর্থিকভাবে পার করা কঠিন সময় বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠেছে টেসলা। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক বাজারে যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে তার প্রায় ১২% টেসলার দখলে। আমেরিকার বাজারে যেটি ৭৫%! বর্তমানে টেসলা তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করতে কাজ করছে। একইসাথে সুপারচার্জারের সংখ্যাও বৃদ্ধি করে চলেছে তারা।
মানুষের দোরগোড়ায় আকর্ষণীয় ও উচ্চগতির বৈদ্যুতিক গাড়ি পৌঁছে দেয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল টেসলা তার অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছে তারা। তবে এখানেই থেমে না থেকে অটোনমাস কার, সাইবারট্রাকের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে টেসলা। এই যাত্রায় তারা কতটুকু সফল হবে তা শুধুমাত্র সময়ই বলতে পারে।