ব্যথা নামক অনুভূতির সাথে প্রতিটি মানুষই কম-বেশি পরিচিত। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষই নানারকম শারীরিক ব্যথার মুখোমুখি হয়। শীতকালে খালি পায়ে হাঁটার সময় চেয়ার বা খাটের কিনারা পায়ে লাগেনি, এমন মানুষ খুব কমই আছে। খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের ব্যথায় কাতরানো ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে পরিচিত দৃশ্য। প্রতিটি ব্যথার সময় মনে হয় এ একেবারে অসহ্য, পৃথিবীতে এর থেকে বেশি ব্যথা হতেই পারে না। তবে বিজ্ঞানীরা ব্যথার তীব্রতার উপর নির্ভর করে মানুষের জন্য সবচেয়ে অসহনীয় ব্যথার তালিকা করেছেন। চলুন দেখে আসা যাক তালিকাটি।
বুলেট পিঁপড়ার কামড়
বুলেট পিঁপড়া মূলত Paraponera clavataca প্রজাতির একটি পিঁপড়া। উত্তর ও দক্ষিণ দুই আমেরিকা মহাদেশেই এদের পাওয়া যায়। লম্বায় ১৮ থেকে ৩০ মিলিমিটার হতে পারে, রঙ লালচে-কালো। Schmidt Pain Index বিভিন্ন পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে হওয়া ব্যথার তীব্রতা নির্ধারণের একটি মাত্রা। এ ইনডেক্স অনুসারে বুলেট পিঁপড়ার কামড় সবচেয়ে বেশি তীব্র। এ পিঁপড়ার কামড়ের সাথে সাথে কামড়ের জায়গায় প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়, শরীর কাঁপতে শুরু করে। এই ব্যথাকে তুলনা করা যেতে পারে জ্বলন্ত কয়লা এবং পেরেকের উপর দিয়ে হেঁটে যাবার সাথে। এ পিঁপড়ার কামড়ের ব্যথা ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
কিডনির পাথর
চিকিৎসাবিজ্ঞানে কিডনির পাথরের নাম ‘নেফ্রোলিথাইসিস’। এ পাথর মূলত ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, স্ট্রুভিট (অ্যামোনিয়া এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ) কিংবা সিস্টিন (এক ধরনের জৈব যৌগ) থেকে হয়। কিডনির পাথর পুরো শরীরের রেচন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। কিডনির পাথর হলে ডান কাঁধে এবং পাঁজরের নিচে প্রচন্ড ব্যথা হয়। এ ব্যথার সাথে যোগ হয় জ্বর, প্রসাবের সাথে রক্ত, পুঁজ এবং বমি। পাথরগুলো আকারে ৩ মিলিমিটার হলে এগুলো প্রস্রাবের নালী বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। প্রাকৃতিকভাবে পাথর সরে না গেলে কিংবা সার্জারি না করলে এ ব্যথা সারে না, থেকেই যায়।
গুচ্ছ মাথাব্যথা
জীবনে কখনো মাথাব্যথা হয়নি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। তবে মাথাব্যথারও রয়েছে অনেক প্রকারভেদ। অনেকের মাথাব্যথা হয় কাজের চাপের কারণে, আবার অনেকের হয় মাইগ্রেনের জন্য। অনেকেরই হতে পারে সাইনাসজনিত কারণে। মাইগ্রেনের সাথে গুচ্ছ মাথাব্যথার কিছু মিল থাকলেও এর কারণ এবং লক্ষণগুলো মাইগ্রেন থেকে আলাদা।
মাইগ্রেনের মতো গুচ্ছ মাথাব্যথাতেও মাথার একদিকে ব্যথা হয়, তবে মাইগ্রেনের ব্যথায় চোখের আশেপাশে ব্যথা না-ও হতে পারে। মাইগ্রেনের ব্যথা হয় মাথার একদিকের পুরোটা জুড়ে, আর গুচ্ছ মাথাব্যথায় হয় চোখের আশেপাশে। মূলত এটিই মাইগ্রেনের সাথে গুচ্ছ মাথাব্যথার পার্থক্য। এক্ষেত্রে চোখে প্রচন্ড ব্যথা হবে, চোখ দিয়ে পানি পড়বে, এমনকি সর্দি পর্যন্ত হতে পারে। এ ব্যথা সপ্তাহ বা মাস জুড়ে প্রতিদিন হতে পারে এবং বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এ ব্যথা বেশি দেখা যায়, যেমন বসন্তকালে।
এ ব্যথা ঠিক কারণে হয় এটি এখনো জানা যায়নি. তবে ধারণা করা হয় মুখমন্ডলের কোনো স্নায়ু এর জন্য দায়ী, যা চোখে ব্যথা তৈরি করে। এর তীব্রতা মাইগ্রেনের থেকে বেশি হলেও স্থায়িত্ব মাইগ্রেনের থেকে কম হয়। প্রতি ১,০০০ জন মানুষের মধ্যে একজন এ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অনেকে বুঝতেই পারেন না, ফলে সাধারণ মাথাব্যথা মনে করেই সহ্য করে যান বছরের পর বছর।
টিটেনাস
টিটেনাস একটি রোগ যা শরীরের কেটে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় Clostridium tetani নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়। এ ব্যাকটেরিয়া শরীরের বাইরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং শরীর প্রবেশ করার পর এক ধরনের বিষ নিঃসরণ করে। এ বিষের প্রভাবে শরীরের বিভিন্ন পেশিতে টান পড়ে এবং প্রচন্ড ব্যথার উৎপত্তি হয়।
ইনফেকশন হবার চার থেকে একুশ দিনের মধ্যে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। এ সময় চোয়াল, হাত ও পায়ের পেশিতে টান পড়ে, সাথে থাকে প্রচন্ড ব্যথা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, জ্বর আসে, মাথাব্যথা, বমিও হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগী মুখ পর্যন্ত খুলতে পারে না। এ রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ফুসফুসের রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে, এমনকি হাড় পর্যন্ত ভেঙে যেতে পারে।
দাঁতের ফোঁড়া
দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া জন্মায় আর এদের কারণে তৈরি হয় পুঁজ। দাঁতের ভেতরে, মাড়িতে, এমনকি দাঁতকে ধরে রাখা হাড়ে পর্যন্ত এটি হতে পারে। যে দাঁত কিংবা মাড়িতে এটি হয়, সেখানে প্রচন্ড ব্যথা হয়। এ ব্যথা অল্প সময়েই কান, চোয়াল এবং ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শোয়ার সময় এ ব্যথার তীব্রতা আরো বেশি হয়। ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ইনফেকশন দ্রুত ছড়িয়ে গেলে জ্বর পর্যন্ত আসতে পারে। প্রচন্ড ব্যথার কারণে খাবার খাওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া
রক্তনালীর কারণে মাথার ট্রাইজেমিনাল স্নায়ুতে চাপ পড়ার জন্য এ ব্যথা হয়, যাকে অনেকে তুলনা করেন গুলি লাগার মতো কিংবা দাঁত বা মাড়িতে ইলেকট্রিক শক লাগার সাথে। এটি মুখমন্ডলের যে কোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় হতে পারে, এর স্থায়িত্ব কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট হয়। কিন্তু এর ব্যথার তীব্রতা অনেক বেশি, ভুক্তভোগী অনেকের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যথা হয় এ সময়। এই ব্যথাটি হতে পারে কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই। বেশিরভাগ সময় ব্যথা হয় মাথার যেকোনো একদিকে, তবে দু’দিকেও হতে পারে। ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু মাথায় ছড়িয়ে থাকা স্নায়ুগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই ব্যথার তীব্রতাও হয় অনেক।
৪০ বছরের কম বয়সীদের এ রোগ খুব বেশি দেখা যায় না। মূলত ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এ রোগের শুরু হয়। পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিভিন্ন প্রকার ওষুধ এবং সার্জারির মাধ্যমে এ রোগ সারিয়ে তোলা যায়।
পোড়া
পুড়ে যাওয়া চামড়া সবচেয়ে ভীতিকর ব্যথাগুলোর একটি জন্ম দেয়। পুড়ে যাওয়ার মাত্রার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মাত্রার স্কেল রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে দ্বিতীয় মাত্রার চেয়ে তৃতীয় মাত্রার পোড়ায় বেশি ব্যথা হবার কথা। কিন্তু তৃতীয় মাত্রার পোড়ায় স্নায়ুগুলো খুব বেশি বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়, ফলে ব্যথা অনুভব করার মত অবস্থা থাকে না। অন্যদিকে দ্বিতীয় মাত্রার পোড়ায় চামড়া যেমন পোড়ে, স্নায়ুগুলোও ব্যথা মস্তিষ্কে পৌঁছানোর মতো অবস্থায় থাকে। ফলে প্রচন্ড ব্যথার শিকার হতে হয় ভুক্তভোগীকে। এ ব্যথার কারণে মানুষ মারা পর্যন্ত যেতে পারে। পুড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা খুবই সাবধানে এবং যত্নের সাথে করতে হয়। কেননা পুড়ে যাবার মতোই এর চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যথাদায়ক।
হাড় ভাঙা
হাড় ভাঙা প্রচন্ড ব্যথাদায়ক একটি অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে বেশি ব্যথা হয় পাঁজর এবং ফিমার (পায়ের উপরের অংশের হাড়) ভাঙার ফলে। হাড় ভাঙার ফলে শুধু তৎক্ষণাৎ ব্যথা তো রয়েছেই, সেরে উঠার পরেও দীর্ঘদিন ব্যথা থেকে যায় অনেকের। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে কষ্ট হয়ে অনেকের।
হাড় ভাঙার ফলে সবচেয়ে বেশি ব্যথা হয় ভাঙার পর থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত। হাড়ের মধ্যে বেশ কিছু রক্তনালী রয়েছে যাদের স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞ ব্যাহত হয় হাড় ভাঙার ফলে। এ কারণে হাড় ভাঙলে ব্যথার সাথে প্রচুর ঘামও হয় ।
সন্তান জন্মদানের ব্যথা
এখন পর্যন্ত যতগুলো ব্যথার কথা বলেছি সেগুলোতে শুধু কষ্টই ছিল। কিন্তু সন্তান জন্মদানের ব্যথার সাথে প্রতিটি মায়ের থাকে সবচেয়ে বড় আনন্দ, মাতৃত্বের আনন্দ। তবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাবার ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক না। আধুনিক চিকিৎসা আসার আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রচুর মায়ের মৃত্যু হতো, এখনো অনেক মায়ের মৃত্যু ঘটে। WHO-এর তথ্যমতে প্রতিদিন প্রায় ৮৩০ জন মা মারা যান সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে! এর মধ্যে ৯৯% মৃত্যুই হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।