মানুষের দীর্ঘায়ুর পূর্বশর্ত হলো শরীর ও মনের সুস্থতা। তবে কেবল দীর্ঘদিন সুস্থ থাকার জন্যই যে শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের প্রয়োজন, তেমনটি নয় কিন্তু। অর্থাৎ, সুস্থ থাকলেই দীর্ঘদিন বাঁচবো এটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। বরং এই দীর্ঘ আয়ুর স্বল্প জীবনে আমাদের করতে হয় বিভিন্ন ধরনের কাজ। সেটিও করতে হয় সাধারণত ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা মানসিক শান্তির জন্য।
জন্মের ৬ বছর পর থেকে পড়াশোনা শুরু। এর মাঝে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলে মূলত আমাদের শিক্ষাজীবন। এরপর আসে নতুন এক চ্যালেঞ্জ, একটি ভালো কর্মক্ষেত্র যা একইসাথে যোগাবে অর্থ এবং মেটাবে মনের আশা। বিবাহিত জীবনের পরে একসময় আসে বার্ধক্য।
মানুষ সেই ছোটবেলা থেকেই একধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চলেছে। যে প্রতিযোগিতার শেষ তার মৃত্যুর সাথে। এই প্রতিযোগিতা সবসময় যে কেবল অন্যের সাথে, এমনটি নয়। মানুষের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সে নিজেই। রাত-দিন আমরা চেষ্টা করি, পরিশ্রম করি নিজেকে আরো ছাড়িয়ে যেতে, বর্তমান থেকে আরো ভালো উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতে। এই প্রতিযোগিতায় আমরা কেউ প্রায় সম্পূর্ণ সফল হই, কেউ হই তার থেকে কম, কেউ চেষ্টা করতে করতেই জীবনের শেষে এসে উপস্থিত হই।
মানুষের সফলতার পেছনেও থাকে কিছু গোপন সূত্র, থাকে কিছু মূলমন্ত্র। যেসব ব্যক্তি এসব সূত্র বা মূলমন্ত্র মেনে চলে, তারা সম্পূর্ণ সফল না হলেও একেবারে বিফল হয় না। কথাটিকে ঘুরিয়ে এভাবেও বলা যায় যে, যেসব ব্যক্তিকে আমরা আজকে সফল হিসেবে চিনি, তারা জীবনে এসব গোপন সূত্র কিংবা মূলমন্ত্রের প্রয়োগ করেই সফল হয়েছে। সাফল্যের এসব গোপন কৌশলের মধ্যে সহজতম একটি কৌশল হচ্ছে SWOT অ্যানালাইসিস, যা আজকের লেখার আলোচ্য বিষয়।
‘SWOT’ একটি ইংরেজি শব্দ-সংক্ষেপ। একে বিশ্লেষণ করলে হয় Strengths, Weaknesses, Opportunities and Threats, অর্থাৎ শক্তিশালী দিক, দুর্বল দিক, সুযোগ এবং হুমকি। SWOT অ্যানালাইসিসের প্রকৃত উদ্দেশ্য কোনো কিছুর শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে বের করা এবং এসব শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যকে কোন কোন প্রেক্ষাপটে কাজে লাগানো যায় সেই সুযোগ খুঁজে বের করা। আবার দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলোকে খুঁজে বের করার পাশাপাশি এসব দুর্বল বৈশিষ্ট্যের ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণ করা। পরবর্তীতে এ বৈশিষ্ট্যগুলো অপসারণের ব্যবস্থা করা।
শুরুতে SWOT অ্যানালাইসিস মূলত ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত। ব্যবসার সাফল্যের ক্ষেত্রে নানা ধরনের স্ট্রাটেজি প্রচলিত আছে। ১৯৬০ সালে এডমন্ড পি. লার্নড, কেনেথ অ্যান্ড্রুজ, সি. রোলান্ড ক্রিস্টেন্সেন এবং উইলিয়াম ডি. নামক চারজন ব্যবসায়িক গুরু এই অ্যানালাইসিসের ব্যাপারে ধারণা দেন।
এটি এমন একটি পদ্ধতি যা যেকোনো কোম্পানিকে যেকোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে শক্তি যোগাবে এবং যেকোনো কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করবে। তবে কেবল ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের আত্মিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এই কৌশলের ফলাফল চমকপ্রদ। বাস্তবিকপক্ষে যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে এই পদ্ধতি কাজে লাগানো সম্ভব।
আমরা প্রায়শই আমাদের জীবন নিয়ে নানা ধরনের হতাশায় ভুগে থাকি। শিক্ষাজীবন কিংবা কর্মজীবনসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে থাকে। ঠিক যেমনটা ঘটে থাকে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বার বার বিফল হয়। কিন্তু ঠিক কী কারণে বিফল হচ্ছে, সেটা তারা খুঁজে বের করতে পারে না। আবার তাদের যেসব সম্ভাবনাময় দিকগুলো আছে সেগুলো কোন খাতে কাজে লাগানো যায়, সেগুলো নিয়েও তারা কোনো বিশ্লেষণ করে না। যে কারণে তাদের পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকা হয়ে পড়ে দুরূহ।
মানুষের জীবনেও এমন সমস্যা আসে। বলা যায়, প্রায় প্রত্যেকের জীবনেই এসব সমস্যা আসে। তখন মানুষ কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সেইসব ক্ষেত্রে আমরা SWOT এ্যানালিসিসের প্রয়োগ করতে পারি। তবে ব্যপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, আদতে ঠিক অতটা সহজও হয়তো নয়। কারণ অধিকাংশ মানুষই নিজেদের সম্ভাবনাময় কিংবা দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিকভাবে খুঁজে বের করতে পারে না।
তো এখন জানা যাক, কীভাবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে SWOT অ্যানালাইসিস করতে পারি। এই অ্যানালাইসিস করার জন্য নিচের মতো একটি ছক তৈরি করে নিতে পারেন।
Strengths বা সম্ভাবনাময় দিকসমূহ
নিজের শক্তিশালী বা সম্ভাবনাময় দিকগুলোকে প্রথমে বের করা অনেক জরুরি। কারণ এসব সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্যের উপরেই নির্ভর করছে আপনার জন্য কেমন সুযোগ আছে। এই শক্তিশালী দিক বলতে কেবল আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতাই বোঝায় না। ভালো রেজাল্ট আপনার সম্ভাবনাময় দিকগুলোর একটি। আপনার কর্মদক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাও আপনার শক্তিশালী দিক।
এছাড়া আপনার আত্মবিশ্বাস, সাধারণ জ্ঞান, আপনার মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা, প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা, এমনকি আপনার ভৌগোলিক অবস্থানও আপনার সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্য হতে পারে। যেমন, কেউ ভালো গান গাইতে পারে, কেউ ভালো নাচতে পারে, কারো হয়তো কমিউনিকেশন স্কিল অনেক ভালো, কেউ কেউ আবার কঠিন পরিশ্রম দিতে পারে ইত্যাদি। এগুলো সবই হচ্ছে Strengths। এগুলোকে Strengths এর ঘরে তালিকাবদ্ধ করে নিন।
Weaknesses বা দুর্বল দিকসমূহ
নিজের সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে বের করাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, নিজের দুর্বলতম দিকগুলো খুঁজে বের করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আপনি হয়তো আপনার চরিত্রের কোনো একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন না। কিন্তু হতে পারে এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই আপনি সফল হতে পারছেন না। কাজেই সঠিকভাবে নিজের দুর্বলতম দিকগুলো নির্ণয় করা জরুরি। এখানে কোনো প্রকার ইগো থাকা উচিত নয়।
এসব দুর্বল দিকের মধ্যে থাকতে পারে আপনার ছোট-বড় খারাপ অভ্যাসগুলো, যেগুলোকে আপনি স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছেন। শিক্ষা বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, কর্মদক্ষতা বা অভিজ্ঞতার স্বল্পতা, শারীরিক অসুস্থতা, দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাবসহ যত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে এগুলো সবই হচ্ছে কোনো মানুষের দুর্বলতা। এগুলোকে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে এবং এসব নেতিবাচক মনোভাব থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে।
Opportunities বা সুযোগসমূহ
আমরা সবাই আসলে সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। আজকে যার সময় খারাপ, সে অপেক্ষা করে কখন সুযোগ আসবে ঘুরে দাঁড়ানোর। সকল সফল ব্যক্তিই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার কথা বলেছেন। তো, সুযোগ বলতে আসলে কী বুঝি আমরা? সুযোগ বলতে বোঝায়, যদি কখনো পারিপার্শ্বিক অবস্থা আপনার অনুকূলে থাকে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
কেউ একজন একটি কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করবে। কোম্পানির দরকার একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ঐ ব্যক্তি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। কাজেই কোম্পানি তাকে নিতে পারবে না। এখন যখন কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিবে, তখন এই ব্যক্তি আবেদন করতে পারবে এবং কপাল ভালো থাকলে চাকরিও পেতে পারে। এই যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ঐ ব্যক্তির অনুকূলে, এটিই সুযোগ।
আপনার যোগ্যতা এবং তালিকাবদ্ধ সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্যগুলোর উপরে ভিত্তি করে খুঁজে দেখতে পারেন যে এই মূহুর্তে আপনার জন্য কী কী সুযোগ অপেক্ষা করছে।
Threats বা হুমকিসমূহ
এই হুমকি মোটেই আপনার জীবননাশের হুমকি নয়। তবে ব্যক্তিজীবনে সফলতার ক্ষেত্রে এই হুমকিসমূহ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এই হুমকি হতে পারে আপনার নিরাপত্তার অভাব (সেটি ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে হোক বা ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে হোক) কিংবা আপনার অক্ষমতা, দক্ষতার অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারার সম্ভাবনা।
SWOT অ্যানালাইসিসের মূল বিষয় আমরা জেনে ফেলেছি এরই মধ্যে। কিন্তু কেবল জানার মধ্যেই সীমিত রাখলে আসলে নিজের উন্নয়ন করা সম্ভব নয় কখনো। বরং এসব কৌশলের বাস্তবিক প্রয়োগেরও দরকার আছে। এতে একদিকে যেমন আমরা নিজেদের ভালো-খারাপ দিক সম্পর্কে জানতে পারব, অন্যদিকে আমাদের সম্ভাবনা কিংবা দুর্বলতা সম্পর্কেও জানতে পারব।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের সম্ভাবনাময় বা ভালো দিকগুলো জানা থাকলে সেসব দিকের জন্য কী কী সুযোগ আছে সেটি যেমন জানা যাবে, তেমনই খারাপ দিকগুলো বের করে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব হবে। কাজেই নিজেদের আত্মিক উন্নয়নে SWOT অ্যানালাইসিস করেই দেখুন!