সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কষ্ট কী, সেটা একমাত্র তারাই অনুভব করতে পারেন, যারা এই যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। প্রতিটি মুহূর্ত যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগতো, সেই মানুষটি যখন হঠাৎ করেই যোজন যোজন দূরের মানুষে রূপান্তরিত হয়, তখন পুরো পৃথিবীটা অসহ্য লাগবে এটাই স্বাভাবিক। সম্পর্ক ভাঙার হতাশা থেকে বের হয়ে আসা সহজ নয়। যতবার মনে হয় এই বুঝি সব যন্ত্রণার অবসান ঘটতে চলেছে, সব হতাশা কাটিয়ে উঠেছেন; ততবারই যেন সব শেষ হয়েও ঠিক শেষ হয় না কিছুই।
সত্যি বলতে কী, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার হতাশা বা কষ্ট কোনোটা থেকেই বের হয়ে আসার কোনো শটকার্ট পথ নেই। আপনাকে আপনার ভাঙা মন নিয়ে এই অসীম যন্ত্রণাময় পথ পাড়ি দিতেই হবে। তবে হ্যাঁ, বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে আপনি কীভাবে হতাশা থেকে বের হয়ে নতুনভাবে আবার নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন শুরু করবেন, তার জন্য কিছু পরামর্শ অনুসরণ করতে পারেন।
ক্ষমা করতে চেষ্টা করুন, ভুলে যেতে নয়
সব সময় মনে রাখবেন, ক্ষমা করা সহজ কিন্তু ভুলে যেতে চাওয়া কঠিন। স্মৃতি ভীষণ স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার, তাই চাইলেই কাউকে ভুলে যাওয়া যায় না। দেখা যায়, আপনার খুব অপছন্দের মানুষকেও আপনি ভুলে যেতে পারছেন না, কারণে অকারণে বার বার কোনো না কোনো কাজের ভেতর দিয়ে আপনার অপছন্দের মানুষগুলো ফিরে আসছে। তাহলে এবার ভেবে দেখুন, যেখানে নিতান্তই অপ্রিয় মানুষগুলোকে আপনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতে পারছেন না, সেখানে আপনার জীবনের খুব প্রিয় মানুষটিকে কী করে ভুলে যাবেন? ক্ষমা করার অপর নাম হচ্ছে মুক্তি পাওয়া। আপনি সেই মানুষটিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন মানে আপনি নিজে নিজের কাছে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গিয়েছেন। একবার চেষ্টা করেই দেখুন, দেখবেন আপনার ভাঙা মনের যন্ত্রণা হয়তো কিছুটা হলেও কমবে।
নিজেকে সময় দিন
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সাধারণত আমরা যে জিনিসটি করি, তা হলো খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়ি, একটি সম্পর্ক ভাঙার হতাশা থেকে বের হতে না হতেই আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমরা ধরেই নেই যে, প্রিয় মানুষটি ছেড়ে চলে গিয়েছে মানেই হলো আমি যেন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। আর নিঃস্ব অবস্থা এবং একাকীত্ব যত দ্রুত দূর করা যায় ততই মঙ্গল।
একটি ভাঙা সম্পর্ক থেকে কিন্তু আমরা শিখতে পারি পরবর্তীতে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী করণীয় বা কী বর্জনীয় হবে। তাই বিচ্ছেদের পর নিজেকে সময় দিন, নিজেকে আরও একটু ভালোবাসতে চেষ্টা করুন। হুটহাট করে নতুন আরেকটি সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে অবস্থা আরও জটিল করে তুলবেন না।
আপনার নেতিবাচক চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করুন
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর আমরা অনেকেই এতো বেশি হতাশ হয়ে পড়ি যে, অনেক সময় বেঁচে থাকাও অর্থহীন মনে হতে থাকে। অনেকে আত্মহত্যার মতো আত্মবিধ্বংসী চিন্তা পর্যন্ত করতে শুরু করি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, একটি সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে মানেই কি আপনার জীবনটা সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে পড়েছে? আপনার জীবন থেকে একজন মানুষের চলে যাওয়া কি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তার প্রস্থানের জন্য আপনাকে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিতে হবে? আপনাকে এই নেতিবাচক চিন্তার পুরোপুরি বিপরীতে যেতে হবে, প্রমাণ করতে হবে আপনি এতোটা দুর্বল, এতোটা ঠুনকো নন। আমাদের জীবনটা নানা চমকে পরিপূর্ণ। আজ এমন কারো জন্য আপনি নিজেকে শেষ করে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না, যে কিনা আপনাকে ছেড়ে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি, সেই আপনার জন্যই হয়তো এমন কেউ অপেক্ষা করে আছে, যে আপনার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
ইতিবাচক মনোভাব সম্পন্ন মানুষদের সাথে থাকতে চেষ্টা করুন
আপনার এই চরম মানসিক বিপর্যয়ের সময়টায় সেসব মানুষের সাথে থাকতে চেষ্টা করুন, যারা আপনার ভালো চায় আর আপনি যাদের সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে একজন মানুষ মানসিকভাবে নিতান্তই ভেঙে পড়েন, এখন এই অবস্থার মধ্যে যদি আশেপাশের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত চোখে আঙুল দিয়ে সবটা বার বার সামনে নিয়ে আসে অথবা কটু কথা বলতে থাকে, তাহলে ভাঙা মন আবার জোড়া লাগা সত্যিই অসম্ভব। চারপাশে ইতিবাচক ও সহায়ক মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ থাকলে আপনি খুব দ্রুতই আবার নিজের উপর আস্থা ফিরে পাবেন।
অতীত কে অতীতেই থাকতে দিন
“It really is impossible to move forward if you’re always looking backward.”
– Marie Forster
যদি সত্যিই চেয়ে থাকেন অতীতের গ্লানি থেকে বের হয়ে আসবেন, তাহলে বারবার সেই অতীতেই ফিরে যাবেন না। বলছি না সবটা ভুলে যেতে হবে, শুধু চেষ্টা করুন অতীতের ভাঙা সম্পর্কটিকে একটি শিক্ষা হিসেবে নিতে, পাথেয় হিসেবে নয়। এটা সত্যি যে, আপনি যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, সে অবস্থায় অতীত থেকে বের হয়ে আসা বেশ কঠিন। আর এজন্যই সবার আগে সময় নিতে হবে, নিজেকে সময় দিতে হবে। যখন বুঝতে পারবেন যে আপনি এখন মানসিকভাবে দৃঢ়, ঠিক তখন থেকেই অতীত আপনার জন্য শুধুই অতীত। আপনার লক্ষ্য এখন সামনে এগিয়ে চলার, পিছন ফিরে চোখের পানি ফেলার নয়।
দায়িত্ব নিতে শিখুন
মনমরা হয়ে নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে ফেলা ভালো সিদ্ধান্ত হবে না, যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এবার নিজেকে বা ভালোবাসার মানুষটিকে দোষারোপ করে হা-হুতাশে জীবন অতিবাহিত না করে পরিবার, বন্ধু বা কাছের মানুষগুলোর ভালো থাকার জন্য ছোটখাটো দায়িত্ব নিন। যখন দেখবেন সামান্য কিছুতেই আপনি কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারছেন তখন আর সব অপ্রাপ্তি এবং কষ্টগুলো ম্লান হতে থাকবে। কাউকে সুখে রাখতে পারার মধ্যে যে অসীম মানসিক শান্তি লুকিয়ে থাকে, সেই প্রাপ্তির কাছে অপ্রাপ্তির কষ্ট কিছুই না।
যা করতে ভালো লাগে তা-ই করুন
সত্যি বলতে কী, ভাঙা মন নিয়ে কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করা অনেক কঠিন, দেখা যায় এক সময় যা আপনার দারুণ প্রিয় ছিল তাতেও আর কোনো আগ্রহ পাচ্ছেন না। কিন্তু সম্পর্ক ভাঙার হতাশা থেকে বের হয়ে এসে জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে এসব কিছুর উপর আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে হবে। আপনার যা মন চায়, যেভাবে আপনি নিজেকে আবার প্রাণোচ্ছল করে তুলতে সক্ষম বলে মনে হয়; সেটাই করুন। যদি বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে কিছুটা চাঙা অনুভব হয় তবে তা-ই করুন। যদি মনে হয় সবকিছু থেকে বের হয়ে আসতে আপনার বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া দরকার তবে সেটাই করুন। এটা প্রমাণিত যে, আপনি যত বাইরের সাথে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন, তত দ্রুত সবকিছু থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। পরিবারের সাথে সময় কাটান, বাইরে ঘুরতে যান, পছন্দের কোনো রেস্টুরেন্ট খেতে যান, ছবি আঁকতে ভালো লাগলে ছবি আঁকুন, সিনেমা দেখুন, প্রাণ খুলে হাসুন। সহজ কথায়, নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, দেখবেন হতাশা কাটতে শুরু করছে।
নিজের প্রতি যত্নবান হোন
‘Eat well, sleep well, and exercise’
খেতে ইচ্ছে করবে না, ঘুম হবে না- এগুলো এ সময় খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে গেলে আপনাকে নিজের প্রতি আরও বেশি যত্নবান হয়ে উঠতে হবে। পরিমিত পুষ্টিকর খাবার খান, তাজা ফলমূল খান। ঘুমাতে চেষ্টা করুন আর অবশ্যই ব্যায়াম করুন। শরীর চনমনে থাকলে মন ভালো হতে সময় লাগবে না।
একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানে জীবনের শেষ নয়, বরং নতুন করে আবার সবকিছু শুরু হওয়া। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে আবার প্রস্তুত করুন, সমস্ত খারাপ চিন্তা-ভাবনার বিপরীতে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করুন। আপনার মধ্যে কী কী গুণ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগান। কমপক্ষে এই সময় নিজের মনের কথাগুলো শুনুন, যদি মনে হয় ভেঙে যাওয়া সম্পর্কে আপনারও কিছু ভুল ছিল, তাহলে সেটা শুধরে নিতে চেষ্টা করুন। তবে ভুলেও সারাজীবনের জন্য নিজেকে অপরাধী করে রাখবেন না নিজের কাছে। এই মানুষই ভুল করে, আবার মানুষই নিজেকে শুধরে নেয়।