প্রতিদিন কাজের মাঝে আমরা কতই না ভুল করে থাকি। মানুষের পক্ষে তো আর সবসময় শতভাগ সঠিক থাকাও সম্ভব না। তবে কিছু সময় আমরা এমন কিছু ভুল করে বসি যার জন্য আমাদের স্বাভাবিক জীবনে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় এবং এই ভুলের কোনো সমাধানে না পৌঁছাতে পারলে হয়তো কিছু সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য যত বড় ধরনেরই ভুল হোক না কেন, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের ক্ষমা চাওয়া এবং এই ভুলের সমাধান বের করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকে না।
একটি ঘটনার কথা চিন্তা করি। ক্লাসে শিক্ষক আপনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন কিন্তু আপনার বন্ধু সেটি জানে না। কারণ সেদিন সে কোনো এক কারণে ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলো। আপনাকে আগে থেকেই বলা ছিলো যে, শিক্ষক ক্লাসে যা পড়া দেন সেটি যেন আপনার বন্ধুকে আপনি জানিয়ে দিন। কিন্তু কোনো এক কারণে আপনি আপনার বন্ধুকে অ্যাসাইনমেন্টের কথা জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। যখন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার তারিখ ঘনিয়ে আসলো এবং আপনার বন্ধু শেষ মুহূর্তে এর ব্যাপারে জানতে পারলো, তখন তো সে রেগে আগুন! ভুল যেহেতু আপনার ছিলো, তাই আপনাকে অবশ্যই ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। তা না করলে হয়তো আপনাদের বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে! তাহলে এরকম অবস্থায় আপনি পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন?
শুরুতে জেনে নিই “ক্ষমা চাওয়া” কথাটি দ্বারা আমরা কী বুঝি এবং এই ক্ষমা চাওয়ার কাজটি করা এত কঠিন কেন। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে না কাউকে আমাদের কাজ অথবা আচরণ দ্বারা আঘাত করে ফেলি। এর পরিণাম হতে পারে মারাত্মক। ক্ষমা চাওয়ার মানে হলো, আপনি আপনার ভুলের জন্য যথেষ্ট অনুতপ্ত। আপনি এমন ভুল ভবিষ্যতে আর করবেন না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আপনি একবার ক্ষমা চেয়ে যদি একই ভুল আবার করেন, তবে সেটা কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে পরে না। আর ভুল উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কাজটাও অতটা সহজ না। একটি ভুল করে ফেলার পর থেকেই আপনার মধ্যে অনুশোচনা কাজ করতে থাকে। ক্ষমা চাওয়ার আগে আপনার মাথায় এই চিন্তা কাজ করে যে, “ক্ষমা চাইতে গিয়ে আবার অপমানিত হয়ে আসবো না তো?” ভুল যেহেতু করেই ফেলেছেন, সেহেতু কিছুটা হলেও অপমানের শিকার হবেন সেটা ধরে নিয়েই ক্ষমা চেতে হবে। তাছাড়া সবসময় যে অপমানিত হবেন এমন তো না। হতেই পারে আপনার ভালোর জন্যই অপরপক্ষ আপনার ভুল আগে থেকেই ক্ষমা করে রেখেছে! তাই সব ভুলের অনুশোচনা থেকে ক্ষমা চাওয়ার আগে সব রকম বাঁধা ঝেরে ফেলুন। নিজের সামনে যত বেশি বাঁধা তৈরি করে রাখবেন, অনুশোচনার চাপ তত বেশি বাড়তে থাকবে।
কীভাবে সুন্দর করে ক্ষমা চাইবেন এটা নিয়ে অনেকের অনেক ধরনের মতামত আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদর্শ যে নিয়মটিকে ধরা হয়, সেটি হলো বিখ্যাত কফিশপ স্টারবাক্সের LATTE থিওরি। তাদের বিখ্যাত কফি Latte এর নামেই এর নামকরণ। এই LATTE এর পাঁচটি বর্ণ পাঁচটি আলাদা অর্থ প্রকাশ করে। L = listen, A = acknowledge, T = take action, T = thanks এবং E = explanation। দোকানের অতিথিদের রাগ সামলানোর জন্য স্টারবাক্স এই পন্থা আবিষ্কার করে। আজ আমরা এই LATTE থিওরি নিয়েই আলোচনা করবো এবং এর মধ্য দিয়েই উপরের সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করবো।
পরিস্থিতি শুনে বোঝার চেষ্টা করুন
শুরুতেই আপনার বন্ধু অথবা অপরপক্ষ কী কারণে আপনার উপর রেগে আছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। তার পুরো কথা শুনুন এবং তার সম্পূর্ণ রাগ আপনার উপর ঝেড়ে দিতে দিন। তার কথার মাঝে আপনি কোনো কথা বলবেন না। শুধু কথা শুনবেন এবং খেয়াল করে যাবেন। রাগ একবার ঝাড়া হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তা অনেকটা কমে আসে। আপনি যদি এর মাঝে কথা বলে ফেলেন, তাহলে আপনার বন্ধু মনে করতে পারে আপনি তার কথার মাঝে আপনার অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করছেন। বিষয়টা তিনি ভালোভাবে না-ও নিতে পারেন। তাই তার কথা বলার মাঝে আপনি কোনো অভিযোগ না তুলে কেবল শুনে যাবেন। এটা হলো আপনার বন্ধুর রাগ ভাঙানোর জন্য প্রথম ধাপ।
নিজের ভুল স্বীকার করে নিন
পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই নিজের ভুল স্বীকার করে নিন। আপনি যখনই ভুলটা নিজের বলে মেনে নিবেন তখনই আপনার বন্ধু বা অন্য যে কেউ আপনার উপর রাগ করে থাকলে তার রাগ অনেকটা কমে যাবে। কারণ এখানে আপনি পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করছেন না। বরং নিজের ভুল মেনে নিয়েছেন। অর্থাৎ আপনি আপনার ভুলের ব্যাপারে অবগত আছেন এবং এর জন্য কী করণীয় তা নিয়ে কথা বলতেও আপনি আগ্রহী আছেন। তাই কারো রাগ ভাঙানোর দ্বিতীয় ধাপ হলো, সময় থাকতেই নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়া।
সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নিন
যেহেতু আপনার একটি ভুল হয়ে গিয়েছে এবং অতি শীঘ্রই এর একটি সমাধানে আসা জরুরি, সেহেতু আপনার বন্ধুকে বোঝাতে পারেন যে আপনি এই সমস্যার একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করছেন। যেহেতু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার তারিখ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আপনি আপনার বন্ধুকে নিয়ে স্যারের কাছে যেতে পারেন যাতে তিনি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার শেষ তারিখটি বাড়িয়ে দেন। এতে আপনার বন্ধু সমস্যার সমাধানের দিকে যাওয়ার একটি আশা দেখতে পাবে।
আপনার উপর রাগ ঝাড়ার জন্য একটি ধন্যবাদ দিন
সাধারণত যেটা হয়, কারো উপর যদি রাগ থাকে সেটা অনেক মানুষ সামনাসামনি জানায় না। বরং ভেতরে এই রাগ পুষতে থাকে এবং একপর্যায়ে সেই মানুষটির সাথে সম্পর্কের দূরত্ব কেবল বাড়তেই থাকে। আপনার বন্ধু যে আপনার সাথে এই কাজ না করে বরং রাগটা ঝেড়ে দিয়েছে, সেটার জন্য তাকে একটি ধন্যবাদ আপনি দিতেই পারেন। এই রাগটা যদি সে কোনোদিন প্রকাশ না করতো, তাহলে হয়তো আপনাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে একটি ফাটল ধরে যেতে পারতো। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার ভুলের জন্য একটি সম্পর্ক ভেঙে যাক! তাই অবশ্যই আপনার বন্ধুকে একটি ধন্যবাদ দেবেন এবং সম্ভব হলে তাকে কিছু খাওয়াতেও পারেন।
সবশেষে আপনার ভুলের কারণ ব্যাখ্যা করুন
বন্ধুর সাথে চা পান করতে করতে কেন আপনি অ্যাসাইনমেন্টের কথা তাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন, তা তুলে ধরতে পারেন। এটা যে অবশ্যই বলতে হবে এমনটা না। আপনার মূল কাজ হলো সমস্যার সমাধান বের করা। সেটা হয়ে গেলে পরে আপনার যদি কিছু বলার থাকে তা বলুন এবং আপনার ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। এর ফলে আপনার ব্যাপারে আপনার বন্ধুর যদি ভুল কোনো ধারণা থাকে, তাহলে তা কেটে যাবে।
তাহলে এটি হলো আমাদের উপর কারো রাগ জমে থাকলে তা নিরসন করার কার্যকর একটি পদ্ধতি। পরবর্তীতে আমাদের উপর কারো রাগ থাকলে আমরা লাট্যে থিওরির কথা মাথায় রাখবো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে যাবো।
ফিচার ইমেজ: calaveralma.com.ar