আধুনিক কর্মক্ষেত্র মিটিংয়ে ভরপুর, সকালে বিক্রয় প্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিং, তো দুপুরে প্রকৌশলীদের সাথে। বিকালে উপর মহলের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে মিটিং এমনকি বাড়ি ফিরে রাতে আটলান্টিকের ওপারের কোনো দেশের ভিনদেশী গ্রাহকের সাথেও অনলাইন মারফত মিটিং করতে হয়ে থাকে। সমস্য হলো অধিকাংশ মিটিংই বিরক্তিকর আর তর্কাতর্কিতে ভরা থাকে, ফলে মিটিং জিনিসটা রীতিমতো সবার কাছেই এড়ানো গেলে ভালো হয় এমন হয়ে দাঁড়ায়।
মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং আগামীকাল (ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক মিনিট বা ঘন্টা পর) কী করা হবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বশর্তই হলো বিতর্কের মধ্য দিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছানো, কিন্তু গঠনমূলক কোনো বিতর্কই যদি করা সম্ভব না হয়, তবে মিটিংয়ের কোনো মানেই থাকে না।
মিটিংয়ে পক্ষ-বিপক্ষ যখন একটা ভালো ও ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব নিয়ে বসে, তখন তারা নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, বিকল্প সমাধান নিয়ে ভাবে, একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ করে, লঘিষ্ঠ মতামত আমলে এনে শোনে এবং যাবতীয় ধ্যানধারণা সূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে। এখানে সমস্ত অংশগ্রহণকারী কথা বলতে পারে কোনো ভয় বা সংকোচ ছাড়াই।
কিন্তু পৃথিবীর পুরোটাই চোখ জুড়ানো সবুজ প্রান্তর নয়, এর মাঝে রয়েছে কঠিন আর অমার্জনীয় মরুভূমির রুক্ষ্ণ প্রান্তর। একইভাবে মিটিংয়ে সবসময় ভারসাম্যপূর্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ না-ও থাকতে পারে। এবং আমরা প্রত্যেকেই মিটিংয়ে মতবিরোধ, নিজের অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরতে লজ্জা পাওয়া, ব্যক্তিগত আক্রমণে ক্ষুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত থাকি। তাহলে কি একটা আদর্শ মিটিং নিয়ে ‘এমন যদি হতো’ এই চিন্তা মাথায় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে হবে ? মোটেও না, বরং বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেকে তৈরী করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোর্টেন হ্যানসেনের সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে এক চমকপ্রদ তথ্য। হ্যানসেনের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কাজেকর্মে যারা বরাবরই ভাল, তারাই সচরাচর মিটিংয়ে কঠোর আলোচনা করে থাকে। তার গবেষণা কর্মের উপর প্রকাশিত বইয়ে দেখা যায়, তিনি সর্বমোট ৫,০০০ ব্যবস্থাপকের সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষণাটি করেন, যেখানে তিনি জেষ্ঠ, কনিষ্ঠ বিভিন্ন নির্বাহীদের কর্মপন্থা ঘাঁটাঘাটি করে সেগুলোর সাথে কর্মদক্ষতার সংযোগ স্থাপন করেছেন। এবং সবশেষে ছয়টি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সেগুলো আলোচনা করা যাক।
প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করুন, নিজের মত চাপিয়ে দিয়ে নয়
প্রায় সময়ই মিটিংয়ে বড়কর্তা শুরুতেই বলেন যে ‘আমি মনে করি আমাদের এটা করা উচিত, আপনাদের কি মনে হয়?’, পরবর্তী দৃশ্য কল্পনা করা সহজ। সবাই ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বিনা বিতর্কে, বিনা বাক্যে মেনে নিয়ে বলবে ‘জ্বি স্যার, এটাই ঠিক’। আপনি যদি সত্যিই কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা চান তাহলে প্রথমেই আপনাকে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে, আর সে জন্যে আলোচনা শুরু করতে হবে প্রশ্ন দিয়ে। এতে মূল ‘সমস্যা’ চিহ্নিত হবে এবং এ জন্যে সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা জরুরি। এতে প্রমাণিত হবে যে আপনি চান সবাই অংশগ্রহণ করুক।
প্রশ্নটি যেন ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন ‘আমাদের এটা করা উচিত নয়, তাই না?’। এই প্রশ্নে প্রচ্ছন্নভাবে একমত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া আছে। ফলে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকে।
নীরব মানুষকে বলতে দিন
সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পরও অনেকে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে, বিশেষ করে নতুন ও কনিষ্ঠ কর্মচারীরা। এছাড়াও অনেকে কৌশলগত কারণে চুপ থাকে, অন্তর্মুখীরা তর্কাতর্কির অস্বস্তি এড়াতেও চুপ থাকে। এসব মানুষদেরকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে, নতুবা অনেক সম্ভাব্য সমাধান অজানাই থেকে যাবে।
এজন্যে যেটা করতে পারেন তা হলো মিটিংয়ের শুরুতেই উন্মুক্তভাবে কিছু মন্তব্য আহ্বান করতে পারেন। যেমন শুরুটা করতে পারেন ‘আপনাদের অনেকেরই সমস্যা নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ রয়েছে, সেগুলো আমাদের জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’, এবং কোনো মতামত শোনার পরে তাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না। সবাইকে বলতে দিলে আপনার সুবিধা হচ্ছে একটা সম্মিলিত জ্ঞানের অংশ আপনিও পাবেন।
অধস্তনদের ঝুঁকি নিতে দিন, শুধু বাঘই যেন রাজত্ব না করে
মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিরাপদ, এমন একটা পরিবেশ গড়ে তুলুন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমি এডমন্ডসনের ভাষায়, ‘এমন পরিবেশ, যেখানে মানুষ কাজকর্ম সম্পর্কিত চিন্তা ও অনুভূতি নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পারে’। অধ্যাপক হ্যানসেনও তার গবেষণায় দেখেছেন, ঝুঁকি নেয়ার মতো অনুমতি ও পরিবেশ দেয়া হলে প্রায় ১৯% (৫,০০০ জনের ভেতর) মানুষ ভাল কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন।
এ জাতীয় পরিবেশ তৈরী করতে আপনাকে পুরো মিটিং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে খুবই সাবধানে। যেমন- কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পরামর্শ শোনার পর সেটা আমলে নিয়ে কিছুটা প্রশংসা করতে পারেন। আবার অনেকেই থাকবে যারা এ জাতীয় কিছু শোনার পরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে দুটো কটূ কথাও শুনিয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে আপনিও বলতে পারেন ‘মিটিংয়ের ভেতর আমি এ জাতীয় মন্তব্য আশা করি না’।
সমস্ত অনুমানসমূহ ভালভাবে ব্যবচ্ছেদ করুন
প্রায় সময়ই অনুমানের উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ফলে অনুমানটি কতটুকু সঠিক সেটা নিরূপণ করে নেয়া জরুরী। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে যখন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদারদের রীতিমতো দিশেহারা অবস্থা, তখনও এই অনুমানে যুদ্ধ করে চলেছিলো যে চীনারা খুব শীঘ্রই সৈন্য পাঠাবে। শুধু এই অনুমানের উপর ভিত্তি করেই তারা আত্মসমর্পণ না করে গোঁয়ার্তুমি করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু অনুমানটি ছিলো ভুল। একইভাবে মিটিংয়ে সবাই মিলে যাবতীয় অনুমানসমূহ একটা একটা করে ব্যবচ্ছেদ করে নিশ্চিত হতে হবে সেটা আসলে কতটা নির্ভরযোগ্য।
Contrarian এর মতামত আমলে নিন
বাংলা ভাষায় contrarian এর ভালো প্রতিশব্দ নেই, এর অর্থ দাঁড়ায় ‘যে ব্যক্তি জনপ্রিয় কোনো মতামতকে বিরোধিতা বা বাতিল করে দেয়’। মাঝেমধ্যে নতুন কিছু বের করে আনতে চাইলে ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাকে প্রচলিত মতের বিরোধীতা করতে হতে পারে, এটা মানুষকে অনেকটা উসকে দেয় সঠিক মতটি তুলে ধরতে। আমেরিকান এক্সপ্রেসের সিইও হার্ভে গলব যেটা করতেন তা হলো, মিটিং যদি দাম বাড়ানোর জন্যে হয়, তিনি অবস্থান নিতেন দাম কমানোর পক্ষে। এটা মিটিংয়ের অন্যান্য সদস্যদেরকে একটা শক্ত যুক্তিতর্কের দিকে ঠেলে দেয়। হার্ভে গলবের ভাষায়, ‘আমি মাঝে মধ্যে উদ্ভট উত্তর দিই, এতে আমি আশা করি কেউ না কেউ বিরোধিতা করে সঠিক সমাধানটা বের করবে’। আপনি আপনার অন্য কোনো সহকর্মীকে এ জাতীয় কাজে নিয়োজিত রাখতে পারেন যুক্তিতর্ক তৈরীর খাতিরে।
নেতিবাচক ধ্যানধারণা চাপিয়ে দেয়া
আপনি যখন কোনো ব্যবহৃত গাড়ির দোকান থেকে গাড়ি কিনতে যাবেন, তখন দোকানের বিক্রেতা যেটা করবে তা হলো ফলাও করে গাড়ির কী কী জিনিস ভালো সেগুলো তুলে ধরবে। কিন্তু ব্যবহৃত এই গাড়ির কী কী জিনিস নষ্ট সে ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত দেবে না। মানুষের মনস্তত্ত্ব এরকমই, একই জিনিস মিটিংয়েও ঘটবে। মিটিংয়ে সবসময় সবাই ইতিবাচক জিনিসগুলোই তুলে ধরবে, এতে মূল সমস্যা আড়ালে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নিশ্চিত তথ্যের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে থাকে, অর্থাৎ যখন কোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত থাকে, তখন মানুষ ঐ তথ্যের প্রতি ওকালতি করা শুরু করে। আপনি এই প্রবণতাকে মিটিংয়ে ব্যবহার করতে পারেন। আপনি নেতিবাচক কোনো তথ্য চাপিয়ে দিতে পারেন। যেমন ‘আপনারা কাল যখন মিটিংয়ে আসবেন প্রত্যেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ন্যূনতম পাঁচটি ঝুঁকি তালিকা আকারে নিয়ে আসবেন’ অথবা ‘ধরে নিন, আপনাদের প্রত্যেকের পরামর্শ ব্যর্থ হবে, সেক্ষেত্রে কারণ কী কী হতে পারে বলে আপনারা মনে করেন?’। এর ফলে ঝুঁকি নিরূপণ করতে সুবিধা হবে।
একটি মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো বিতর্কের মাধ্যমে একটি ভাল সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, সে আপনি ব্যবস্থাপক হোন আর অধস্তন। উপরের পরামর্শগুলো অনুসরণ করে মিটিংয়ে বিতর্কের মান উন্নত করার মাধ্যমে ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন।
ফিচার ছবি- hortonmarketingsolutions