প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন মানুষের এই পৃথিবীতে প্রতিদিন কত ঘটনাই তো ঘটে। তার খুব কমই আমরা জানতে পারি। যতটুকু জানার সুযোগ হয়, তার সব আমরা মনে রাখি না। আবার, সব ঘটনাই আমাদের অবাক করে না। সৃষ্টিকর্তা কিছু কিছু কাহিনীর চিত্রনাট্যে এতটা নাটকীয়তা দিতে ভালোবাসেন যে, আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। ঠিক এমনি এক ঘটনার গল্প শোনাবো, যে গল্পের নায়ক একজন বাবা। যার ত্যাগ, সংগ্রাম আর প্রার্থনার কাছে হেরে গিয়েছিল অনেক কিছুই। পাঠক, তবে চলুন দেরি না করে জেনে আসি সেই গল্প।
পুরো নাম সায়েদুল আশরাফ কুশল। বাবা মায়ের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। ২০০২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল এন্ড কলেজ (বুয়েট ক্যাম্পাস) থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৪ সালে নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন তুখোড় ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই নিজের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়া। সেই স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতেই ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় সুষমা রেজা রাখির সাথে, যিনি ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। তারপর তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব থেকে ভালো লাগা। এভাবেই তাদের সম্পর্কের শুরু।
সময়টা ২০০৬ সালের কোনো এক বিকেল। প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে হঠাৎ জানতে পারেন, ‘স্ত্রী রোগ’ থাকার কারণে সেই প্রিয় মানুষটার মা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। একজন পুরুষের কাছে বাবা হওয়ার মতো আবেগের বিষয় আর দ্বিতীয়টি নেই। ঠিক তেমনি, একজন নারীর জীবনেও মা হওয়ার মতো এতটা আত্মিক এবং স্বর্গীয় বিষয়ও আর নেই। অথচ তিনি জানতে পারেন, তিনি যদি রাখিকে বিয়ে করেন, তবে তিনিও পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তিনি পড়ে গেলেন অসম্ভব এক কঠিন সমস্যায়। কী করবেন তিনি? সব জেনেশুনেও কি তাকে বিয়ে করবেন? অনেক চিন্তাভাবনা করে নিয়ে ফেললেন জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত। প্রিয় মানুষকে বিয়ে করবেন বলেই ঠিক করলেন। এসময় তার বাবা-মাও তাকে সব রকম সহায়তা করেন। এ বিষয়ে সায়েদুল আশরাফ কুশল বলেন,
নিজেকে বোঝালাম- পুরো পৃথিবীকে না, আমার আসলে শুধুমাত্র একজন মানুষের কাছে নিজের মনুষ্যত্বের পরীক্ষাটা দিতে হবে। আমি চাইলেই তাকে হতাশার সাগরে একা ছেড়ে দিতে পারি, আবার সারা জীবনের জন্য তার পাশেও দাঁড়াতে পারি। আমার পক্ষে তাকে হতাশার সাগরে একা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
অবশেষে ২০০৭ সালের মে মাসে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ‘জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপহার’ পাওয়ার আশায় তারা ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা শুরু করলেন। এই সময়টাতে তাদের দুজনকেই অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। তারপরও তারা হাল ছাড়েননি। বিয়ের তিন বছরের মাথায় জন্ম নেয় তাদের সন্তান মাশিয়া। মাশিয়ার জন্ম একটি অলৌকিক ঘটনা। তাই, সেই সময়ে তাদের দুজনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মনে হয়েছিল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আশীর্বাদপুষ্ট দম্পতি তারাই। ডাক্তার বলেছিলেন,“ও তোমাদের বিস্ময় শিশু। আগলে রেখো।“
মাশিয়ার যখন জন্ম হয় তখন তারা দুজনই মেডিকেলে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সামনেই ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা। তাই মাশিয়ার মায়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে যায়। এই অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়া কি ঠিক হবে? সমস্যায় পড়ে গেলেন। কিন্তু কুশল তার স্ত্রীকে বললেন, পরীক্ষা দিতে। তাই সিজারের মাত্র ২১ দিনের মাথায় মাশিয়ার মা চলে যান চট্টগ্রামে। মাশিয়াকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন কুশল নিজেই।
মেডিকেলে প্রফেশনাল পরীক্ষা যে কী এক ভয়াবহ পরিশ্রম আর মানসিক চাপের নাম তা মেডিকেলের শিক্ষার্থী ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে বোঝা অসম্ভব। উপরন্তু সেটা যদি হয় ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা, তাহলে তার মতো ‘কেয়ামত’ আর নেই। আবার, একজন পুরুষের পক্ষে একটি নবজাতক বাচ্চার লালনপালন, দেখভাল করাও তার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। কিন্তু পরীক্ষার দিনগুলোর ভয়াবহতা, হাড়ভাঙা খাটুনি একজন বাবা কুশলকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। কোলে মেয়ে এবং হাতে বই নিয়ে সেই দুঃসময় পার করেছেন তিনি। এভাবেই পাস করে গেছেন পরীক্ষা।
পরীক্ষা পাসের পর নতুন আরেক সমস্যায় পড়লেন। কুশলের স্ত্রী যেহেতু চট্টগ্রাম মেডিকেলের ছাত্রী, তাই তাকে ইন্টার্নশিপও চট্টগ্রামেই করতে হবে। অনেক চেষ্টা করলেন ঢাকায় ট্রান্সফার করে আনতে। কিন্তু পারলেন না। মাশিয়াকে তাই চট্টগ্রামে তার মায়ের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ততদিনে মাশিয়ার অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই তার বাবা। সেখানে মাশিয়া তাই খাপ খাওয়াতে পারেনি। ফলে ফিরে আসে বাবার কাছে। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,
মোট দু’বছর প্রায় একা ওকে কোলেপিঠে করে বড় করি। সবাই আমাকে ডাকতো কুশল ভাই, দেখাদেখি মেয়েও আমাকে ডাকতে শুরু করলো, ‘কুতল ভাই’। নিঃসন্দেহে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল ওটা।
দুজনেরই ইন্টার্নশিপ শেষ। অনেক কষ্ট আর ত্যাগ শেষে তিনজন মিলে ভালোই কাটছিলো সময়। ঠিক এমন সময় মাশিয়ার ধরা পড়ে ‘করোনাল ক্রানিয়োসিনোস্টোসিস’ (Coronal Craniosynostosis) নামক এক ভয়ংকর রোগ। প্রতিটি শিশুর জন্মের প্রথম দুই/তিন বছর পর্যন্ত মাথার হাড়গুলোর সংযোগস্থলে ফাঁকা জায়গা থাকে। এই ফাঁকা জায়গাগুলোকে ফন্টান্যালি (Fontanelle) বলে। ফন্টান্যালি থাকে বলেই মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আস্তে আস্তে হাড়গুলো জোড়া লেগে যায় এবং ফাঁকা জায়গা পূরণ হয়ে যায়।
কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের ফন্টান্যালিগুলো নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই জোড়া লেগে যায়। ফলে মাথার ভেতরে শিশুর বাড়ন্ত মস্তিষ্ক বিকশিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পায় না। ফলস্বরূপ, শিশুর মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ হয় না। এই রোগ ধরা পড়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আক্রান্ত শিশুকে মাথার এক জটিল অপারেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু কুশল-রাখি ততদিনে দেরি করে ফেলেছেন। ডাক্তার অপারেশন না করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বললেন এবং দু’বছর সময় বেঁধে দিলেন। এই রোগের চিকিৎসা না নেওয়া হলে বা অপারেশন না করালে, পরবর্তীতে খিঁচুনী, ত্রুটিপূর্ণ মানসিক বিকাশ, মাথার আকারগত সমস্যাসহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই মাশিয়ার ক্ষেত্রেও এরকম জটিলতার সম্ভাবনা ছিল। তাই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে কুশল দম্পতির। এত প্রার্থনা, ত্যাগ আর অমানুষিক কষ্টের পর পাওয়া জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার এভাবে চোখের সামনে মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, তা ভুলেও কোনোদিন কল্পনা করেননি তারা। পুরো পৃথিবী তাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।
তবলা এবং বাশি বাজাতে খুব ভালোবাসতেন কুশল। মেয়ের সুস্থতার জন্য তা-ও ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করেন। অতঃপর চূড়ান্ত নাটকীয়তা আসে এই গল্পে। সুস্থ হয়ে ওঠে মাশিয়া কোনো অপারেশন এবং কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই! কোনোরকম জটিলতা ছাড়া এরকমভাবে বেঁচে যাওয়া হাতেগোনা কিছু শিশুর মধ্য মাশিয়া একজন! একজন বাবার ভালোবাসার কাছে কঠিন রোগও পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
বিস্ময়শিশু সেই মাশিয়া এখন দশম বছরে পদার্পণ করেছে। পড়াশোনা করে লেকহেড গ্রামার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আর সায়েদুল আশরাফ কুশল এখন নামকরা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমন কিছু কাজ তিনি করছেন, যা এর আগে কেউ এদেশে চিন্তা করেনি। লাখ লাখ মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে চলেছেন ‘লাইফস্প্রিং’ নামক একটি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমে।
সম্প্রতি এই ইনস্টিটিউট যুক্ত হয়েছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বিকাশ, গ্রামীণ ফোন, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়া হয়েছেন ‘হোপ অটিজম স্কুল’ এর চেয়ারম্যান। ব্যক্তিগতভাবে, বিনামূল্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অনেক ছাত্রের কাউন্সেলিংও করেছেন। নিজের মেয়েকে নিয়ে সেই দুঃসহ দিনগুলো থেকেই এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্ম।
সবশেষে লেখার ইতি টানবো তারই কথা দিয়ে,
স্বপ্নজয়ীদের মিছিলে সবাই চাইলেই মিশে যেতে পারে না। তাই যারা মানসিক সমস্যায় রয়েছে, আমরা যেন তাদেরকে আগে থেকে চিনতে ভুল না করি, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে ভুল না করি, বলতে ভুলে না যাই যে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্য আসবেই। নিজের জীবনকে ভালোবাসতে না পারাটাই মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জীবনের হিসাব যেন ‘জীবনে কী পেলাম না’ এটা দিয়ে না মিলিয়ে, ‘কী পেয়েছি’ বরং সেইটা দিয়ে মেলাই।