পারফিউম বা সুগন্ধি ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে হবে? মাখতে হবে সবথেকে দামি পারফিউম। অফিসে যাবো, ঘামে নেয়ে যাবে শরীর, পারফিউমটা লাগিয়েই বের হই! অনেকের আবার হরেক রকমের পারফিউম জমানোর শখ। সুগন্ধির কেনার সময় আমরা কিন্তু তেমন বাছবিচার করি না, যেটার গন্ধ ভালো লাগে কোনো চিন্তাভাবনাই ছাড়াই নিয়ে ফেলি। তবে যারা এই পারফিউমের ব্যাপারে একটু শৌখিন, তারা কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেই কেনেন।
কীভাবে তৈরি হয় এই সুগন্ধি?
যেকোনো ধরনের সুগন্ধিরই মূল উপাদান যেহেতু হাইড্রোকার্বন, তাই এর উৎস যে অসংখ্য হবে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রাকৃতিক উৎসের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুল, ফল, পাতা, ঘাস, শেকড়, মসলা, অ্যাম্বারগ্রিস, মাস্ক, খনিজ আলকাতরা ইত্যাদি। তবে বর্তমানে প্রাকৃতিক উৎসের পাশাপাশি অধিকাংশ উপাদান ল্যাবে কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষ করা হয়। তো এই উপাদানগুলো থেকে কিভাবে তৈরি করে সুগন্ধিগুলো? চলুন একটা সাধারণ ধারণা নেয়া যাক।
১। প্রথমেই পারফিউম তৈরির কারখানায় প্রয়োজনীয় উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণীজ উপাদান নিয়ে আসা হয়। সিন্থেটিক পারফিউমের অ্যারোমেটিক যৌগ তৈরি করার জন্য ল্যাবরেটরিতে রয়েছে পারফিউম কেমিস্ট।
২। এবার শুরু হবে বাষ্পপাতন। উদ্ভিজ্জ উপদানগুলোতে বাষ্প চালনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তেলকে গ্যাসে পরিণত করা হয়। এরপর সেটি যাবে বিভিন্ন টিউবে, যেখানে সেটাকে ঠাণ্ডা করে তরলে পরিণত করা হবে।
৩। দ্রাবক সংশ্লেষণের সময় ফুলকে কোনো বড় ট্যাংকে রেখে তার মধ্যে বেনজিন বা পেট্রোলিয়াম মিশিয়ে প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ করা হয়।
৪। এ পর্যায়ে ফুলগুলোকে চর্বি লাগানো কাচের উপর ছড়িয়ে রাখা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না এর গন্ধ চর্বিগুলো শোষণ করে ফেলে।
৫। এবার সেই চর্বিকে অ্যালকোহলের মধ্যে মেশানো হয় এবং তাপ দিয়ে ঘনীভূত করা হয়। ফলে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুগন্ধি তেল।
৬। এখন শুরু হবে আসল কাজ। পারফিউম অয়েল সংগ্রহের পর এটিকে এখন বিশেষ ফর্মুলার মাধ্যমে ব্লেন্ডিং করা হবে। আর এই বিশেষ ফর্মুলা তৈরি করেন একজন পারফিউমার, ইন্ডাস্ট্রি যাদের ‘নোজ’ হিসেবে চেনে। এরকম বিশেষ ফর্মুলা তৈরি করতে ৮০০ রকমের উপাদানও লাগতে পারে এবং বছরের বছর লেগে যায় এগুলো দাঁড়া করাতে। অবশেষে যখন সুগন্ধিগুলো বানানো হয়, তাতে মেশানো হয় বিভিন্ন অনুপাতের অ্যালকোহল এবং পানি।
৭। ভালো মানের সুগন্ধি তৈরিতে কয়েক মাস থেকে এক বছরও লেগে যেতে পারে। কারণ প্রতি ধাপে ‘নোজ’ পরীক্ষা করে দেখেন সঠিক গন্ধটা আসছে কি না। অর্থাৎ, প্রতিটি নোটে কাঙ্ক্ষিত সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি না সেটি পর্যালোচনা করেন পারফিউমার।
সুগন্ধির নোটস
সুগন্ধিকে সঙ্গীতের নোটের সাথে তুলনা করা হয়। একটা পারফিউমকে বর্ণনা করার মাধ্যমকেই বলা হয় নোটস। প্রত্যেকটি সুগন্ধির রয়েছে ৩টি নোটস। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে এই সুগন্ধিগুলো ৩টি পর্যায়ে তাদের বিভিন্ন সুঘ্রাণ ছড়ায়।
১। টপ নোটস (Top Notes)
একে হেড নোটসও বলা হয়। যে সুগন্ধ আপনি পারফিউম লাগানোর পরপরই পান, সেটিই হলো টপ নোটস। এই স্তরে থাকে ছোট এবং হালকা অণু যেটি খুব তাড়াতাড়িই উড়ে যায়। যেকোনো সুগন্ধির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো এটি। কারণ আমরা যখন কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ নেই তখন মূলত টপ নোটসেরই সুঘ্রাণটা পাওয়া যায়। তাই ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য এই স্তরে সবথেকে আকর্ষণীয় ঘ্রাণটাই দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পুদিনা, ধনিয়া, ল্যাভেন্ডার, বার্গামট, লেবু প্রভৃতির ঘ্রাণ পাওয়া যায় টপ নোটসে।
২। মিডল নোট (Middle Notes)
এর অপর নাম হার্ট নোটস। টপ নোটসের আভা শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে মিডল নোটসের। পারফিউমের মূল অংশই হলো মিডল নোটস। কোনো সুবাসের মূল ভিত্তি থাকে এই মাঝের নোটে যেটি সম্পূর্ণ সুঘ্রাণের ৪০-৮০%। ফুল এবং ফলের একটা সুন্দর সমাহার পাওয়া যায় এতে। হালকা অথচ স্নিগ্ধ ঘ্রাণ নিয়ে সে ধরে রাখে বেইজ নোটের কিছু বিব্রতকর বিষয়কে, ব্যবহারকারীকে নিয়ে যায় এক চনমনে সুঘ্রাণে। হার্ট নোটসের ভেতর আছে ল্যাভেন্ডার, দারুচিনি, জুনিপার, পাইন, মাস্ক, গোলাপ, জেসমিনের সুঘ্রাণ।
৩। বেইজ নোটস (Base Notes)
হার্ট নোটস যখন ম্লান হওয়া শুরু করে তখনই আগমন হয় সর্বশেষ স্তর বেইজ নোটসের। নিজস্ব ঘ্রাণের পাশাপাশি এটি হেড এবং হার্ট নোটসের ঘ্রাণও কিছুটা ধরে রাখে। এটি ঘ্রাণে নিয়ে আসে স্থায়ীত্ব, নিয়ে আসে আভিজাত্য। ভারী এবং বড় অণুগুলো থাকে এই নোটে। তাই সুঘ্রাণটা ধরে রাখে অনেকটা সময়। এই নোটের সুবাসগুলোর মধ্যে অম্বর, ভ্যানিলা, পাচৌলি, চন্দন, মাস্ক প্রভৃতি অন্যতম।
পারফিউম এবং ডিওডরেন্ট কি একই?
আমাদের অনেকেরই এই দুটোর পার্থক্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। ফলশ্রুতিতে যেটা কাপড়ে লাগানোর কথা সেটা ত্বকে লাগিয়ে চর্মরোগে আক্রান্ত! পারফিউম আর ডিওডরেন্ট দুটোই সুগন্ধি। তবে সামান্য পার্থক্য আছে। পারফিউম হলো বিভিন্ন অ্যারোমা যৌগের মিশ্রণ, যেটা কিনা কাপড়ে লাগাতে হয়। অন্যদিকে ডিওডরেন্টে থাকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক পদার্থ। যা শরীরের দুর্গন্ধকে রোধ করে। আর এটি সরাসরি শরীরে প্রয়োগ করতে হয়। পারফিউমের স্থায়িত্ব ডিওডরেন্টের তুলনায় বেশি। পারফিউমের ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর পূর্বে। সেখানে এই ডিওডরেন্ট তো উনিশ শতকের আবিষ্কার।
ডিজাইনার পারফিউম বনাম নিশ পারফিউম
ডিজাইনার পারফিউমার হলো সেই সুগন্ধি যেগুলোর সুবাস আপনি ছোটবেলা থেকে পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, প্রসাধনী দোকানগুলোতে যে সুগন্ধিগুলো সবসময়ই পাওয়া যায়, টিভি খুললেই যাদের বিজ্ঞাপন। সোজা কথায়, গতানুগতিক সুগন্ধিগুলোই হলো ডিজাইনার পারফিউম।
এখন নিশ পারফিউমের কথায় যদি আসি, সেটি এমন কিছু যা কেউ শোঁকেনি আগে! এই সুগন্ধিগুলো বানানো হয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে, দুর্লভ সব উপাদান দিয়ে, সে হাজির হয় ব্যতিক্রম কিছু নিয়ে। এধরনের পারফিউমের বিজ্ঞাপন আপনি কোথাও দেখবেন না। নিশ পারফিউমের ক্রেতাও তাই খুব বেশি না। কেবল যারা শৌখিন সুগন্ধি সংগ্রাহক, তারাই জানে এগুলোর খোঁজ। ডিজাইনার পারফিউমের নাম আপনি গুনে শেষ করতে পারবেন না। বস, ভারসাচে, ডোলচে এন্ড গ্যাবানা, কেলভিন ক্লেইন, শ্যানেল, ক্রিস্টিয়ান ডিওর, জর্জিও আরমানি, গিভেঞ্চি, গুচ্চি, বুলগেরি- এদের সবাই ডিজাইনার পারফিউম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে নিশ পারফিউম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতেগোনা- বাইরেডো, টম ডেক্সন, লে লাবো, ক্রিড, সার্জ লুটেন্স ইত্যাদি।
সুগন্ধির যত রকমফের
পারফিউমের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীবিভাগ। ধরুন, আপনি চাচ্ছেন এমন একটা পারফিউম যেটার গন্ধ থাকবে দীর্ঘ সময়। এখন আপনি বিক্রেতার কথার উপর ভরসা করে এনে দেখলেন সুঘ্রাণ তো দুই ঘণ্টাও যায় না! এজন্য জানা চাই পারফিউমের গায়ে লেখা বিভিন্ন শব্দের অর্থ যা দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন আপনি কী আপনার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটিই হাতে পাচ্ছেন কিনা।
১। পার্ফাম (Parfum)
এটিকেই মূলত বিশুদ্ধ পারফিউম বলে। এর অপর নাম এক্সট্রেইট। এতে মোট আয়তনের ১৫-৪০% অ্যারোমেটিক যৌগ বা সুগন্ধি তেল থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি ২০-৩০% এর বেশি থাকে না। এটিই সবথেকে বেশি সময় পর্যন্ত আপনার কাপড়ে লেগে থাকে। গড়ে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এটি ঘ্রাণ ছড়াতে পারে। যেহেতু এতে সুগন্ধি উপাদানের ঘনত্ব বেশি, তাই দামও অন্যদের থেকে বেশি।
২। ও ডি পার্ফাম (Eau De Parfum)
এটি একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ, সংক্ষেপে পারফিউমের গায়ে ইডিপি (EDP) লেখা থাকে। এতে ১৫-২০% মূল সুগন্ধি উপাদান থাকে। বাকি অংশ অ্যালকোহল এবং পানি। এর স্থায়ীত্ব থাকে ৪-৫ ঘণ্টা।
৩। ও ডি টোয়ালেট (Eau De Toilette):
অনেক সময় পারফিউমের গায়ে সংক্ষেপে ইডিটি (EDT) লেখা হয়। এতে থাকে ৫-১৫% সুগন্ধি তেল। মাত্র ২-৩ ঘণ্টা লেগে থাকবে এর সুঘ্রাণ। সাধারণত এটি গোসল বা শেভের পর ত্বকে সরাসরি লাগানো হয়। এটি দিনের বেলায় ব্যবহারের জন্য বলা হয়ে থাকে।
৪। ও ডি কোলন (Eau De Cologne)
এতে রয়েছে মাত্র ২-৪% অ্যারোমেটিক যৌগ, বাকি ৭০-৯০% হলো ইথানল। এ ধরনের পারফিউমের স্থায়ীত্বও তাই বেশি না। দামেও সস্তা। বাজারে পাওয়া অধিকাংশ ছেলেদের সুগন্ধিই এই ক্যাটাগরির। তরুণ প্রজন্মের কাছে এর সুঘ্রাণই জনপ্রিয়।
৫। ও ফ্রেশ (Eau Fraiche)
পারফিউমের সবথেকে হালকা সংস্করণ। ১-৩% সুগন্ধি তেল ছাড়া বাকি সবই কিন্তু অ্যালকোহল না, বরং অধিকাংশই পানি। টেনেটুনে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত সুঘ্রাণ পেতে পারেন।
পারফিউমকে যে উপরের কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায় তা নয়, গন্ধের ধরণ অনুযায়ীও একে অনেক প্রকারে ফেলা যায়। সুগন্ধি কিন্তু শুধু গায়ে লাগানোর বিষয় নয়, এর সাথে মিশে থাকে আপনার শৌখিনতা, রুচিবোধ, আর আভিজাত্য। তাই সামনের বার পারফিউম কেনার আগে একটু পড়াশোনা করেই না হয় কিনুন!
ফিচার ইমেজ: Getty Images