কিছু কিছু সংখ্যা রয়েছে ‘অপয়া’ বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অবাক হচ্ছেন তো? সংখ্যা আবার অপয়া হয় কি করে? সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে আসলে শুভ বা অশুভ সংখ্যার কোনো সংকেত নেই। দৈনন্দিন সকল প্রয়োজনে সংখ্যা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাংকে টাকা লেনদেন, জিনিসপত্র কেনাকাটা, শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে মানুষের জন্মদিন, পরীক্ষার ভাল-খারাপ সব কিছুতেই সংখ্যার আধিপত্য।
এদের মধ্যেই কিছু সংখ্যার রয়েছে বিশেষ পরিচয়। আবার কিছু সংখ্যা কালক্রমে হয়ে উঠেছে অপয়া। এই যেমন ‘১৩’ সংখ্যাটি। পৃথিবীর অনেক দেশেই, অনেক ধর্মেই এবং অনেক মানুষের কাছেই ১৩ সংখ্যাটি অপয়া হিসেবে বিশেষ পরিচিত। কীভাবে সংখ্যাটি ‘অপয়া’ হিসেবে পরিচিতি পেল, আসুন জানি সেই ইতিহাস।
১৮৬৯ সালে ইতালির বিখ্যাত সুরকার জিওচিনো এনটোনিও রোশিনি বায়োগ্রাফি থেকে আনলাকি ১৩ সংখ্যার বিশদ বর্ণনা মেলে। শুধু তাই নয়, রোশিনি নিজেও অশুভ ১৩ তারিখের এক শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। ফলে বিষয়টি আরও গুরুতর কালো সংখ্যা হিসেবে সকলের মনোজগতে প্রতিষ্ঠা পায়।
১৩ নিয়ে এই ভীতির নাম ‘ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া’। সেই সুবাদে চলুন একটা গল্প জেনে আসি। অনিন্দ্য সুন্দর মোহময় এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে ১২ জন দেবতার নৈশ ভোজের আয়োজন চলছিল। রাতে খাবার টেবিলে একসাথে বসলেন সকলে। ঠিক তখনই বিনা আমন্ত্রণে সেই ভোজ সভায় উপস্থিত হলেন ১৩তম ব্যক্তি। সকলেই হতচকিত। কারণ সেই ১৩তম ব্যক্তি ছিলেন খারাপ কাজের দেবতা স্বয়ং লোকি।
অশুভের সূচনা হলো এর পরপরই। লোকি শুরু করেন যত অশান্তি। লোকির প্ররোচনায় শীত ও অন্ধকারের দৃষ্টিহীন দেবতা হোড ভালো কাজের দেবতা ব্লাডারকে হত্যা করে। সেদিন পুরো স্বর্গপুরীতে নেমে এসেছিল শোকের মাতম। সেই থেকে ১৩তম জনের উপস্থিতি অর্থ পরের বছর আর কোনো মৃত্যু সংবাদ!
এভাবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মে ও সমাজ ব্যবস্থায় ১৩ সংখ্যাটি অপয়া হিসেবে পরিচিতি পায়। উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশের সংস্কৃতিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না।
‘১৩’ সংখ্যা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের গল্পগুলি জেনে আসি।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করে যে, ১৩তম ধাপটি জীবনের শেষ ধাপের একটি চক্র। তাদের বিশ্বাস- চক্রের ১২টি ধাপ জীবিত অবস্থায় সম্পন্ন হয়। সুতরাং ১৩ নম্বর ধাপ মৃত্যুকেই নির্দেশ করে। তাই ১৩-কে তারা মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক মনে করত। এভাবেই ১৩ সংখ্যাটির সাথে আনলাকি বা অশুভ কথাটির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছিল মিশরে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও ১৩ সংখ্যাকে অশুভ বলে মানে। তাই তারা চন্দ্র পঞ্জিকা ১৩ মাসের পরিবর্তে ১২ মাসের সৌর পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু করেন। কারণ এক সৌর বছর = ১৩ চন্দ্র মাস (Moon Months)। আর এ সব কারণে ‘১৩’ সংখ্যাটিকে এখনো অনেকেই আনলাকি মনে করেন তা কারণ মেনেই হোক বা অকারণেই হোক।
খ্রিস্ট ধর্মেও ১৩ জনের একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসাটাকে অশুভ বলে মনে করা হয়। কারণ লাস্ট সাপারে ১৩তম ব্যক্তি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জুডাস ইস্কারায়োট। পরবর্তীতে জুডাস ইস্কারায়োটই যীশুর সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন। যীশুকে যেদিন শূলে চড়ানো হয় সেদিন ছিল শুক্রবার, তারিখটিও ছিলো ১৩। তাই এখনো খ্রিষ্টানরা যেকোনো শুক্রবার ১৩ তারিখ হলে সেই দিনটিকে অশুভ হিসেবে ধরে নেয়।
ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে ব্রিটিশদেরকে মুক্তমনা বলা হলেও ১৩-এর কুসংস্কার থেকে তারাও মুক্ত নয়। ব্রিটেনে ১৩ নম্বর বাড়ি অন্য বাড়ির তুলনায় দামে কম। জুপলা নামের সম্পত্তি বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে এক জরিপ চালানো হয়। জরিপে দেখা যায়, ইংল্যান্ডে ১৩ নম্বরধারী বাড়িগুলোর আর্থিক মূল্য একই মানের অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় গড়ে প্রায় চার হাজার পাউন্ড কম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বত্রিশতম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৩ নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বাধিক দীর্ঘমেয়াদে চারবার নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট ১৩ তারিখে কোথাও সফরে যেতেন না, এমনকি হোয়াইট হাউস থেকে শুরু করে কোনো দাওয়াতেও কখনো ১৩ জন অতিথি নির্বাচন করতেন না।
কানাডার ওন্টারিওতে ১৩নং মহাসড়ক বলে কিছু নেই বা ছিলও না। ১৩ নম্বরকে কানাডিয়ানরা দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলে ভাবেন, যদিও এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। বহুদিন যাবৎ প্রচলিত কুসংস্কারের ফলে মানুষের মনে ১৩ সংখ্যাটি অপয়া হিসেবে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
এ তো গেলো বিভিন্ন ধর্মে ও দেশে ১৩ কে অশুভ হিসেবে মেনে চলার গল্প। এখন আসার বিভিন্ন ব্যক্তির উপর ১৩ সংখ্যার প্রভাব।
আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতাশালী সম্রাট। তিনি এক সময় নিজেকে দেবতাদের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেন। সেসময় গ্রীসে ১২ মাসের জন্য ১২ জন দেবতাকে মানতো গ্রীসের অধিবাসীরা। এই ১২ জন দেবতার মূর্তি বানিয়ে পূজা করতো গ্রীকরা। আলেক্সান্ডার সেই ১২ জন দেবতার সঙ্গে নিজের বিশাল আকৃতির মূর্তি তৈরি করেন। দেবতার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩। আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রীকরা ভাবতে শুরু করে, আলেক্সান্ডার ১৩তম দেবতা হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাই আলেক্সজান্ডারের জীবনে ১৩ অপয়া হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের করুণ পরিণতি ১৩ সংখ্যার বৃত্তে আবদ্ধ। সাদ্দাম হোসেন (SADDAM HUSSEIN)-কে ইংরেজীতে লিখতে লাগে ১৩টি অক্ষর। তাকে গ্রেফতার করা হয় ২০০৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর। সাদ্দাম হোসেনের করুণ পরিণতি তবে কি ১৩ এর অশুভ চক্রের প্রভাব!
এবার জানি বিভিন্ন স্থানে এবং প্রতিষ্ঠানে ১৩ সংখ্যার প্রভাব।
অ্যাপোলো ১৩-এর কথা আমরা কম-বেশি সকলে জানি। অক্সিজেনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে অ্যাপোলো ১৩-এর চন্দ্র অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে ঘটনাটি ঘটে। ফলে নভোচারীদের অনেকেরই বেঁচে থাকা দুরুহ হয়ে পড়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। আর তখন থেকে এই নম্বরটিকে আনলাকি নাম্বার হিসেবে নভোচারীদের অনেকেই বিশ্বাস করে।
একজন ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলোনোর স্থানটিকে গ্যালোচ বলা হয়ে থাকে। কোনো অপরাধী ব্যক্তির তার জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে এই গ্যালোচ। এই ফাঁসির স্থানটি ১৩টি ধাপের সিঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি মঞ্চ। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, একজন মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য ১৩টি ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
উরুগুয়ের এয়ার ফোর্স ফ্লাইট ৫৭১ বিমানটিতে আন্দিজ পর্বতে ধাক্কা লেগে আগুন ধরে যায়। দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়। একই দিনে সোভিয়েত এরোফ্লেট রানওয়ে থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে একটি লেকের ধারে বিস্ফোরণ ঘটে। ১৭৪ জনের মৃত্যু হয় ঐ ঘটনায়। সেইদিন ছিল ১৩ তারিখ। তখন থেকে মানুষ বিশ্বাস, এই ১৩ নম্বরই ছিল অঘটনের যত মূল।
Columbia Space Shuttle নভোযানটি মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ১৬ জানুয়ারি ২০০৩। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, তারিখটির সবকটি সংখ্যা যোগ দিলে দাঁড়ায় ১+৬+১+২+০+০+৩ = ১৩! মহাকাশ থেকে ফেরার সময় নভোযানটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। বিষ্ফোরণের কারণে Columbia Space Shuttle নভোযানটি ধ্বংস হয়ে যায়। নভোযানে অবস্থানকারী সকল ক্রুর দুঃখজনক মৃত্যু ঘটে।
কভেনস বলতে ১৩ জনের দল নিয়ে ডাইনি বা খারাপ লোকদের একটা দলকে বোঝায়। দলে ১৩ জন সদস্য থাকায় কুসংস্কারবশত মানুষের বিশ্বাস জন্মায় যে, যে দলে ১৩ জন থাকে সে দলের কোনো উন্নতি হয় না। এমনকি দলটির সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের একটি ইতিবাচক প্রভাব আছে। বিজ্ঞানের মুখোশ পড়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা একদিকে খুবই সহজ। বলা চলে, যত মানুষ, তত সংস্কার। বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়ার আগেই মন থেকে তিরোহিত হতে পারে, কিন্তু কোনো বিশ্বাস যখন পূর্ণ রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তা হয় সংস্কার।
কোন সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলি, কোনো কোনোটাকে ভালো মন্দ কিছুই না বলে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখি। যেমন: ১৩ সংখ্যাটি, আনলাকি থার্টিন নামেই বেশ পরিচিত। একে অনেকেই স্বভাবত এড়িয়ে চলেন, সে শিক্ষিত স্বভাবসুলভ বা অশিক্ষিত সহজাত যা-ই বলি না কেন! এটি প্রচলিত একটি কুসংস্কার যা যুগ যুগ ধরে মানুষের চিন্তা ভাবনায় মিশে আছে।