কয়েকজন পর্যটক সাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন জাপানের নিনোশিমা দ্বীপে। সময়ের কথা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন। ডুবতে থাকা সূর্য তাদের জানিয়ে দিল তারা একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছেন। শহরের দিকে দিনের শেষ ফেরি ছাড়ার সময় চলে এসেছে। দ্রুত পৌঁছানো দরকার বন্দরে। কী করবেন ভেবে না পেয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানে জিজ্ঞেস করলেন।
একজন স্থানীয় ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। “আপনারা যদি এ পথে যান তবে এখনো ফেরি ধরতে পারবেন”, একটি পাহাড়ী রাস্তা দেখিয়ে বললেন তিনি। পর্যটকরা দ্রুত সেদিকে সাইকেলের মুখ ঘোরালেন। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তারা অবাক হয়ে দেখলেন, ঐ ব্যক্তিও তাদের পেছনে দৌড়ে আসছে। তারা যাতে পথ হারিয়ে না ফেলেন তা নিশ্চিত করতে। নতুন পাওয়া বন্ধুর সাহায্যে শেষমুহূর্তে তারা ফেরি ধরতে পেরেছিলেন। সাথে পরিচিত হয়েছিলেন জাপানের ‘ওমোতেনাশি’ বা নিঃস্বার্থ আতিথেয়তার সংস্কৃতির সাথে।
ওমোতেনাশি জাপানের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অতিথিদের আপ্যায়ন ও দেখভাল করাকে তারা বিশেষ সুযোগ বলে মনে করেন। দোকান, রেস্তোরা কিংবা রাস্তায় কোনো অচেনা ব্যক্তিকে সাহায্য করা সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা এর অনুশীলন করতে সচেষ্ট থাকেন। অন্যের কোনোরকম সমস্যা না করে, সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজে শান্তি বজায় রাখতে চান তারা। এজন্যই সামাজিক শিষ্টাচার ও নিয়ম-কানুন অনুশীলনের প্রতি তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি।
জাপানে যদি আপনার মানি-ব্যাগ হারিয়ে যায়, তবে এটি চুরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ একজন তা পেয়ে কাছের পুলিশ বক্সে জমা দিয়ে যাবে। কারো ঠাণ্ডা-সর্দি হলে তারা সার্জিক্যাল-মাস্ক পরিধান করেন, যাতে অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়। বাড়ির কাজ শুরুর আগে উপহার-মোড়কে প্রতিবেশিদের ওয়াশিং পাউডারের বাক্স উপহার দেওয়া হয়, যেসব ধুলো-বালি উড়ে বেড়াবে তা থেকে কাপড় পরিচ্ছন্ন রাখতে কিছুটা সাহায্যের নিদর্শন হিসেবে।
দোকান ও রেস্তোরায় কর্মীরা আপনাকে নত হয়ে আন্তরিক অভিবাদন জানাবে। খুচরো কয়েন দেওয়ার সময় তারা এক হাত আপনার হাতের নিচে রাখবে যাতে কয়েন পড়ে না যায়। দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দোকানি দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বিদায় জানাতে দেখলে অবাক হবেন না যেন।
এমনকি জাপানি প্রযুক্তিগুলোও ওমোতেনাশির অনুশীলন করে। আপনি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ট্যাক্সির দরজা খুলে যাবে। লিফট ক্ষমা চাইবে আপনাকে অপেক্ষায় রাখার জন্যে। রাস্তায় নির্মাণ-কাজ চলার সংকেতে একজন কর্মীর বাউ করার চিত্র দুঃখ প্রকাশ করে সাময়িক অসুবিধার জন্যে।
কোনো ব্যক্তি তার যতটা দূরে থাকে জাপানি সংস্কৃতিতে তার প্রতি তত বেশি আতিথেয়তা দেখানো হয়। এজন্য বিদেশিদের প্রতি তাদের ভদ্রতা একটু বেশিই। তবে তাদের এ সংস্কৃতি স্রেফ লোকজনের প্রতি ভদ্রতা দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তাদের শৈশব থেকে শেখানো হয়, “কেউ যদি তোমার জন্যে ভালো কিছু করে, তবে তুমি অন্য কারো জন্যে ভালো কিছু করো। আর কেউ যদি তোমার প্রতি খারাপ কিছু করে, তাহলে তুমি অন্য কারো প্রতি খারাপ কিছু করা থেকে বিরত থাকো।”
তাদের এ শিষ্টাচারের উৎস খুঁজতে গেলে দুটি বিষয় সামনে আসে- জাপানি চা উৎসবের আচার অনুষ্ঠান ও মার্শাল আর্টস। ওমোতেনাশি’ শব্দটিও সরাসরি চা-উৎসব থেকে এসেছে। এ উৎসবে আয়োজকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন অতিথিদের আনন্দ দেওয়ার। অনুষ্ঠানের সজ্জা থেকে শুরু করে, চায়ের পাত্র পর্যন্ত সবকিছু অতিথিদের কথা মাথায় রেখেই বাছাই করেন। বিনিময়ে কোনো কিছুর প্রত্যাশা করেন না। অতিথিরাও তাদের প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান জানিয়ে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা দেখান। এভাবেই তারা একটি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবেশ গড়ে তোলেন।
শিষ্টাচার, সহানুভূতি ইত্যাদি বিষয়গুলো সামুরাই যোদ্ধাদের আচরণ-বিধিতেও মূল বিষয় ছিল। তাদের বিধানে কেবল সম্মান, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার কথা বলা হয়নি, যুদ্ধ থেকে শুরু করা চা-পরিবেশন করা পর্যন্ত সকল কিছু সঠিকভাবে করার নীতি বাতলে দেওয়া হয়েছিল। নিজের অনুভূতির প্রতি নিয়ন্ত্রণ, আত্মিক প্রশান্তি এবং শত্রুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের নীতিও অনুশীলন করতে হতো তাদের। তাদের থেকে এ সংস্কৃতি গোটা সমাজেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
বিদেশীদের কাছে তাদের এ শিষ্টাচার অবাক করা হলেও, তারা নিজেরা এ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। টোকিওতে চালানো সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফল থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যেখানে ৬৫ শতাংশ বিদেশী মনে করেন টোকিওবাসীর আচার-ব্যবহার বেশ সন্তোষজনক, সেখানে এ কথার সাথে একমত হওয়া টোকিওবাসীর সংখ্যা মাত্র ২৪ শতাংশ। একইরকম ৭৯ শতাংশ পর্যটক মনে করেন টোকিও একটি পরিচ্ছন্ন শহর, কিন্তু মাত্র ৪১ শতাংশ স্থানীয়দের কাছে শহরটিকে পরিচ্ছন্ন বলে মনে হয়।
টোকিওতে ঘুরে আসলে এ তথ্যটি আপনার কাছে কিছুটা হাস্যকর বলে মনে হতেই পারে। রাস্তায় যান-বাহন চালকদের বিনম্র আচরণ থেকে শুরু করে দোকানগুলোতে বিক্রেতাদের আন্তরিক ব্যবহার ও হোটেলগুলোতে কর্মীদের নত হয়ে প্রণাম করা দেখে আপনার কাছে তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র জাতি বলেই হয়তো মনে হবে।
তবুও তারা তাদের আচরণ নিয়ে সন্তুষ্ট নন কেন? হিমা ফুরুতার কাছ থেকে শুনুন। তিনি একজন উদ্যোক্তা, টোকিওর ‘উচ্ছন্নে যাওয়া’ তরুণদের কিছুটা ভদ্রতা শেখানোর জন্যে ‘টোকিও গুড ম্যানারস প্রজেক্ট’ নামে একটি অলাভজনক প্রকল্পও শুরু করেছেন। অন্তত তার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা উচ্ছন্নেই গেছে। তাদের অভদ্রতার উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, “যদিও এখনো তরুণরা অন্যদের সাহায্য করতে সচেষ্ট, কিন্তু তাদের মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা বেশ অভদ্র। রাস্তায় চলার সময় কিংবা জনসমাগমস্থলেও মোবাইল ফোন থেকে চোখ না ফেরানোর মতো আচরণগুলো অগ্রহণযোগ্য। অনেকে রাস্তায় কোনো ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা না করে একজন আরেকজনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। ট্রেনে চলতে গিয়ে ধাক্কা লাগে অন্যজনের সাথে কিন্তু তারা সেজন্যে দুঃখ প্রকাশ করে না।”
যেখানে জাপানিদের কাছে এটি প্রত্যাশিত যে, তারা কনসার্ট বা কোনো স্টেডিয়ামে গেলে, নিজেদের তৈরি আবর্জনা সেখান থেকে সঙ্গে নিয়ে আসবে এবং বাসায় এনে সেগুলোর ব্যবস্থা করবে। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় তাদের এ আচরণ নজর কেড়েছিল বিশ্ববাসীর। সেখানে এমনও কিছু লোক নাকি আছে যারা আবর্জনা রাস্তায় ফেলে দেয়। কিংবা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখে তা না তুলে এড়িয়ে যায়।
এসব অবক্ষয় দেখেই হিমা ফুরুতা তার উদ্যোগটি শুরু করেছেন। তিনি বলেন “শিষ্টাচার হলো এমন কিছু নিয়ম-কানুন যা বিভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা মানুষজনের জন্যে খাপ খাইয়ে নেওয়াকে সহজ করে তোলে।” তাই এসব বিষয়ে ছাড় দিতে নারাজ তিনি। ফুরুতার বক্তব্য থেকেই পাওয়া যায় টোকিওবাসীর অসন্তোষের কারণ। তাদের কাছে ভালো আচরণের যে মানদণ্ড তা অন্যান্যদের সাথে মেলে না। যেমন দেখুন তিনি চূড়ান্ত অভদ্রতার যেসব উদাহরণ দিলেন, তার অধিকাংশই আমাদের দেশে স্বাভাবিক বিষয়।
তবে জাপানের এ শিষ্টাচার-সংস্কৃতির অন্য একটা দিকও আছে। তারা নিজে যেমন অন্যের কোনো ঝামেলা করতে চায় না, তেমনি অন্যের কোনো বিষয়ে জড়াতেও চায় না। আপনি তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা আগ্রহের সাথে সাহায্য করবে। কিন্তু একজন জাপানি ব্যক্তি কোনো ঝামেলায় পড়লে সে খুব সহজে অন্য কারো সাহায্য চায় না। না চাইতে অন্য কেউও এগিয়ে আসে না।
তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাটাও বেশ কঠিন বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের এ শিষ্টাচারের সংস্কৃতি, দূরত্ব বজায় রাখার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আপনি হয়তো দেখবেন কেউ একজন খুব আন্তরিক হয়ে আপনাকে কোনো সাহায্য করল, আপনি ভাবলেন তার সাথে আপনার সম্পর্কটা গাঢ় হয়ে গেল, কিন্তু আসলে তা নয়, সে তার কেবল সামাজিক দায়িত্বই পালন করেছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর তেমন একটা প্রভাব নেই।
তবে সব মিলিয়ে তাদের এ সংস্কৃতির চর্চা সমাজকে বসবাসের জন্য অনেকটা সুস্থ করে তোলে। সে পরিবেশে কিছুদিন থাকলে বিদেশীদের মাঝেও এর চর্চা কিছুটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সত্যিই অসাধারণ হতো যদি পর্যটকরা সেখান থেকে এসব শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সমাজেও ছড়িয়ে দিতে পারতো। একটু একটু করে গোটা পৃথিবীটাই বসবাসের জন্যে আরেকটু ভালো হয়ে উঠতো।