বাঙ্গালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। আর এই উৎসব উদযাপনের সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীনে পরিচালিত একটি জাঁকজমকপূর্ণ সুসজ্জিত আনন্দ মিছিল। এই মিছিলটিই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ প্রথম এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা করলেও এর ইতিহাস আরও কিছুটা পুরনো।
আর সমস্ত ইতিহাস ও লোকজ ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে এই আনন্দ মিছিল আজ স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব দরবারে- হয়েছে ইউনেস্কোর ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল্ কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ এর তালিকাভুক্ত সমস্ত ইতিহাস ও লোকজ ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে এই আনন্দ মিছিল আজ স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব দরবারে- হয়েছে ইউনেস্কোর ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল্ কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ এর তালিকাভুক্ত।
ঐতিহ্যের ইতিকথা
রাজনীতিকে আমরা বারবরই নেতিবাচকভাবে দেখে থাকি। রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িত ব্যক্তি বা আলোচনা এড়িয়ে চলাই সাধারণ জনগণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পদক্ষেপ। কিন্তু সবাই যদি এই নিরাপদ পদক্ষেপের আশ্রয়েই থাকত, তাহলে দেশে ও বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভবই হতো না হয়তো।
তবে প্রতিবাদের ভাষাও অত্যন্ত বিবেচনার সাথে নির্বাচন করতে হবে। সেই কাজটিই করেছিলেন মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র। তবে তাদের এই বিপ্লবের সূচনা কিন্তু ঢাকা শহরে হয়নি, হয়েছিল তাদের নিজ শহর যশোরে।
ঢাকায় পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে শামীম, হিরণ্ময়রা যশোরে ফিরে গিয়ে ‘চারুপীঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কাদামাটি, রঙ-পেন্সিল দিয়ে শিশুদের চারু ও কারুকলার সাথে পরিচয় করানোই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দ্যেশ্য। এই চারুপীঠের হাত ধরেই ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে যশোর শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রা শুরু হয়। হুট করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সেই মোতাবেক তৎক্ষণাত যে যার কাজে লেগে পড়লেন। চৈত্রের শেষ রাতে শুরু হলো শহর জুড়ে আল্পনা আঁকা। একই সাথে এটাও ঠিক করা হলো যে, এই উপলক্ষে একটি মিছিল বা শোভাযাত্রার আয়োজনও করা হবে।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে শামীম তৈরি করলেন পরী আর পাখি, হিরণ্ময় তৈরি করলেন বাঘের মুখোশ। পরের দিনের সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই শুরু হল বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে এক নতুন ঐতিহ্যের। ভোর থেকেই একদল ছেলেমেয়ে পাঞ্জাবি-শাড়ি পরে সানাইয়ের সুরে, ঢাকের তালে মুখোশ আর ফেস্টুন নিয়ে নেচে-গেয়ে পুরো শহর জুড়ে ঘুরে বেড়িয়ে শুরু করল ‘বর্ষবরণ শোভাযাত্রা’।
পরবর্তীতে এই নামই পরিবর্তিত হয়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামধারণ করে। পরের বছরে শহরের অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও চারুপীঠের সাথে যোগ দিল। প্রতিষ্ঠিত হলো ‘বর্ষবরণ পরিষদ’। একটি বড় হাতি ও সাড়ে তিন হাজার মুখোশ সহ আরও অনেক কিছু তৈরি হল দ্বিতীয় বারের শোভাযাত্রার জন্য।
ঢাকায় আগমন
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে শামীম সহ চারুপীঠের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা পড়াশোনার জন্য আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ফিরে আসেন। এসেই তারা অন্যান্যদের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। এই প্রচেষ্টার সফল ফসল হিসেবেই ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তথা বাংলা ১৩৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীনে আজকের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রথম যাত্রা ঘটে। ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হলেও, মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল এটিই প্রথম।
এই প্রথম যাত্রার পোস্টার তৈরি করেছিলেন চারুকলার পেইন্টিং বিভাগের ছাত্র সাইদুল হক জুইস। এই পোস্টারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘লক্ষ্মীসরা’। আর বর্ণিল শোভাযাত্রার মুখোশ তৈরির কাজটি করেছিলেন বিদেশে মাস্টার্স পড়তে গিয়ে মুখোশ বানানোর কৌশল শিখে আসা তরুণ ঘোষ। এই প্রথমবারের আয়োজনে চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই সকল কাজ করেছিলেন। আয়োজনের বাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রছাত্রী ও গণমাধ্যম এই শোভাযাত্রা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করে। দৈনিক প্রত্রিকায় এই অনুষ্ঠানের স্থিরচিত্রও প্রকাশিত হয়েছিল।
পরের বছর চারুশিল্পী সংসদ সহ নবীন-প্রবীণ সকল চারুশিল্পী এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সালেহ মাহমুদ, ফরিদুল কাদের, ফারুক এলাহী, সাখাওয়াত হোসেন, শহীদ আহমেদ প্রমুখ। আর অনুষদের তৎকালীন শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা তো ছিলেনই। দ্বিতীয় বারের এই তুলনামূলক বড় আয়োজনে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানের জন্য এগিয়ে আসেন সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সভাপতি ফয়েজ আহমেদ।
এই দ্বিতীয় শোভাযাত্রার পুরো পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী ইমদাদ হোসেন। প্রথমে ‘বৈশাখী শোভাযাত্রা’ নাম নিয়ে আয়োজন শুরু হলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে যশোরে ব্যবহৃত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটিই চিরস্থায়ী মর্যাদা লাভ করে।
তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়। শুরু হয় একটি জাতীয় উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা। এই তৃতীয় বারের শোভাযাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য, বিশিষ্ট লেখক ও শিল্পীবৃন্দ সহ সাধারণ নাগরিকও অংশগ্রহণ করেন। বিশালাকার হাতি সহ বেশ কিছু বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম, কৃত্রিম ঢাক, অসংখ্য মুখোশ হাতে নিয়ে নেচেগেয়ে ছাত্রছাত্রীদের দল এই বছরের উৎসবটিকে মুখরিত করে তোলেন।
১৯৯২ খিস্টাব্দের শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল একেবারে সামনের সারিতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের হাতে শোভা পাওয়া বিশালাকার এক কুমিরের প্রতিকৃতি। বাঁশ ও কাপড় দিয়ে এই কুমিরটি তৈরি হয়েছিল।
বাংলা ১৪০০ সালের সূচনা উপলক্ষে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রার আরম্ভ করে, যা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় হয়ে শিশু একাডেমির সামনে দিয়ে ঘুরে আবারো চারুকলায় ফিরে আসে। বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়ার প্রতিকৃতি সহ বিভিন্ন ধরনের মুখোশ এই শোভাযাত্রার উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ ছিল।
আজকের মঙ্গল শোভাযাত্রা
বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা জনসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য আগের মতো ততটা উন্মুক্ত নয়। বরং স্কাউট দলের সাহায্যে বেশ কড়া বেষ্টনীর মধ্যে থেকেই উপাচার্য ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির অংশগ্রহণে এই শোভাযাত্রা পরিচালিত হয়। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হাতে থাকে শোভাযাত্রার ব্যানার। তারা থাকেন এই মিছিলের একেবারে সম্মুখে। আর মুখোশ হাতে ছাত্রছাত্রীরা থাকে তাদের পেছনে।
এমনকি গণমাধ্যমকেও এই মিছিলে ঢোকার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। আর এই যাত্রার পরিধিও ছোট হয়ে এসেছে। শিশু একাডেমি পর্যন্ত না গিয়ে এখন শুধু শাহবাগ মোড় পর্যন্ত গিয়েই ঘুরে আসা হয়। তবে এই প্রদক্ষিণ প্রক্রিয়া তিন বার সম্পাদন করা হয়। কমে এসেছে মুখোশের সংখ্যাও।
তবে কমেনি ছাত্রছাত্রীদের এবং সাধারণ জনগণের উৎসাহ। প্রতিবছর এই শোভাযাত্রার আয়োজন উপলক্ষে চারুকলার প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের অধীনে এক মাস আগে থেকেই আয়োজন শুরু করে থাকে। হাতে তৈরি মুখোশ, কারুকর্ম ও চিত্রকলা বিক্রির মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সাথে অর্থায়নের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও থাকে।
সাধারণ জনগণ এই প্রস্তুতি পর্বের শুরু থেকেই এই উৎসবের সাথে থাকে। শুরু থেকেই মুঠোফোনভর্তি ছবির মাধ্যমে তারা এর প্রচারে অংশ নেয়। চৈত্রের শেষ রাতে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি পালনের পরে অতি-উৎসাহী জনতার কেউ কেউ সারারাত চারুকলার চত্বরে অবস্থান করে যেন পরের দিন ভোর থেকে শুরু হতে যাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত মুখোশ ও প্রাণীর প্রতিকৃতির প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরে এক দল ঢাকির বাদ্যের তালে প্রস্তুতি কাজে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরা চারুকলা অনুষদের চত্বরেই নেচে-গেয়ে আনন্দ উৎসবের সূচনা করে। এই ঢাক বাজানো এখন একটি নিয়মিত রীতিতে পরিণত হয়েছে।
ঢাক বাজানো শুরু হওয়ার পূর্বে অনুষদে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সুতরাং কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে চাইলে এই সময়েরে মধ্যেই চারুকলা অনুষদের চত্বরে উপস্থিত থাকতে হবে। যারা সরাসরি এই মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পারেন না তারা রাস্তায় এর চারপাশে দাঁড়িয়ে থেকেই এটি উপভোগ করে। কিন্তু এখনও অনেকের মাঝেই কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যেমন এই মিছিলে অংশগ্রহণ বিশেষত মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ভুল ধারণা।
বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য সম্বলিত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি প্রার্থীতা পত্রের মাধ্যমে ইউনেস্কোর দপ্তরে আবেদন পাঠায়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ১১তম অধিবেশনে ‘সেফগার্ডিং ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ এর আন্ত-সরকারি কমিটি দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ এর তালিকাভুক্ত করা হয়। আর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশের এই আনন্দ মিছিল পশ্চিমবঙ্গেও এর যাত্রা শুরু করেছে।
আশির দশকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এর স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধিতার একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই মিছিলে ব্যবহৃত প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে অন্তত একটি অমঙ্গলের প্রতিনিধি, একটি সাহস ও শক্তির প্রতিনিধি এবং অন্য একটি শান্তির প্রতিনিধি হিসেবে তৈরি হয়ে থাকে। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি সকল প্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে জাত-ধর্মজনিত বিভেদ ভুলে জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার ইতিহাস ও অনুপ্রেরণাকেও তুলে ধরা হয়।