একটি গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। কিছুদিন আগে একজন চাকুরিপ্রার্থী বিসিএস ভাইভা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতি শুধু পড়ালেখার নয়, পোশাক-পরিচ্ছদেরও। ভাইভার জন্য সহজভাবেই সাদা রংয়ের শার্টের অর্ডার দিলেন। প্যান্টেও সমস্যা হলো না। সাদা শার্টের সঙ্গে কালোকেই বেছে নেয়া হলো। কিন্তু বিপদে পড়তে হলো টাই কিনতে গিয়ে। সেখানে রং শুধু সাদা-কালোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রং যেমন বিভিন্ন, আছে বিভিন্ন ডিজাইনও। আর বিপদটা এখানেই।
অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন, টাই একটা হলেই হয়, রং কোনো বিষয় না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইয়ের রং আপনার ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। একই স্যুটের সাথে বিভিন্ন রংয়ের টাই একজন মানুষ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা পাঠায় দর্শকদের কাছে। তাই নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য টাইয়ের রং বাছাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা যদি হয় চাকরির সাক্ষাৎকার বা কোনো সন্ধি-আলোচনার ক্ষেত্রে (নেগোসিয়েশন), তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
দর্শক যিনিই হোন না কেন, তার সামনে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে সবাই চান। আর এজন্য রংয়ের রসায়নটা ভালোভাবেই জানা উচিত। এ বিষয় ‘Color Your Style’ বইয়ের লেখক ডেভিড জিলা বলেছেন, “রং নির্দিষ্ট সংকেত পাঠায়।” নিউইয়র্কভিত্তিক এই লেখক আরো বলেছেন, “একই স্যুটে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের টাই, ভিন্ন ভিন্ন বার্তা বয়ে বেড়ায় ও ভিন্ন ফল নিয়ে আসে।”
এবার তাহলে দেখা যাক কোন রংয়ের টাই কোন ধরনের বার্তা নিয়ে আসে আর কেমন ব্যক্তিত্বই বা প্রকাশ করে।
সব ক্ষমতাবানের রং লাল
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, বিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদই হালকা রংয়ের শার্ট ও গাঢ় স্যুটের সঙ্গে লাল রংয়ের টাই পরেন। আসলে ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। “ক্ষমতার টাইয়ের রং লাল”-কথাটি বলেছেন ফ্যাশন বিশ্লেষক মার্ক উডম্যান।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের লরেলে ‘রং’ নিয়ে গবেষণা করা এই বিশ্লেষক আরো বলেছেন, “লাল এর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সব সময় ক্ষমতা ও অধীর আগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।”
তবে লালের মাত্রাটা পার্থক্য সৃষ্টি করে। গাঢ় লাল বা টকটকে লাল টাই বিশ্বাস স্থাপন করাতে সাহায্য করে। আর হালকা লাল বা গোলাপি রং নিজের ব্যক্তিগত স্টাইল প্রকাশ করে, যা সৃজনশীলতার দিকে ইঙ্গিত করে। তবে গত দশক থেকে গোলাপি টাই মাঝে মাঝে নারীর প্রতি সংহতি প্রকাশেরও সংকেত বহন করে।
আপনি যখন কোনো প্রকল্পে নেতৃত্ব দিতে চান অথবা কোনো উচ্চাশা প্রকাশ করতে চান, তখন গাঢ় চকচকে লাল রংয়ের টাই বেছে নেয়াটা উত্তম। আর ক্ষমতা প্রকাশের সূক্ষ্ম মাধ্যম হিসেবে অনুজ্জ্বল অথবা ছাপার লাল রংয়ের টাই বেছে নিতে পারেন।
রাজকীয় রং বেগুনি
নিউইয়র্কে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের একজন নির্বাহী হিসেবে চাকরি করেন রস নাভর। যখন তিনি কোনো ব্যবসায়িক মিটিং করেন, তখন লাল টাই না পরে বেগুনি রংয়ের টাই পরেন। কারণ এই রং আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে এবং প্রথম ইমপ্রেশনটা দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করে।
তবে ঐতিহ্যবাহী রংয়ের টাই পরার আগে সচেতন হওয়া উচিত। আপনার ক্লায়েন্টের সামনে কথা বলার সময় অথবা কারো সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তার সামনে কম ঐতিহ্যবাহী রংয়ের টাই পরিধান করা উচিত। এটা প্রকাশ করে আপনি তার গায়ের বরণ নিয়ে ততটা ভাবেন না।
হংকংয়ে ‘ইমেজ কনসাল্টেন্ট’ হিসেবে কাজ করা ইভ রোথ লিন্ডসে বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে রাজকীয়তা ও অর্থ-প্রতিপত্তির পরিচায়ক বেগুনি রং। সাধারণত কর্মক্ষেত্রে এই রংয়ের টাই বেশি গ্রহণযোগ্য।
তার মতে, পুরুষরা সাধারণত হালকা বেগুনি রংয়ের শেডের শার্ট এবং গাঢ় বেগুনি রংয়ের শেডের টাই পরিধান করে। হাজার মানুষের মধ্যে নিজেকে কিছুটা সাহসী হিসেবে প্রকাশ করার জন্য এর যেকোনো একটি বেছে নেয়াটা মন্দ হবে না।
কালো রংয়ের ব্যাপারটাই আলাদা
কোনো এক্সিকিউটিভ মিটিংয়ে আপনি কালো রংয়ের টাই নিয়মিত না পরলেও কোনো পার্টিতে বা বিশেষ কোনো ডিনারে কালো টাই পরতে পারেন। এটি আপনাকে আধুনিকতার অনুভূতি দেবে-কথাগুলো বলেছেন ‘Color Your Style’ বইয়ের লেখক ডেভিড জিলা।
তিনি কালো টাই পরার ক্ষেত্রে সতর্কও করেছেন। কারণ ফরমাল কালো টাই অনেক সময় উদ্ধত ভাব প্রকাশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি বেশভূষাও মনে হয়। জিলা বলেছেন, “যদি কর্মক্ষেত্রে এখনও অনেক উপরে উঠার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে কালো রংয়ের টাই এড়িয়ে চলুন।”
এদিকে বিশ্লেষক উডম্যান বলেছেন, ধূসর শেডের টাই তুলনামূলক বেশি মানানসই। এমন টাইয়ে দাম্ভিক ভাব প্রকাশ করা না, তবে ঠিকই আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিপাটি মনে হয়।
সবুজ টাইয়ে কেমন লাগে
সবুজ রং অনেক কিছুই বোঝায়। এটি দ্বারা একদিকে পুনর্জন্ম বোঝায়। আবার অন্য দিকে কোনো কোনো দেশে টাকার রং বোঝায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এটা অতি মাত্রায় দৃষ্টি-আকর্ষণকারী হয়ে যায়।
আপনি যদি চান, টাইয়ের রংয়ের কারণে কেউ আপনাকে স্মরণ করুক, তাহলে ঠিক সবুজ রং বেছে নেয়াটা ঠিক হবে না। উডম্যানের মতে, উজ্জ্বল সবুজ যেমন বিরক্তিকর লাগে, তেমনি এর সঙ্গে মিলিয়ে স্যুট বা শার্ট পাওয়াও কঠিন। তবে হালকা সবুজের সঙ্গে সূক্ষ্ম ছাপার টাই অন্য কোনো রংয়ের শার্টের সঙ্গে পরিধান করতে পারেন।
হলুদের কদর কম না
ইংল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশে ঐতিহ্যবাহী টাইয়ের রং হলুদ। এটি দীপ্তি ও জীবনীশক্তির সঙ্গে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে। সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার সময় হলুদ রংয়ের টাই পরতে পারেন।
এ বিষয় রোথ লিন্ডসে বলেছেন, জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করে হলুদ রংয়ের টাই।
তবে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে দেশভেদে টাইয়ের রং বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। কারণ ভারতে হলুদ রংয়ের টাই পরলে তাকে বণিক মনে করা হয়। আর চীনে শোকের সময় সাদা রংয়ের টাই পরা হয়।
নিরাপদ রং নীল
টাইয়ের রংয়ে ভুল বার্তা পাঠানোর ভয়ে পড়ে গেলেন? তাহলে সব চিন্তা বাদ দেন। যে বার্তাই পাঠাতে চান না কেন, নীল রংয়ের টাই বেছে নেন।
“নীল রং মানুষকে আকাশ ও সমুদ্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে মানুষের মনকে শান্ত করে দেয়।” – বলেছেন ‘ইমেজ কনসাল্টেন্ট’ রোথ লিন্ডসে। তার মতে, “নীল রং পরিধান করাই সবচেয়ে নিরাপদ।”
ডিজাইন করা নীল টাই আপনার মধ্যে প্রফেশনাল অনুভূতি যোগাবে। বৈশ্বিক ব্যবসার ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের ভুল বার্তা দিবে না। লিন্ডসে বলেছেন, “সূক্ষ্ম নীল টাই বোঝায় আপনি কোমল ও অন্তর্বীক্ষণপ্রবণ (যে নিজের চিন্তা ও অনুভূতি পরীক্ষা করে)। অন্যদিকে গাঢ় নীল বোঝায় আপনি অসাধারণ একজন।”
তার মতে, নেভি ব্লু আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগায় আর গাঢ় নীল স্মরণ করিয়ে দেয় অতি সম্মানের পাইলট-ইউনিফর্মের কথা।
মিশে যান প্রকৃতির সঙ্গে
লিন্ডসের মতে, বিক্রয়কর্মী, শিক্ষক, সেবা প্রতিষ্ঠানের মানুষের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে তাম্র, বাদামি, মাটি, গোলাপি-কমলা বা হলুদ রং বেছে নিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, বাদামি রংয়ের টাই যদি একেবারে মিহি মনে না হয়, তাহলে সেটা নিষ্প্রভ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে।
তিনি আরো বলেন, ধূসর রংয়ের টাই অনেক সময় অতি মাত্রায় নিরুদ্বেগ ভাব প্রকাশ করে। আর মাটি রংয়ের শার্টের সঙ্গে মাটি রংয়ের টাই সবসময় এড়িয়ে চলা উচিত। কর্মক্ষেত্রে পদন্নোতির আশা থাকলে এটা একেবারেই পরিহার করা উচিত।
ফিচার ইমেজ: bbc.com