ছোটবেলার সেই গল্পটা মনে আছে? সেই যে এক গরীব কৃষক ছিলো, বড় কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজ যা আনতো, তা দিয়েই দিন চলে যেতো তার। কিন্তু দিন শেষে মনের শান্তিতে সে ঘুমাতো শান্তির ঘুম। তারপর একদিন সেই গ্রামে এক ধনী লোক আসলো, গরীব চাষীর কষ্ট দেখে তাকে দিয়ে গেলো এক কলসি স্বর্ণমুদ্রা। প্রথমে খুব খুশি হলো চাষী, কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো তার ধনী লোকটার প্রতি। কিন্ত রাতে কখন সেই মুদ্রার কলসি চুরি হয়ে যায়- এই ভয়ে তার ঘুম আসে না আর। কলসি কোথাও লুকিয়ে রেখেই শান্তি পেলো না সে। এভাবে কয়েক রাত পার হয়ে যাওয়ার পর সে কলসি ফেরত দিয়ে আসে ধনী লোকটিকে আর বলে আসে, আমার রাতের শান্তির ঘুম এই স্বর্ণমুদ্রার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। বহুল প্রচলিত এই গল্পই বলে দেয় যে, কত প্রিয় মানুষের কাছে তাদের মনের শান্তি আর রাতের ঘুম!
এতই প্রিয় যে শান্তির ঘুম, কেমন হবে জীবন, যদি সে ঘুম ঠিকমতো না হয়? দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে বা নামমাত্র ঘুমিয়ে যখন কাটতে থাকে জীবন, মন ও শরীর কি প্রতিবাদ করে না তার? আমরা হয়তো জানিও না, কিন্তু আমাদের অনেক আচরণ, চিন্তা আর কর্মই এই ঘুমের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অনেক সময় এরকম হয় যে, আপনি চাইলেও ঘুমাতে পারছেন না কিংবা ঘুম ভেঙে গেলো সামান্যতেই, আর ঘুম আসছে না। বিশেষ করে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে মানুষের জটিলতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বিভিন্ন মানসিক চাপ জড়িয়ে থাকা জীবনে ঘুমের সমস্যা দিন দিন যেন প্রতিটি ঘরেই কড়া নাড়ছে। বইয়ের ভাষায় ঘুমের এই সমস্যাকে ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা বলা হয়। ঘুমের এই সমস্যা কতটা বিস্তার লাভ করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, তা বোঝা যায় পরিসংখ্যানগুলোর দিকে তাকালেই।
স্লিপ-হেলথ ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি তিনজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এই সংখ্যা তো আরো উদ্বেগজনক। তারা বলে, ১৮ থেকে ২৯ বছরের শতকরা ৬৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিদ্রাহীনতার কোনো না কোনো লক্ষণের জন্য কষ্ট পান। ৩০ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে এই সংখ্যাটি শতকরা ৫৯ জন, আর ৬৫ বছরের উপরে আছে শতকরা ৪৪ জন। সংখ্যাটা যখন নেহাতই কম না, তখন আজ জানা যাক এই ব্যাপারে বিস্তারিত, সাথে থাকছে কীভাবে বের হওয়া যায় এই চক্র থেকে তা নিয়েও কিছু কথা।
হঠাৎ একদিন বা দু’দিন ঘুমের সমস্যা বিভিন্ন কারণে যেকোনো মানুষের হতেই পারে। তাহলে কখন সমস্যাটিকে নিদ্রাহীনতা বা ইনসোমনিয়ার সমস্যা বলে চিহ্নিত করা যাবে? যদি কোনো ব্যাক্তির জন্য নিয়মিতভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা বা ঘুমিয়ে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে বা একেবারেই ঘুমাতে পারছে না এমন হয়, তবে সেটা নিঃসন্দেহে নিদ্রাহীনতার এই সমস্যার মধ্যে পড়ে। এই সমস্যা একেকজনের জন্য একেকরকম হতে পারে। কারো হয়তো ঘুমই আসে না, আবার কেউ হয়তো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। অবচেতন মন ঘুম ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই জেগে ওঠে, সমস্ত বাহ্যিক ঘটনা টের পেতে থাকে। আবার অনেকের এরকমও হয় যে, মাত্র কিছুক্ষণ ঘুমের মধ্যেই বারবার জেগে ওঠে কিংবা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে পরে পুরো রাতই আর ঘুম আসে না। তবে অনেকের মধ্যে সবগুলো ধরনই দেখা যায়।
তাহলে কেমন কাটে তাদের ঘুমহীন রাতগুলো? তাদের মধ্যে কি কোনো অস্থিরতা কাজ করে? নাকি শুধুই চুপচাপ ঘুমের অপেক্ষা করতে থাকেন তারা? এই নিয়ে গবেষণা করার সময় নেওয়া হয় বিভিন্ন রোগীর সাক্ষাৎকার। তাদের একজন জারা হোম তার ডাক্তারকে বলেন, “যে কোনো কিছু আমি গিলে ফেলবো যদি তা আমাকে রাতের ঘুম এনে দেয়। কিন্তু গরম দুধ থেকে ওষুধ- কিছুই তা পারছে না। মাঝে মাঝে আমি গুগলে খুঁজি- কোথায় আমি ক্লোরোফর্ম পাবো।”
সময়কালের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত দু’ধরনের ইনসোমনিয়ার কথা বলা যায়। প্রথমে তীব্র বা ক্ষণস্থায়ী ইনসোমনিয়ার কথা বলা যাক। এটি সাধারণত দুই-তিন দিনের জন্য কোনো বিশেষ কারণে (যেমন- স্থান পরিবর্তন) ঘটে। চিকিৎসা ছাড়াই সাধারণত এর থেকে মুক্তি মেলে। দ্বিতীয়টি হলো ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী ইনসোমনিয়া, যা সারাতে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। এর ফলে প্রতি সপ্তাহে প্রায় তিন রাত ঘুমের সমস্যা হয় আর তা তিন মাস বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়। খুবই সাধারণ কারণ, যেমন- অতিরিক্ত কাজের অভ্যাস, মানসিক চাপ বা ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্য শুরু হয়ে তা ক্রমে হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
কী কী কারণ প্রধান হয়ে উঠতে পারে নিদ্রাহীনতার পেছনে? অ্যাজমা, ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ অনেক সময় ঘুমের সমস্যা তৈরি করে, আরেকটি কারণ হতে পারে কোনো দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা। যেকোনো ধরনের নেশা সহজেই হয়ে ওঠে ঘুমের প্রধান শত্রু। যাদের ঘুমের সমস্যা আগে থেকেই আছে তাদের অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত চা, কফি সহ যে কোনো ধরনের ক্যাফেইন।
তবে দীর্ঘস্থায়ী নিদ্রাহীনতার প্রধান কারণ যে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা, তা বলাই বাহুল্য। আধুনিকতা এখন আমাদের জীবন করেছে বৈচিত্রময়, প্রযুক্তি কমিয়ে দিয়েছে শ্রম, অথচ মানুষের মাঝে চারিদিকে এখন হতাশার কী নিদারুণ বসবাস! প্রযুক্তি শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিলেও তারপর থেকে জীবনে বেড়ে গেছে বোঝা, প্রতিযোগিতা। কাজের চাপ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উদ্বিগ্নতা, হতাশা আর মানুষের ক্রমবর্ধমান মানসিক জটিলতা কেড়ে নিচ্ছে তার শান্তির ঘুম। আর শহরে তো রাতগুলো এখন আর ঘুমায় না বললেও চলে। আবার এই নিদ্রাহীনতা আরো জটিলতা নিয়ে আনছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিদ্রাহীনতার রোগীরা ভোগেন স্মৃতিশক্তিহীনতায়ও। তারা সহজে মনোযোগ দিতে পারেন না কোথাও, অস্থিরতা আর হতাশা আরো বাড়তে থাকে তাদের মধ্যে।
এবার আসা যাক এর থেকে নিস্তার পাওয়ার কয়েকটি কথা নিয়ে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস মধু দেওয়া কুসুম গরম দুধ যেন টনিকের মতো কাজ করে এক্ষেত্রে। ঘুমোনোর আগে একবার গোসল দেওয়ার কথাও বেশ প্রচলিত। বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে যে পরামর্শগুলো দেন, তার মধ্যে আছে-
কেবলমাত্র ঘুম এবং শারীরিক মিলনের জন্যই বিছানা ব্যবহার করুন এবং ঘুমের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। শারীরিক শ্রমটা ভালো ঘুমের জন্য খুবই দরকারি, তেমন পরিশ্রম করার সুযোগ না থাকলে ব্যায়ামটা অবশ্যই চালিয়ে যান। এক্ষেত্রে যদি যোগব্যায়াম আপনার জন্য ভালো কাজ করে, তবে সেটিও একটি ভালো উপায়। আর হ্যাঁ, দুপুরের বা বিকেলের হালকা ঘুমটা তাহলে এবার বাদ দিন। অবশ্যই ক্যাফেইন, নিকোটিন বা অ্যালকোহল থেকে নিজেকে মুক্তি দিন। ঘুমের জন্য হালকা প্রস্তুতিও নিতে পারেন সেই সময়, যেমন- হালকা কোনো গান শোনা বা পছন্দের বই পড়া। ঘুম আনবার আরও কিছু টিপস পেতে পড়তে পারেন আমাদের এই লেখাটিও।
অনলাইনেও পেতে পারেন অনেক সহায়তামূলক প্রোগ্রাম। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য দুটি হলো- ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ ইনসোমনিয়া রিসার্চার ও চিকিৎসক প্রফেসর কলিন এসপাই দ্বারা পরিচালিত Sleepio নামের একটা প্রোগ্রাম। আরেকটি হলো আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া পরিচালিত এবং অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশে পরীক্ষিত SHUTi নামের আরেকটি প্রোগ্রাম। কিন্তু সবশেষে ইনসোমনিয়ায় তীব্রতার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা সবচেয়ে জরুরী।
জীবনকে আরো সহজ করে নিতে হবে আমাদের। সমস্যা যেন আমাদের নিজেদের চেয়ে বড়ো না হয়ে উঠতে পারে কিছুতেই। ভালো থাকুন, ভালো ঘুমান।