মানবজাতির একটি খুবই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, নিজে একটি কাজ করার আগে বারবার চিন্তা করি যে, লোকে কী বলবে! খুবই বিরক্তিকর একটি জিনিস। এই চিন্তার জন্য আমাদের কাজের কাজ তো হয়ই না, উল্টো আরামের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মানুষজন আমাদের নিয়ে যতটা না ভাবে, আমরা নিজেরা তার চেয়ে আরও দশগুণ বাড়িয়ে চিন্তা করি!
খুব সহজ একটি উদাহরণ চিন্তা করুন। রাস্তায় বের হলে আপনি যতজন মানুষ দেখতে পান, তাদের সবাইকে নিয়ে চিন্তা করার সময় কি আপনার আছে? ধরে নিন, রাস্তায় কেউ একজন আপনাকে জিজ্ঞাসা করলো যে, এখন কয়টা বাজে। আপনি তাকে সময়টা বলে চলে যাবেন। কিন্তু লোকটি কেমন ছিলো, সে কী করে, লোকটি কেন আপনাকেই প্রশ্ন করলো, এগুলো কি আপনি চিন্তা করেন? উত্তর “হ্যাঁ” হবার সম্ভাবনা খুবই কম। সেই লোককে নিয়ে আপনি বড়জোর এক থেকে দুই মিনিট চিন্তা করবেন। তারপর আর মনে থাকবে না। দিনশেষে আপনি ভুলেই যাবেন যে, কেউ একজন আপনার কাছে সময় জানতে চেয়েছিলো। আসলে আমাদের কারোরই এত সময় নেই যে, নিজের কাজ ফেলে বসে বসে অন্যকে নিয়ে অযথা চিন্তা করবো। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করি যে, মানুষজন আমাদের নিয়ে অনেককিছু ভেবে বসে আছে।
শ্রেণীকক্ষে পড়ার সময় শিক্ষককে প্রশ্ন করা, কোনোকিছু কিনতে দোকানে গেলে দাম জিজ্ঞাসা করা, এমনকি সামান্য একটি ছবি তুলতে গেলেও আমরা এমন অস্বস্তি বোধ করি। কিন্তু আমাদের নিয়ে মানুষজনের এত ভাবার সময় কোথায়, যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত?
তাহলে চলুন এই লেখায় “লোকে কী বলবে” জাতীয় সমস্যা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলার উপায় জেনে নিই।
সবাইকে খুশি করা আপনার কাজ না
লোকে আমাদের নিয়ে কী ভাববে এটা চিন্তা করতে গিয়ে আমরা মনে করি যে, আমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের সবাইকেই আমাদের খুশি করতে হবে। এটি একটি ভুল এবং অযৌক্তিক ধারণা। সবাই তো আর আমাদের কাজের দিকে লক্ষ্য করছে না, তা-ই না? উল্টো এমন লোকও আছে, যারা আমাদের কোনো কাজেই খুশি হতে চায় না। সহজ কথায়, সবাইকে একসাথে খুশি করা সম্ভব নয়। তাই সবাইকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলার তো কোনো মানে হয় না। খুশি যদি কাউকে করতেই হয়, তবে নির্দিষ্ট কাউকে খুশি করার চেষ্টা করুন যে আপনার কাজের মূল্য দেবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজের কাজের প্রতি নিজের সন্তুষ্টি আনতে পারলে। আগে নিজেকে খুশি করুন। তারপর অন্য কারোর দিকে তাকান।
অন্যরা কী চিন্তা করছে, সেটা আপনার চিন্তা না করাই ভালো
একটি কথা আজকাল বেশ লক্ষ্য করা যায়, “লোকে কী ভাববে সেটা যদি আমিই ভাবি, তাহলে লোকে কী ভাববে?” আপনি হয়তো কাজের মাঝে চিন্তা করছেন, আশেপাশের মানুষজন আপনাকে নিয়ে কী ভাবছে, তারা আপনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে। কিন্তু আসলেই কি মানুষজন আপনাকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করছে? খুব কম লোকই আছে যারা একটু সময় বের করে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছে। বাকিরা যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আর এদিকে আপনি মনের ভিতর আরেকটি চিন্তাজগত খুলে বসে আছেন! এমনও তো হতে পারে যে, আপনার সামনে যে বসে আছে সে-ও চিন্তা করছে যে, আপনি তাকে নিয়ে কী ভাবছেন! প্রকৃতপক্ষে এই চিন্তাটি আমাদের সকলের কাছেই আপেক্ষিক।
নিজের কাজের উপর অধিক গুরুত্ব দিন
লোকে কী বলবে তা চিন্তা করে যে আমরা কত কাজ অর্ধেক করে ফেলে দিয়েছি, সেটির কোনো হিসাব রাখা নেই। আপনি একটি ভালো কাজ করছেন, অবশ্যই ভালো কোনো উদ্দেশ্যে। আপনি যদি লোকের কথা চিন্তা করে নিজেই মানসিক হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন এবং কাজ বন্ধ করে বসে থাকেন, তাহলে তো আর সেই কাজ ঠিকমতো করা হবে না। আমাদের উচিত হবে এ ধরনের চিন্তা দূরে ঠেলে দিয়ে নিজের উদ্যোগে এগিয়ে যাওয়া। কাজ ভালো হলে অবশ্যই আমরা এর জন্য পুরষ্কার পাবো।
নিজেকে ভালোমতো জানুন
নিজের ব্যাপারে যদি পরিষ্কার ধারণা থাকে, তবে কোনো অযৌক্তিক কথা বা চিন্তাতে আমাদের পিছিয়ে আসার কোনো কারণ নেই। নিজের কথার ও চাহিদার গুরুত্ব আগে দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আপনি একটি ব্যবসা খুলতে চাচ্ছেন। আপনি ব্যবসাটির ব্যাপারে খুব ভালোমতো খোঁজখবর নিলেন। বুঝতে পারলেন যে এটি আপনার জন্য বেশ উপযুক্ত। কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে যদি আপনি এটা চিন্তা করেন যে, আপনার ব্যবসা নিয়ে আপনার আশেপাশের লোকজন কী ভাবছে। যদি এভাবে চিন্তা করে থাকেন, তবে আপনার ব্যবসা আর শুরু করাই হবে না! যেহেতু আপনি নিজে খুব ভালোমতো খোঁজ খবর নিয়েছেন, তাহলে আপনার মনে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। তাই আপনি কী চাচ্ছেন, সেটি খুব ভালোমতো জানুন।
আপনজনদের থেকে ইতিবাচক সাড়া আশা করুন
উপরের লেখাগুলো পড়তে পড়তে যদি আপনি মনে করে থাকেন যে, আপনি সম্পূর্ণ নিজের মতো করে চলবেন, আশেপাশে কারোর কথা একদমই চিন্তা করবেন না, তাহলে আপনি ভুল করছেন। আপনার আশেপাশে অবশ্যই এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের আপনি সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারেন। হতে পারে তারা আপনার পরিবারের লোকজন কিংবা আপনার খুব আপন একজন বন্ধু। তারা কখনোই চাইবে না আপনার ক্ষতি হোক। বরং তারা আপনাকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবে। আপনার যদি কোনো কাজের মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে তাদের কাছে পরামর্শ চান। তারা আপনাকে হতাশ করবে না। যদি তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে থাকেন, তাহলে তো ভালোই কাজ করে যাচ্ছেন আপনি। আর যদি তারা আপনার কাজ পছন্দ না করে, তবে তাদের কাছে পরামর্শ চান। এটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যদি আপনার আশেপাশের লোকজনের কথা কখনও ভাবতেই হয়, তাহলে চেষ্টা করুন ইতিবাচক চিন্তা মাথায় আনতে। কারণ, আপনি যত ইতিবাচকভাবে চিন্তা করবেন, আপনার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু আপনি যদি ইচ্ছা করেই নেতিবাচকভাবে চিন্তা করতে থাকেন, তবে আপনার কাজ করার গতি কমে যাবে এবং একসময় সেই কাজ আর সম্পূর্ণ করা হবে না। তাই সবসময় চেষ্টা করুন ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার।
লোকে কী বলবে সেটা ভেবেই যদি আমরা জীবন পার করে দেই, তাহলে তো আর হলো না। আমাদের কাজ নিয়ে লোকে কী ভাবলো সেটা নিয়ে কি আমাদের কিছু যায় আসে? লোকে তো তার মনে মনে ভাবছে। হয়তো আপনার কাজটি নিয়ে তার কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তাই আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এটা তো আর দোষের কিছু না যে, আপনি আপনার কাজ থামিয়ে দেবেন। তাই এখন থেকে আমরা যদি কখনও এটা ভেবে অস্বস্তি বোধ করি যে, লোকে কী বলবে, তখন এই চিন্তা মাথায় আনবো, আসলে কারোর এটা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই!
Featured image: Ecorazzi