এক্সট্রোভার্টঃ নিজেকে উজাড় করে তুলে ধরার আরেক নাম

“নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।”

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাণী সদা চিরন্তন ও শাশ্বত। কবির এই রূপকের মতো নদীর দুই পাড় ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্ট। আগের একটি লেখায় ইন্ট্রোভার্টদের নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার দায় পড়ে গেল নদীর অন্য পাড় নিয়ে লেখার। পাড় দুটো আলাদা হলেও নদী তার দু’পাড়ের সাথে সেতুবন্ধন করে চলেছে তার বহমান  জলধারায়। গন্তব্য একটাই, সে ইন্ট্রোভার্ট হোক কিংবা এক্সট্রোভার্ট।

যেহেতু মুদ্রার এক পিঠে ইন্ট্রোভার্ট আর উল্টোপিঠে এক্সট্রোভার্ট, দুয়ের মধ্যে তাই অহি-নকুল সম্পর্ক লেগে রয়েছে সব সময়। যারা ইন্ট্রোভার্ট, তারা এক্সট্রোভার্টদের একরকম এড়িয়ে চলতে চায় এবং তাদের বিভিন্ন কাজে খুব বিরক্তি পোষণ করে। ইন্ট্রোভার্ট্ররা অনেক সময় তাদের ‘এটেনশান সিকার’ বলেও আখ্যায়িত করে।

এক্সট্রোভার্টরা সবসময় ‘এটেনশান সিকার’ নয়

ক্লাসে যে সবচাইতে বাকপটু, যে সর্বদা শিক্ষকদের পছন্দের পাত্র, তাকে ক্লাসের অন্য ছাত্ররা খুব একটা যে ভাল চোখে দেখে তা নয়। আবার চাকরিক্ষেত্রে ‘বস’দের মন রক্ষা করে চলা সহকর্মীর পেছনে বাকিদের টিপ্পনি কাটার অভ্যাস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তবে মানুষ শুধু ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্ট এই দুই মেরুতেই আবদ্ধ নয়। আর দুটোর সংজ্ঞাও অতটা সরল সোজা নয়। কেউ কথা কম বললেই যে ইন্ট্রোভার্ট আর এর বিপরীতে এক্সট্রোভার্ট- তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

লেখিকা ও শিক্ষিকা কেন্ড্রা চেরি অনেকদিন ধরেই সাইকোলজি নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তিনি বেশ সুন্দরভাবে এক্সট্রোভার্টদের সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি এক্সট্রোভার্টদের কিছু বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো নিয়ে এবার আলোকপাত করবো।

কথা বলতে ভাললাগা

একজন এক্সট্রোভার্ট কথা বলতে বেশ পছন্দ করে। তারা শুধু নিজেদের পরিচিত লোকের মধ্যেই কথা বলে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লোকের সাথেও অবলীলায় মিশতে পারে। ইন্ট্রোভার্ট কথা বলার আগে সেই কথা সম্পর্কে চিন্তা করে, অন্যদিকে এক্সট্রোভার্ট তার চিন্তা ভাবনাগুলো অন্যের মাঝে খুব গুছিয়ে ব্যক্ত করতে পারে। আর এই গুণের কারণেই এক্সট্রোভার্ট লোকদের অন্যেরা খুব সহজেই পছন্দ করে ফেলেন। আর যেহেতু এরা কথা বলতে ভালবাসে, অন্যের সহচর্য ভাল লাগে এবং আড্ডা জমানোতেও বেশ দক্ষ, সেহেতু এদের চারপাশে এক বড়সড় বন্ধুমহল তৈরি হওয়া বেশ স্বাভাবিক।

আড্ডা মাতাতে এক্সট্রোভার্ট

 

সামাজিক কর্মকান্ডে অনেক বেশি মুখর

কোনো এক্সট্রোভার্টকে যদি একা থাকা বা কোনো গ্রুপের সাথে সময় কাটানোর মধ্যে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে সে অবশ্যই একা থাকতে অস্বীকৃতি জানাবে। নতুন নতুন লোকের সাথে মিশতে পারাটা তাদের অন্যতম বিনোদন। কোনো দলের সাথে আড্ডা বা গল্প নিজেকে আবার কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলে। এক্সট্রোভার্টদের একা রাখার মতো শাস্তি আর কিছু হতে পারে না। যেকোনো সামাজিক কর্মকান্ডে তাদেরকে অনেক বেশি অগ্রসর হতে দেখা যায়।

এক্সট্রোভার্টদের কিছু বিশেষ গুণ

সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে

কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে তা নিয়ে বিভিন্ন লোকের সাথে বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করে একটা সমাধানে আসা একজন এক্সট্রোভার্টের বৈশিষ্ট্য। অন্যের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে বিভিন্ন পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি উঠে আসে এবং সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটি অবলম্বন করা সহজ হয়। সারাদিন ঝামেলা ও কর্মক্লান্তি দিন শেষে বন্ধু্বান্ধব বা কাছের কারও সাথে সারাদিনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলে অন্য ধরনের প্রশান্তি এনে দিতে পারে। অন্যদিকে একজন ইন্ট্রোভার্ট সকল অব্যক্ত কথা মনের মধ্যে রেখে তা নিয়ে নিজেই চিন্তা করে সমাধান বের করার চেষ্টা করে।

নিজের সম্পর্কে বলতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে

অন্যদের কাছে আন্তরিক এবং মিশুক এমন সম্ভাষণ শুনতে অভ্যস্ত

‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে পরাবে?’ এ জাতীয় প্রশ্নে যেহেতু এক্সট্রোভার্টরাই এগিয়ে আসে, সেহেতু অন্যদের কাছে তারা সহজেই সাদরে স্বাগত হয়। কোনো পার্টিতে যেহেতু তারাই প্রথম পরিচিতি পর্ব শুরু করতে পারে, সেই কারণে অন্যদের কাছে তারা অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে ওঠে।

এক্সট্রোভার্টদের কাজ করার পদ্ধতি

এখন প্রশ্ন হলো, কী করে তৈরি হয় ইন্ট্রোভার্ট ও এক্সট্রোভার্টের মধ্যে পার্থক্য? অনেকের ধারণা এটা জন্মগত, আবার অনেকে মনে করে পারিপার্শ্বিক বেড়ে ওঠার মধ্যে এই গুণগুলো আয়ত্ত করা হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে দুটোরই সংমিশ্রণে ইন্ট্রোভার্ট বা এক্সট্রোভার্টের সৃষ্টি। কিছুটা বংশগতভাবে আসলেও শিশু কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এক্সট্রোভার্ট নাকি ইন্ট্রোভার্ট?

ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে এই গুণের উপস্থিতি বেশ ভালভাবেই টের পাওয়া যায়। সব শিশুই একটা চেনা গন্ডিতে বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে আশে পাশের মানুষজনের সাথে আত্মীকরণ করে। এর পরে আসে বাইরের জগত। অভিভাবকেরা শিশুকে কিভাবে গড়ে তুলতে চাইছেন সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুরা যখন বাইরের কারও সাথে কথা বলতে চায় না বা মিশতে চায় না, তখন বেশির ভাগ বাবা-মা সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেন। এসকল ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের কিছু করণীয় রয়েছে।

শিশুদের ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড; যেমন ছবি আঁকা, গান শেখা, আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। ডিবেট ক্লাব বর্তমান সময়ে একটি বেশ ভাল ব্যবস্থা। শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকেই বিতর্কে পারদর্শী করতে পারলে পরবর্তীতে ইন্ট্রোভার্ট হলেও কোনো প্রকার সমস্যায় পড়তে হয় না।

ডিবেট ক্লাব

শিশুদেরকে আরও বেশি বহির্মুখী করে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। শিশুরা যত বেশি খেলাধুলা করবে, তত বেশি বাইরের কারও সাথে মিশতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। পড়ালেখার সাথে সাথে যদি শিশুদের অন্যান্য দিকগুলোর প্রতিও সঠিকভাবে নজর দেয়া যায়, তাহলে তারা ইন্ট্রোভার্ট হোক কি এক্সট্রোভার্ট- কোনোটিতেই কোনো সমস্যা নেই।

এক্সট্রোভার্টরা পেশাগত দিক দিয়ে বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে তা বলতেই হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের মধ্যে অনেক বেশি নেতৃত্ব দানকারী ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে। যেহেতু এরা গ্রুপে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেই হিসেবে সকলের সাথে মিলে মিশে থাকতে পারে এবং সকলের পছন্দের পাত্র হয়ে উঠতে পারে।

দুই চরিত্রের আচরণ ভিন্ন

এক্সট্রোভার্টদের আরেকটি বিশেষ গুণ হলো তারা যেকোনো নেগেটিভ মন্তব্যের জন্য খুব একটা চিন্তিত থাকে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা সর্বদা পজিটিভ এবং উদ্যমী। যেকোনো পরিবেশে, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার এক অদ্ভুত গুণ তাদের মধ্যে বিরাজ করে। এই সকল গুণই সামাজিক অনেক কর্মকান্ডে তাদেরকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে। শিক্ষকতা, আইন, রাজনীতি, জনসংযোগ- এসব ক্ষেত্রে তারা বেশ ভালই সুযোগ করে নিতে পারে।

যদি সংখ্যার মননে প্রশ্ন আসে, অনেকেই ধরে নিতে পারেন এক্সট্রোভার্টের সংখ্যায় বেশি। কিন্তু বর্তমানে গবেষণার ফসল হিসেবে এর আবদার খুব একটা জোরালো নয়। সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্ট উভয় নিয়েই আমাদের সমাজ। এর কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ- সেই বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এর ভাল-খারাপ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। তবে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এক্সট্রোভার্টরা কিছুটা হলেও যে এগিয়ে, তা বোধকরি কেউ অস্বীকার করবে না।

This article is in Bangla language. It's about extrovert people.

References:

verywell.com/enfp-an-overview-of-the-champion-personality-type-2795980

Featured Image: yukle.mobi

 

Related Articles

Exit mobile version