প্রাচীন রোমে বিনোদনের জন্য মানুষ গ্লাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে যেতো। যুগের সাথে সাথে বিনোদনের মাধ্যম পাল্টে গেছে, গ্লাডিয়েটরদের রক্তাক্ত লড়াই আজকে আর দেখতে হয় না। বরং বিভিন্ন বিনোদন পার্কে গিয়ে ছুটির দিনটিকে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে আনন্দ করাই এখনকার যুগের চল। বিনোদন পার্কগুলোর অন্যতম আকর্ষণ থাকে রোলার কোস্টারের মতো রাইডগুলো। কিন্তু এসব বিপজ্জনক রাইড প্রায় সময়ই ডেকে আনে বিপদ। বিনোদনের মাধ্যম রক্তাক্ত না হলেও বিনোদন কেন্দ্রগুলো হয় রক্তাক্ত। পরিসংখ্যান মতে, বিনোদন পার্কের রাইডে মৃত্যুর হার প্রতি ৭৫০ মিলিয়নে মাত্র ১ বার হলেও মৃত্যু কখন কীভাবে হয় তার তো কোনো ঠিক নেই। চলুন জেনে নেয়া যাক বিনোদন পার্কগুলোতে ঘটে যাওয়া ১০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা।
১. কিংস আইল্যান্ড, ওহাইয়ো, আমেরিকা
১৯৯১ সালের ৯ জুন কিংস আইল্যান্ড বিনোদন পার্কে মৃত্যু যেন ভর করেছিল। শুরুটা হয়েছিল খুবই সাধারণ এক ঘটনা দিয়ে, একজনের পুকুরে পড়ে যাওয়ার মাধ্যমে। তাকে উদ্ধার করার জন্য তার এক বন্ধু ও পার্কের কর্মী পুকুরে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু পানি বিদ্যুতায়িত থাকার কারণে তিনজনই ইলেকট্রিক শকের শিকার হন। যাকে উদ্ধার করার জন্য দু’জন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পানিতে তিনি বেঁচে গেলেও উদ্ধারকারী দু’জন মারা যান। মৃত দু’জনেরই বয়স ছিল ২০ বছর।
সেদিনের ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু তা হয়নি। পুকুরের ঘটনার এক ঘন্টা পর ‘ফ্লাইট কমান্ডার’ নামের এক রাইড থেকে পড়ে যান ৩২ বছর বয়সী ক্যান্ডি টেইলর। পড়ে যাবার ফলে যে আঘাত পান তাতেই মারা যান তিনি। কিংস আইল্যান্ড নিয়ে আগে থেকেই কিছু ভৌতিক গুজব ছিল। এই পার্কে নাকি রাতে নীল জামা পরা এক মেয়েকে দেখা যায়। অনেকে দাবী করে থাকে এই ‘ভূতের’ কারণেই সেদিন দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল। তবে এরপর আর কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি কিংস আইল্যান্ডে।
২. বেলস অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ওকলোহমা, আমেরিকা
রোলার কোস্টার সবসময়ই দর্শকদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। উচ্চগতিতে উপর থেকে নামা কিংবা ৩৬০ ডিগ্রী ঘোরার সাহস সবার হয় না। ১৯৯৭ সালের ২০ এপ্রিল যারা সাহস করে বেলসের রোলার কোস্টারে চড়েছিলেন তাদের হয়েছিল এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। ২৫% ছাড়ের কারণে সেদিন পার্কে বেশ ভিড় ছিল। তবে সবচেয়ে ভিড় ছিল ‘ওয়াইল্ডক্যাট রোলার কোস্টারের লাইনে।
রোলার কোস্টারের একটি রাইড কার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠার পর সামনে না গিয়ে পেছনে চলে যায়। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে কারণে রোলার কোস্টারে কিছু নিরাপত্তা যন্ত্রাংশ থাকে। কিন্তু সেগুলো কাজ না করায় উপর থেকে পেছন দিকে ৪৫ ফুট চলে যায় এবং পেছন থেকে আসা আরেকটি কারের সাথে ধাক্কা খায়। ১৪ বছরের এক ছেলে সেখান থেকে মাটিতে পড়ে এবং মারা যায়। এত বড় দুর্ঘটনায় এই একজনই মারা গিয়েছিল। তবে আহত হয়েছিলেন আরো ৬ জন। ২০০৬ সালে পার্কটি বন্ধ হয়ে যায়।
৩. ডিজনিল্যান্ড, আমেরিকা
বিনোদন পার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ডিজনিল্যান্ড। কিন্তু দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পায়নি ডিজনিল্যান্ডও। ১৯৭৯ সালে ডিজনিল্যান্ড ‘বিগ থান্ডার মাউন্টেইন রেলরোড’ নামে একটি রাইড তৈরি করে। গুহা, খনি আর মরুভূমির মতো পরিবেশ তৈরি করে ট্রেনের মতো ছিল রাইডটি। একটি ইঞ্জিন আর ৫টি কারে মোট ৩২ জন দর্শনার্থী রাইডটি উপভোগ করতে পারতেন।
২০০৩ সালে এই রাইডেই ঘটে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গুহায় প্রবেশের পর হঠাৎ করে ইঞ্জিনের চাকা খুলে যায়। এর ফলে ইঞ্জিনটি উপরের দিকে উঠে গিয়ে গুহার ছাদে বাড়ি খায়। এরপর নেমে আসে সামনের রাইড কারে বসে থাকা যাত্রীদের উপর। ভয়াবহ এ ঘটনায় মারা যান একজন, আহত হন আরো দশজন দর্শনার্থী। তদন্তে রক্ষণাবেক্ষণে থাকা কর্মীদের দোষারোপ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে ডিজনি নিজেদের দায়ভার মুক্ত করে।
৪. এক্সপোল্যান্ড, ওসাকা, জাপান
১৯৭০ সালে জাপানের ওসাকায় চালু হয় এক্সপোল্যান্ড নামের বিনোদন পার্কটি। ৪০টিরও বেশি রাইড এবং ১৯টি রেস্টুরেন্ট নিয়ে বেশ জমজমাট ছিল বিনোদন পার্কটি। কিন্তু ২০০৭ সালের ৫ মে সব কিছু পাল্টে যায় ফুজিন রাইজিন-২ রোলার কোস্টার দুর্ঘটনায়।
প্রায় এক কিলোমিটারের রোলার কোস্টার রাইডটি বিকেলের প্রথম ভাগে ২০ জন যাত্রী নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু মাঝপথে যেতেই ছয়টি কারের দ্বিতীয়টি হঠাৎ বাম দিকে হেলে যায় এবং এক পর্যায়ে সবগুলো কারই লাইন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে যায়। প্রায় ৩০০ গজ সামনে গিয়ে পড়ে কারগুলো। দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান ১৯ বছর বয়সী এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, আহত হন আরো ১৯ জন দর্শনার্থী।
প্রায় ১৫ বছর ধরে রোলার কোস্টারের লাইন পরিবর্তন না করার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্তে উঠে আসে। দুর্ঘটনার পর তদন্তে লাইনে আরো বেশ কিছু খুঁত খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। যার অর্থ সেদিন দুর্ঘটনা না ঘটলেও যে কোনো দিন দুর্ঘটনা ঘটতোই। এ দুর্ঘটনার পর পার্কটি দর্শক হারাতে শুরু করে। প্রায় ৩৭ বছর চলার পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে পার্কটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
৫. ওয়ান্ডারল্যান্ড, নিউ জার্সি, আমেরিকা
নিউ জার্সির ওশান সিটি ছুটি কাটানোর বেশ ভালো একটি জায়গা। পর্যটকদের বিনোদনের একটি প্রিয় জায়গা ওয়ান্ডারল্যান্ড। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে এখানে ‘ওয়াইল্ড ওয়ান্ডার’ নামে একটি রোলার কোস্টার চালু করা হয়। মাত্র দু’মাস পরেই ২৮ আগস্ট এই ওয়াইল্ড ওয়ান্ডার শিকার হয় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার।
দুর্ঘটনার দিন প্রথম থেকে ভালোই চলছিল রোলার কোস্টারটি। যেবার দুর্ঘটনাটি ঘটে সেবার শুরুটিও ছিল আগের মতোই। কিন্তু ৪১ ফুট উপরে ওঠার পর হঠাৎ রোলার কোস্টারের কারগুলো পেছন দিকে চলে যায়। কারগুলোকে পেছনে যেতে বাঁধা দেয়ার জন্য যে কৌশল ছিল সেটি ব্যর্থ হয়। ফলে ৪১ ফুট উঁচু থেকে উচ্চগতিতে পেছন দিকে যেতে থাকে। কারগুলো লাইনে থাকলেও পশ্চাৎমুখী বলের কারণে এক মেয়ে ও তার মা কার থেকে পড়ে যায়। সেসময় কারটি মাটি থেকে প্রায় ১০ ফুট (১ তলার সমান) ছিল। তাদের দু’জনকে হাসপাতালে নেয়া হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
পশ্চাৎমুখী কারগুলো পেছনে গিয়ে আরো একটি কারকে ধাক্কা দেয়। এতে আরো দু’জন আহত হন। পার্কটিকে বেশ বড় ধরণের জরিমানা করা হয় এ ঘটনার পর। তবে পার্কটি এখনো চলছে এবং পরবর্তীতে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি সেখানে।
৬. ওয়াটারওয়ার্ল্ড, ক্যালেফোর্নিয়া, আমেরিকা
আগের দুর্ঘটনাগুলোতে যান্ত্রিক ত্রুটি ভূমিকা রাখলেও ১৯৯৭ সালের ২ জুন ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনায় যন্ত্রের কোনো ভূমিকাই ছিল না। তীব্র গরমের দিনে পানিতে দাপাদাপি করতে সবারই ভালো লাগে। আর সেটা যদি কোনো বিনোদন পার্কে বন্ধুদের সাথে হয় তাহলে তো কথাই নেই। ওয়াটারওয়ার্ল্ডে সেদিন এক হাই স্কুলের সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা গিয়েছিল আনন্দ করতে। কিন্তু আনন্দ শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় কান্নায়।
পুলে নামার আগে স্লাইড করে পানিতে পড়তে অনেকেই পছন্দ করে। হাই স্কুলের শেষের দিকে থাকা শিক্ষার্থীরাও স্লাইড করে পানিতে পড়ার জন্য স্লাইডের পাশে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু সমস্যাটা বাধে যখন ৩৩ জন একসাথে স্লাইডে উঠে। তাদের ওজনের কারণে স্লাইড ভেঙে নিচে পড়ে যায়। বুকের হাড় ভেঙে দিয়ে মারা যায় ১৭ বছর বয়সী এক ছাত্র। বাকি ৩২ জনও আহত হয়েছিল কম-বেশি। জুন মাসের শেষে স্কুলের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ১৭ জন শিক্ষার্থী তাদের সার্টিফিকেট নিয়েছিল হুইলচেয়ারে করে!
৭. ক্রুগ পার্ক, নেব্রাস্কা, আমেরিকা
স্থানীয় বিয়ার নির্মাতা ফ্রেডরিখ ক্রুগের মালিকানায় ছিল ক্রুগ পার্ক। ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই ‘বিগ ডিপার রোলার কোস্টার’ দুর্ঘটনাটিতে অবশ্য বিয়ার বা কোনো অ্যালকোহলের সম্পর্ক ছিল না। চার কারের রোলার কোস্টারটি প্রথমে ঠিকমতো যাত্রা শুরু করলেও প্রথম ঢালের কাছে গিয়ে একটি কারের ব্রেক ফেল করে। এর ফলে অন্য কারগুলোর সাথে গতির অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়। প্রায় ৩৫ ফুট উপর থেকে কারগুলো নিচে পড়ে যায়।
এ দুর্ঘটনায় ৪ জন মারা যান, আহত হন আরো ১৯ জন। এ ঘটনার পর শহরে রোলার কোস্টার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ক্রুগ পার্কে দর্শক কমতে থাকে। ১৯৪০ সালে পার্কটি বন্ধও হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে স্থানীয় জনগন পার্কটিকে সিটি পার্ক হিসেবে রূপান্তরের দাবী জানায়। ১৯৫৫ সালে পার্কটি ‘গালাঘের পার্ক’ নাম নিয়ে নতুন করে চালু হয়। তবে এবার আর রোলার কোস্টারের ঝুঁকি নেয়নি কেউ।
৮. ব্যাটারসি ফান পার্ক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
১৯৭২ সালে লন্ডন প্রত্যক্ষদর্শী হয় বিগ ডিপার রোলার কোস্টারের আরেকটি দুর্ঘটনার। কাঠের তৈরি এ রোলার কোস্টারটি ব্যাটারসি পার্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড ছিল। কিন্তু কাঠের তৈরি হবার কারণে আধুনিক স্টিল রোলার কোস্টারের থেকে বিপদ ছিল বেশি। ১৯৭২ সালের ৩০ মে বিকেলে ৩১ জন যাত্রী নিয়ে প্রথম ঢালের চুড়া থেকে পেছন দিকে পড়ে যায় রোলার কোস্টারের কারগুলো। লাইনচ্যুত হয়ে কারগুলো পড়ে যায়, মারা যায় ৫ জন শিশু। এছাড়া আহত হয় আরো ১৩ জন। এ ঘটনার পর রোলার কোস্টারটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুই বছর পর পার্কটিও বন্ধ হয়ে যায়।
৯. ইকো অ্যাডভেঞ্চার ভ্যালি স্পেস সিম্যুলেটর, শেনজেন, চীন
দর্শনার্থীদেরকে রকেটে করে মহাকাশে ভ্রমণের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ব্যাপার ছিল এটি। রোলার কোস্টারের কারের মতো ছোট ছোট কয়েকটি কার উচ্চগতিতে বৃত্তাকারে ঘুরত, সাথে এতে বসে থাকা দর্শনার্থীদের মহাকাশের বিভিন্ন ভিডিও দেখানো হতো। ২০১০ সালের ২৯ জুন হঠাৎ করে একটি কারে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরে যায়। ফলশ্রুতিতে সেই কারটি সহ সবগুলোই ৩৫ ফুট উপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৬ জন মারা যান আর ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। দুর্ঘটনার শিকার কারগুলোতে থাকা মোট ৪৪ জন যাত্রীকে হাসপাতালে নেবার পথে কারোরই জ্ঞান ছিল না।
১০. সিক্স ফ্লাগস গ্রেট অ্যাডভেঞ্চার, নিউ জার্সি, আমেরিকা
সিক্স ফ্লাগস গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘হন্টেড ক্যাসেল’। ভৌতিকতার কৃত্রিম স্বাদ পেতে মানুষ ভিড় করতো এখানে। ১৯৮৪ সালের ১১ মে ঠিক তেমনই ২৯ জন দর্শনার্থী গিয়েছিলেন এর ভেতরে। কিন্তু তারা জানতেন না এয়ার কন্ডিশনের বাতাসের কারণে ভেতরে ঘটতে চলেছে বিশাল এক দুর্ঘটনা। এয়ার কন্ডিশনের তাপের তারতম্যের কারণে ভেতরে থাকা দাহ্য পদার্থগুলোতে আগুন লেগে যায়। তাপমাত্রা এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় ২,০০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটে, গলতে থাকে ধাতু।
ভেতরে থাকা দর্শনার্থী এবং কর্মীরা প্রায় সবাই বের হতে পারলেও ৮ জন টিন এজার আটকা পড়ে যায় ভেতরে। আগুনের তীব্রতা আর ধোঁয়ার কারণে তারা আর বের হতে পারেনি। ফলে মারা যায় ৮ জনই। ভেতরে পুড়তে থাকা নরকে পুড়ে যাওয়া শরীরগুলো পরে শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি।