ফ্যাশন জগতের এমন একটি শব্দ রয়েছে, যা এই জগতের সাথে জড়িত অনেক মানুষকেই খুব সামান্য থেকে অনেক বড় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। আর সেই শব্দটি হলো ‘ইট’। এক কথায় এর অর্থ ‘যুগোপযোগী’, তবে এতটুকুতেই এই অর্থ সীমাবদ্ধ নয়। এর তাৎপর্য আরও গভীর। মূলত, চলতি সময়ের সবচেয়ে ট্রেন্ডি পোশাক ও অনুষঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বকীয়তা প্রকাশ করা ও জনপ্রিয়তা লাভ করাকেই ফ্যাশন জগতে ‘ইট’ শব্দটি দিয়ে অভিহিত করা হয়।
‘ইট’ শব্দের প্রবর্তন
শুধু মানুষের বেলাতেই এই শব্দটির প্রয়োগ হয় না, বিভিন্ন ফ্যাশন সামগ্রীর ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে ট্রেন্ড নির্ধারক হিসেবে এই শব্দটির গুরুত্ব অপরিসীম। ফ্যাশন ট্রেন্ডের আলোচনায় তাই ‘ইট’ সম্পর্কে আলোচনাটা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকে। ‘ইট গার্ল’ প্রথম ব্যবহার হয় ১৯২৭ সালে, আর ‘ইট ব্যাগ’ (টম ফোর্ডের ডিজাইনকৃত গুচ্চির ব্যাগ) প্রথম প্রবর্তিত হয় ২০০৩ সালে ভোগ ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধের মাধ্যমে।
প্রায় একই সময়ে টম ফোর্ডের কল্যাণেই ‘ইট শু’ এরও ব্যবহার শুরু হয়। ২০০৩ সালের ভোগ ম্যাগাজিনের এই কপিটি প্রিন্টে যাওয়ার সময়কালেই একই সাথে ‘ইট অ্যাক্সেসরি’ (ডিওরের ছক্কার আদলে তৈরী কানের দুল) ও ‘ইট গার্মেন্ট’ (জুসি কুতুরের ট্র্যাকস্যুট) এরও প্রবর্তন হয়। এরপর থেকেই শব্দটি ফ্যাশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ট্রেন্ড বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়।
সামাজিক গণমাধ্যমের আবির্ভাব ও প্রভাব
২০১০ এর দশক থেকে সামাজিক গণমাধ্যমের আগমনের পরে শব্দটির তাৎপর্য ও ব্যবহার আরও বিস্তৃতি লাভ করে, এর পরিচিতি আরও ব্যাপ্তি লাভ করে। এই সময় থেকেই ইট অভিহিত পোশাক ও অনুষঙ্গ ক্রয় করাই যথেষ্ট ছিল না, সেই সাথে উক্ত পোশাক ও অনুষঙ্গ পরিহিত অবস্থায় ছবি তুলে গণমাধ্যমে শেয়ার করার মাধ্যমে অন্যদের জানানোটাও প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে ঐ সকল পণ্য নির্মাতাদের যেমন তুলানমূলক কম খরচে প্রচারণার মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধি পেতে লাগল, তেমনি অনেক সাধারণ মানুষও নিজস্ব ফ্যাশন সচেতনতার গুণে প্রসিদ্ধি লাভ করতে শুরু করল।
আর এভাবেই ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের সময়সীমায় এমন কোনো ফ্যাশনজাত দ্রব্য ছিল না, যা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ‘ইট’ হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত একমাত্র দ্রব্য হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এই সময়ে এই সংখ্যাটি অনেক বেশি ছিল। বড় বড় ফ্যাশন হাউস থেকে শুরু করে নতুন করে যাত্রা শুরু করা ছোট আকারের বুটিকগুলোও সামাজিক গণমাধ্যমের বদৌলতে নিজেদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে ইট পণ্যের তালিকায় স্থান করে নিতে শুরু করল।
২০১০ সাল থেকে ফ্যাশন জগতে যতই পরিবর্তন আসুক না কেন, ইট মানসিকতা একই রকম থেকে যায়- “এটা দেখো। এটা পছন্দ করো। এটা প্রত্যাশা করো। এটা ক্রয় করো।” আর পরবর্তী সময়ে পণ্যটি যখন পুরনো হয়ে যায়, তখন “এটা বিক্রি করে দাও”।
২০১০ এর দশকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন জগতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১০টি ‘ইট’ পণ্য হলো:
১. মনসুর গ্যাব্রিয়েল বাকেট ব্যাগ
এই দশকের শুরুতে ট্রেন্ডি বলতে বড় আকারের পণ্যকেই বোঝানো হতো। ২০১২ সালে র্যাচেল মনসুর ও ফ্লোরিয়ানা গ্যাব্রিয়েল ছোট বালতির আকারের একটি ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে পৃথিবী জোড়া খ্যাতিলাভ করেন। ৫৯৫ মার্কিন ডলার মূল্যের এই ব্যাগটি খুব দ্রুত দোকান ও অনলাইন স্টোর- উভয় ধরনের প্রাপ্তিস্থান থেকেই বিক্রীত হয়ে যায়। এরপর থেকে অন্যান্য অনেক ব্র্যান্ড একই আকারের ব্যাগ তৈরি করলেও, র্যাচেল ও ফ্লোরিয়ানার অবদান অনস্বীকার্য।
২. অ্যাডাম সেলম্যান ও লু স্পেক্স-এর যৌথভাবে তৈরি ক্যাট-আই সানগ্লাস
২০১৭ সালে অ্যাডাম সেলম্যান, অস্ট্রেলীয় চশমার ব্র্যান্ড ‘লু স্পেক্স’-এর সাথে যৌথভাবে বিড়ালের চোখের আকৃতির ‘লা ললিতা’ নামের এই নতুন ডিজাইনের সানগ্লাসটির প্রচলন করেন। এই ডিজাইনটি আজও একইরকম জনপ্রিয়তার সাথে সকল শ্রেণির ফ্যাশন সচেতন মানুষকে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
৩. পশুর লোমে প্রান্ত আবৃত গুচ্চির লোফার জুতো
২০১৫ সালের শরতে পুরুষদের পোশাকের কালেকশনে আলেসান্দ্রো মিশেল, পেছনের দিকে অনাবৃত ও গোড়ালির সামনের দিকের অংশ পশুর লোমে আবৃত লোফার জুতো প্রদর্শন করেন। ব্র্যান্ডটি দাবি করে, এই জুতোতে ব্যবহৃত ঐ লোম ছিল দায়িত্বশীলভাবে প্রতিপালিত ক্যাঙ্গারুর লোম। এই জুতো ছিল মিশেলের ডিজাইনকৃত একাধিক প্রসিদ্ধ পণ্যের মধ্যে প্রথম।
৪. ভেটেমেন্টসের জিন্স
২০১০ এর দশক ছিল জিন্সের রাজত্বকাল। ২০১৫ সালে নেট-এ-পোর্টারে, ভেটেমেন্টস প্রথমবারের মত ‘প্যাচড্ টুগেদার’ বা ‘জোড়াতালি’ বিশিষ্ট জিন্সের তৈরি প্যান্ট বাজারে আনে। ১,৪৫০ মার্কিন ডলার মূল্যের এই জিন্সের সবগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে ফুরিয়ে যায়।
৫. স্ট্যান স্মিথ স্নিকার্স
সম্পূর্ণ সাদা চামড়ার ওপরে ‘কেলি গ্রিন’ নামক বিশেষ ধরনের সবুজ রঙের সামান্য ছাপ বিশিষ্ট, অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই স্নিকার্স নারী-পুরুষ সকলের জন্যই ছিল একইসাথে প্রতিদিন ব্যবহারের ও বিশেষ ক্ষেত্রে পরিধানের মত যথার্থ জুতো। ২০১০ এর দশকে বিভিন্ন ডিজাইনার এই জুতো প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাসের সাথে যৌথভাবে নিজস্ব সৃজনশীলতার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন তৈরি করেছেন। এই জুতো জোড়া এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, স্ট্যান স্মিথ নামক যে টেনিস খেলোয়াড়ের নামানুসারে এর নাম রাখা হয়, তিনি তার আত্মজীবনীতে বলেন, “সবাই মনে করে আমি বোধহয় এক জোড়া জুতো”।
৬. ডিওরের মুক্তোর তৈরী কানের দুল
ডিওরের ফ্যাশন জুয়েলারি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্যামিল মিশেলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ডিজাইন ছিল দু’টি মুক্তোর কানের দুল, যা আদিবাসীদের নকশার অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। এক জোড়ার পরিবর্তে একটি মাত্র কানের দুল পরার ট্রেন্ড যখন শুরু হয়, সেসময়ে বিক্রীত প্রথম কানের দুলের মধ্যে একটি ছিল এটি।
৭. ভ্যালেন্তিনোর রকস্টাড ফ্ল্যাট জুতো
ভ্যালেন্তিনোর তৎকালীন ক্রিয়েটিভ পরিচালকদ্বয় পিয়েরপাওলো পিচিওলি ও মারিয়া গ্রাজিয়া শিউরি’র উদ্ভাবন, এই রকস্টাড ডিজাইন ছিল ২০১০ এর দশকের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নকশা বা ছাপ- একথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। ছোট চ্যাপ্টা আকারের, পিরামিড আকৃতির এই ‘স্টাড’ এর প্রথম প্রচলন হয় পেছনের দিকে বেল্টওয়ালা ‘টি-স্ট্র্যাপ’ হিল ও সম্মুখে কোণাকৃতি ফ্ল্যাট জুতোতে। ২০১০ এর দশকে ফ্যাশন জগতের এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিল না, যেখানে এই ডিজাইনের জুতো দেখা যেত না।
৮. পিএস১ ব্যাগ
প্রেঞ্জা স্কুলারের পিএস১ ব্যাগটি প্রকৃতপক্ষে ২০০৮ সালে বাজারে এলেও, ২০১০ এর দশকের প্রথম দিকেই এটি ইট পণ্যের সমান জনপ্রিয়তা লাভ করে। ক্লোয়ির প্যাডিংটন ব্যাগ ও ক্যামব্রিজের স্যাশেল কোম্পানি ব্যাগের মাঝামাঝি ধরনের, স্যাশেল আকৃতির এই ব্যাগটি, এর নতুন ধরনের রঙ ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের কারণে দ্রুত ফ্যাশন সচেতন মানুষের মন জয় করতে সমর্থ হয়।
৯. ঈজী ৩৫০ বুস্ট স্নিকার্স
কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, ফ্যাশন জগতে সংগীত শিল্পী কেনি ওয়েস্টের ‘ঈজী’ ব্র্যান্ডের ৩৫০ বুস্ট স্নিকার্সের প্রভাব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ২০১৫ সালে অ্যাডিডাস অরিজিনালসের সাথে যৌথভাবে বাজারে আসা এই স্নিকার্স নতুন ধরনের বিক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভক্তকূল ও ক্রেতাদের একত্র করে।
১০. কেঞ্জো সোয়েটশার্ট
২০১১ সালে কেঞ্জোর ক্রিয়েটিভ পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত হয়ে ক্যারল লিম ও হাম্বার্টো লিওন সবার আগে কেঞ্জোর পুরনো পোশাকের ঘাঁটি খুঁজে স্বকীয় পণ্যের সন্ধান করেন। সেখানে তারা এই ফ্যাশন হাউসটির প্রতিষ্ঠাতা কেঞ্জো তাকাদার ১৯৭০ সালে ডিজাইনকৃত একটি বাঘের ছাপ খুঁজে পান এবং ২০১২ সাল থেকে সেটিকে এ যাবতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোয়েটশার্টে রূপদান করেন, যা এক নজরেই সকলে অনায়াসে চিনতে পারে।