সমুদ্রে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। এদের মধ্যে কিছু প্রাণী বেশ শান্ত প্রকৃতির। আবার কিছু প্রজাতির প্রাণী সমুদ্রের ত্রাস হিসেবে পরিচিত। এসব প্রাণী তাদের আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে স্থলে বসবাসকারী হিংস্র প্রাণীদের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। আজ সমুদ্রে বসবাসকারী তেমনি কিছু হিংস্র এবং ত্রাস সৃষ্টিকারী প্রাণীদের সম্পর্কে জানব।
অক্টোপাস
মহাসমুদ্রের এক বড় বিস্ময় এই অক্টোপাস। বহুরূপী এই জলদৈত্যের কান্ডকারখানা সত্যিই অবাক করার মতো। পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ প্রজাতির অক্টোপাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রশান্ত মহাসাগর, ভূমাধ্যসাগর, ভারত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর- সর্বত্রই প্রাণীটিকে দেখা যায়।
সমুদ্রের গভীরে, পাথরের খাঁজে এই প্রাণীটির বাস।পাথরের খাঁজে একবার চেপে বসতে পারলে একটা বড়সড় অক্টোপাস তার কর্ষিকার আকর্ষণে একজন মানুষকে টেনে ডুবিয়ে দিতে পারে। ওদের প্রধান অস্ত্র ওদের ধারালো দাঁত আর দেহের কাঁটা। ওদের শরীরে রয়েছে বিষের থলি, যেখান থেকে বিষ ঢালা আর কালো রং ছিটিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করে শত্রুকে কাবু করতে ওরা খুব পটু। উত্তেজিত হলে ঘন ঘন রঙ বদলায়।
কর্ষিকায় দুই সারিতে সাজানো ‘চোষক’ বা ‘সাকার’গুলো মারাত্মক আঠালো, চ্যাটচ্যাটে ও শক্তিশালী। একাবার চেপে বসতে চাইলে সে আর ছাড়তে চায় না। চোয়ালে দাঁত না থাকা সত্ত্বেও চোয়ালগুলো প্রায় শক্ত কাঁটার মতো। মাঝারি আকারের একটি অক্টোপাস এভাবেই দিনে দুই ডজন কাঁকড়া শিকার করে খাওয়াদাওয়া করে। অক্টোপাস মানুষকে আক্রমণ করেছে, এরকম বহু ঘটনাই শোনা যায়। কিন্তু প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা। জলে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, এরকম বস্তুকেই অক্টোপাস আক্রমণ করে।
মসৃণভাবে ভাসতে-ভাসতে সে ওই বস্তুর খুব কাছে চলে আসে, তারপর আচমকা সামনের দিকে ছিটকে এসে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ যখন ভাসতে-ভাসতে অক্টোপাসের পাথুরে বাড়ির নিজস্ব এলাকায় গিয়ে পড়ে, তখনই এই প্রাণীটি তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিতে মানুষকে শত্রু ভেবে আক্রমণ করে। তাই ডুবুরিরা সবসময় সাথে একটি ছোট ছুরি রাখেন। কর্ষিকাগুলো চেপে বসলে তখন ছুরি দিয়ে সেই কর্ষিকাগুলো কেটে ফেলেন।
‘হেপালোক্লোনা মাকুলোসা’ বা ‘নীলচে অক্টোপাস’ বিষাক্ত। একমাত্র এগুলোই আচমকা ধারালো শক্ত চোয়ালে যখন-তখন কামড়ে দেয়, সেই কামড়ে দেহে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তবু অক্টোপাসকে মানুষের শত্রু ভাবা যায় না। আসলে অক্টোপাস তার নিজস্ব অঞ্চলে কোনো অনু্প্রবেশকারীকে দেখলেই তখন কোনো না কোনো কৌশলে নিজেকে বাঁচাতে চায়।
স্কুইড
অক্টোপাসের মতোই একধরনের সেফালোপড জাতীয় প্রাণী। মাথায় ১০টি কর্ষিকা। কর্ষিকাগুলোর মধ্যে আটটি সমান মাপের, বাকি দুটি লম্বায় ওই আটটির চেয়ে অন্তত তিনগুণ বড়। পেরুর কাছে ‘ডসিডিসকাস জাইনাস’ নামে এরকম হিংস্র স্কুইড দেখতে পাওয়া যায়। ৩ মিটার লম্বা ও ১৫০ কেজি ওজনের এই প্রাণীটি কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি আস্ত মানুষকে ছিড়ে ফেলতে সক্ষম।
ব্যারাকুডা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমুদ্রে মাত্র এক ফুট জলে দাঁড়িয়ে পা ডোবাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক, একটি ব্যারাকুডা তার পায়ের নীচ থেকে খাবলা-খাবলা মাংস কেটে নিয়ে চলে যায়। প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরে সবশুদ্ধ প্রায় ২০ প্রজাতির ব্যারাকুডার সন্ধান পাওয়া যায়।
এদের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের ‘গ্রেট ব্যারাকুডা’ই সবচেয়ে ভয়াবহ। এটি পার্শে বা ভাঙন মাছের মতো দেখতে, দেহের তুলনায় মাথা আয়তনে বড়। চোয়ালে তীক্ষ্ম ছোরার মতো দাঁতের সারি, সেই দাঁতের আঘাতে খুব সহজেই খাবলা-খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেওয়া যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডুবুরি ও মৎস্যশিকারীরা এই খুনে মাছকে বেশ ভয় পান।
জায়ান্ট স্প্রাইডার ক্র্যাব
সমুদ্রের ১০০ ফুট নিচে এই মাকড়াশাকৃতির এই দৈত্যাকার কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র। জাপানের সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোতে এই ধরনের কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায়। একেকটি কাঁকড়ার ওজন ৪২ পাউন্ডের চেয়েও বেশি। অর্থোপড প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে এদের দীর্ঘাকায় পা রয়েছে। একেকটি পা ১২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই বিশালাকৃতির কাঁকড়া খুব সহজেই মানবশিশুকে ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। যেসব এলাকাতে এই প্রাণীর বাস, সেসব এলাকায় ডুবুরিরা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন।
স্টিং রে
গোলাকার ও চ্যাপ্টা শরীর নিয়ে বালির তলায় লুকিয়ে থাকে স্টিং রে। শিকার কাছাকাছি এলেই চাবুকের মতো লেজের ঝাপটা কষায়। সেই সরু লেজের গায় উঁচিয়ে থাকে বিষাক্ত কাঁটা, একেকটি কাঁটা লম্বায় প্রায় ৮-১০ সে.মি. এর মতো। এই কাঁটার বিষ রক্ত-সংবহনতন্ত্রে আক্রমণ করে, পেটে কাঁটা ফুটলে মৃত্যু অনিবার্য। অন্যত্র আঘাত ততটা মারাত্মক নয়, কাঁটা সঙ্গে সঙ্গে বের করে অ্যান্টি-টিটেনাস জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। পৃথিবীতে প্রায় ৯০ প্রজাতির স্টিং রে’র সন্ধান পাওয়া গেছে।
সী ক্রেইট
সমুদ্রে বসবাসকারী বিষাক্ত সাপের প্রজাতি এই সী ক্রেইট। এই সাপের বিষে মানুষের মৃত্যুও ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ডাঙায় র্যাটল স্নেককে সবচেয়ে ভয়ানক বিষধর সাপ হিসেবে বলা হলেও সী ক্রেইটের কাছে সে নেহাত শিশু। সী ক্রেইট র্যাটল স্নেক থেকে কমপক্ষে দশগুণ বেশি বিষাক্ত। এই সী ক্রেইট সমুদ্রের বেশ গভীরে চলাচল করে। তাই মানুষকে খুব একটা আক্রমণ করে না। তবে সমুদ্রের ছোট-বড় সব প্রাণীই তাদের ভয়ে থাকে তটস্থ।
তিমি
খুনে তিমি (কিলার হোয়েল) ও স্পার্ম তিমিকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। খুনে তিমি সাধারণত ঝাঁক বেঁধে থাকে, ডলফিন, সিল, স্কুইড, পেঙ্গুইন, এমনকি বিশালাকায় নীল তিমিকেও এরা আক্রমণ করে, মেরে ফেলে ও তার মাংস খায়।
এক খুনে তিমির পাকস্থলী থেকে একবার ৩২টি হাতি-সিলের মৃত্যুর নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। খুনে তিমি ঝাঁক বেঁধে মানুষের দিকে তেড়ে গেছে, এরকম কাহিনী অনেক আছে। কিন্তু শেষ অবধি এরা মানুষ খায় না। স্পার্ম তিমির অবশ্য মানুষখেকো বদনাম আছে। এদের গ্রাসনালী বেশ চওড়া, একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে সেই নালীপথ বেয়ে গলে যেতে পারে।
সী ক্রোকোডাইল
সমুদ্রের নিষ্ঠুর ও হিংস্র প্রাণীদের মাঝে অন্যতম এই সী ক্রোকোডাইল। এক টন ওজনের এই শিকারী প্রাণীর হাত থেকে জলের ও ডাঙার প্রাণীদের কারো রেহাই নেই। অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র অঞ্চলগুলোতে এই প্রাণীর বাস। এদের ধারালো দাঁতের সাহায্যে মূলত শিকার ধরে থাকে।
সমুদ্রের সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে দীর্ঘাকায়। ৬ মিটার লম্বা এই সামুদ্রিক কুমির বিশালাকারের হাঙর, বানর, ক্যাঙ্গারু সহজেই শিকার করতে পারে। শিকার যখন বড় হয়, তার দেহ নরম করার জন্য শিকারকে সমুদের গভীরে নিয়ে যায়। তরপর আস্ত শিকার গিলে ফেলে।
ফিচার ইমেজ- Pinterest.com