মায়ের গর্ভেও শেখে শিশু

ছোট্ট একটা প্রাণ, যে একটু একটু করে গড়ে উঠছে মায়ের গর্ভে, মানুষের রূপ নিয়ে তৈরি হচ্ছে পৃথিবীতে আসার জন্য- সে কি শুনতে পায় আমাদের বাইরের জগতের কথা? জাগতিক আনন্দ-বেদনা কি ছুঁয়ে যায় তাকে? মা যদি একটা গান শোনে, গানের সেই ছন্দে কি একটু মাথা নাড়িয়ে ফেলে সে-ও?

গর্ভকালীন মায়ের যেকোনো অনুভূতি ছুঁয়ে যায় গর্ভের সন্তানকে। সেই অনুভূতি মানসিক, বা শারীরিক যেটাই হোক না কেন। প্রশ্ন হলো, এই অনুভূতি বা পরোক্ষ জ্ঞান, সেটা কি শিশুর মধ্যে থেকে যায় স্থায়ীভাবে?

শিশুর শেখার শুরুটা হয় মায়ের গর্ভ থেকেই; Image Source: Baby Centre

খুব পরিচিত এক সহকর্মীর চার বছরের ছোট্ট কন্যাশিশুকে দেখেছিলাম বিশাল খটমটে সব বাংলা শব্দ অবলীলায় বলে যেতে, পড়তে। না, তার মা তাকে সেগুলো শেখায়নি। তার সামনে এসব শব্দ ব্যবহার করে কথাও বলা হয়নি। তাহলে সে শিখলো কী করে এসব শব্দ? অনেক ভেবে বের করেছিলেন মা, মেয়ে গর্ভে থাকার সময় প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস ছিল তার। জোরে জোরে পড়তেন তিনি। নিজে শুনতেন, গর্ভের সন্তানকেও শোনাতেন। সেখান থেকেই কি মেয়ের এমন শেখার ব্যাপারটা?

উত্তরটা জানা নেই। তবে মায়ের গর্ভে থাকার সময় একজন সন্তান কিছু ব্যাপার শিখে ফেলতে পারে কিনা, তার শেখার প্রক্রিয়াটা সেই সময় থেকেই শুরু হতে পারে কিনা তা জানার জন্যই আজকের এই আয়োজন। চলুন, দেখে নেওয়া যাক।

সম্প্রতি এক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে, গর্ভধারণের দশ সপ্তাহ থেকেই শিশুরা মায়ের মাধ্যমে ভাষা শিখতে শুরু করে। আর এজন্যই সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের মতে, মাতৃভাষা আর বিদেশী ভাষার মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারে শিশুরা জন্মের পর থেকেই। মস্তিষ্ক জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করে না এক্ষেত্রে। বরং শেখার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় তার আগ থেকেই। কীভাবে এই গবেষণা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষকেরা?

গর্ভধারণের ২৩তম সপ্তাহ থেকে একজন শিশু মায়ের পাশাপাশি বাইরের অন্যান্য শব্দও শুনে থাকে; Image Source: Cloudnine Hospitals

গবেষণাটি তারা পরিচালনা করেন ৮০ জন শিশুর উপরে যাদের বয়স ৩০ ঘন্টার কাছাকাছি। মায়ের ভাষা এবং বিদেশী ভাষা দুটোই তাদের সামনে বলা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া দেখা হয়। দুই সময়েই প্যাসিফায়ার মুখে ছিল শিশুদের। প্রত্যেকবারই মায়ের ভাষা বলার পর শিশুরা প্যাসিফায়ার চোষা বন্ধ করে দেয়, যেখানে বিদেশী ভাষার ক্ষেত্রে তাদের কোনোরকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। গবেষকদের মতে, মায়ের ভাষা শিশুর কাছ পর্যন্ত যায়, কারণ সেক্ষেত্রে ভাষার তরঙ্গ মায়ের শরীরের মাধ্যমে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। শুধু তা-ই নয়, গর্ভধারণের শেষ ট্রাইমেস্টারে চিকিৎসকেরা মাকে গর্ভের সন্তানের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রেও এজন্যই বেশি উৎসাহ দিয়ে থাকেন। কারণ, পরবর্তীতে ভাষার উন্নয়নে এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

তবে শুধু মায়ের কন্ঠ শুনতে পায় শিশুরা- এমনটা ভেবে যে বাবাদের কষ্ট হচ্ছে, তাদের জন্য বলছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে গর্ভের শিশু শুধু মায়ের কথাই শুনতে পায়। গর্ভধারণের ২৩তম সপ্তাহ থেকে একজন শিশু মায়ের পাশাপাশি বাইরের অন্যান্য শব্দও শুনে থাকে। শব্দের পাশাপাশি খাবারের স্বাদটাও চেনা হয়ে যায় তার। এ সময় শিশুর সাথে গান গাওয়া বা কথা বলা তার পরবর্তী যোগাযোগ দক্ষতাকেও বৃদ্ধি করে বহু গুণে।

মায়ের গর্ভে শিশু কী কী শিখতে পারে?

যদিও গর্ভে কোনো শিশু ঠিক কতটুকু শিখতে পারে এবং সেটা কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে গবেষকদের মতে, এক্ষেত্রে কিছু ব্যাপার নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার মতো।

শব্দ

গর্ভে শিশু দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের সময় থেকেই মায়ের হৃদস্পন্দন, নিঃশ্বাসের শব্দ, কন্ঠ, রক্তপ্রবাহের শব্দ, হজমের শব্দ ইত্যাদি শুনতে পায়। সাথে বাইরের কিছু কিছু শব্দও কানে আসে তার। সময় যত যায়, বাইরের শব্দগুলো ততই বাড়তে থাকে, স্পষ্ট হতে শুরু করে তার কাছে। তখন আপনি যদি তাকে কোনো গান শোনান, তাহলে হয়তো এমন না যে জন্মের পর সে গান পুরোপুরি মনে রাখতে পারবে। তবে হ্যাঁ, সেই গান বাজালে তার শান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি। কেন? হতে পারে, সে আসলেই গানটা মনে রেখেছে। আবার হতে পারে গানের ছন্দটা তার কাছে পরিচিত মনে হয়েছে।

গর্ভে শিশু দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের সময় থেকেই মায়ের হৃদস্পন্দন, নিঃশ্বাসের শব্দ, কন্ঠ, রক্তপ্রবাহের শব্দ, হজমের শব্দ ইত্যাদি শুনতে পায়; Image Source: Dr. Carrie Rigoni

নির্দিষ্ট কোনো ধরনের গান বাজালে বড় হয়ে সন্তান সেই গান গাইবে বা পছন্দ করবে, অথবা কোনো নির্দিষ্ট বই পড়ে শোনালে তেমন বই সে ভবিষ্যতে পড়বে, ব্যাপারটা এমন নয়। তবে তার সেই গান বা বইয়ের প্রতি পরবর্তীতে বাড়তি মনোযোগ কাজ করতে পারে, এমন সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি আছে বাস্তব নজিরও।

স্বাদ

গর্ভকালীন সময়ে মা যে খাবারগুলো খেয়ে থাকে সেই খাবারের স্বাদ তার অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডে প্রভাব রাখে। মা কোন খাবার খেয়ে ঝাল অনুভব করল, কোনটায় তার মিষ্টি লাগলো- সেটাও রপ্ত করতে শুরু করে শিশু সেসময়। গর্ভে খাবারের স্বাদগুলোকেও কিছুটা হলেও চিনতে শুরু করে একজন শিশু।

অনুভূতি

গর্ভে একজন শিশু যখন মাকে নির্দিষ্ট কোনো শব্দের পর কাঁদতে দেখে বা কোনো কিছুর পর হাসতে, খুশি হয়ে যেতে দেখে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে তার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়। কোনো উঁচু গলায় কথা কাটাকাটির পর মা যদি কান্না করে, শিশু সেই অনুভুতির সাথে পরিচিত হয়ে যায়। আর সেখান থেকে তৈরি হয় উঁচু আওয়াজের প্রতি তার ভয় আর নেতিবাচক অনুভূতির সম্পর্ক।

সবমিলিয়ে গর্ভে থাকা একজন শিশুর শেখার পুরো প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে একই ঘটনা বার বার ঘটার মাধ্যমে। একই অভিজ্ঞতা বার বার পেয়ে এবং সেই অভিজ্ঞতার ফলে মায়ের কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটা দেখে শিখতে শুরু করে শিশু।

শিশুর গর্ভকালীন শিক্ষায় অভিভাবক হিসেবে কিছু করার আছে কি?

গর্ভে খাবারের স্বাদগুলোকেও কিছুটা হলেও চিনতে শুরু করে একজন শিশু; Image Source: Parents

প্রথমত, একজন শিশু গর্ভে কোনোকিছু যে আসলেই স্থায়ীভাবে শিখছে সেটার কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। তবে হ্যাঁ, বিভিন্ন দেশে এই ব্যাপার গুরুত্ব প্রদান করে নানারকম পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়। যেমন-

কোরিয়ায় সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গর্ভকালীন সময় থেকেই যোগব্যায়ামসহ নানারকম কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গান শোনা, বই পড়ার মতো ব্যাপারগুলোও আছে এই পদ্ধতিতে।

ফ্রান্সে হ্যাপ্টোনোমি অনেকেই মেনে চলেন। এই পদ্ধতির মূল কেন্দ্র ছোঁয়া। তলপেটে ছোঁয়ার মাধ্যমে শিশুকে সে যে পরিবারের একজন অংশ সেটা বোঝানো হয় এই পদ্ধতিতে।

আর এই দুই পদ্ধতিতেই সাথে মেনে চলা হয় ঝামেলাহীন, সুষম খাবারসহ নির্ভেজাল একটা জীবনপদ্ধতি।

গল্প করার অভ্যাস, শরীরচর্চা করা, রোদে বাইরে বের হওয়া, সুষম খাবার খাওয়া, বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি অভ্যাস তাই গড়ে তুলুন গর্ভকালীন মাসগুলোতে। কারণ অল্প হোক বা বেশি, স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী, আপনি যে অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, আপনার গর্ভের শিশুও তো সেটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাই না?

Language: Bangla
Topic: Your child learns during pregnancy
References: Hyperlinked inside

Related Articles

Exit mobile version