রাস্তায় হাঁটছেন। কানে এয়ারফোন গোঁজা। সেখানে বেজে চলেছে একের পর এক গান। এমন সময় হুট করে কোনো গান কিংবা কোনো গানের কিছু অংশ শুনে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল? পেটের ভেতরে যেন প্রজাপতি উড়তে শুরু করল? এই পুরো ব্যাপারটির নাম ফ্রিসো। ফ্রেঞ্চ এই শব্দটির অর্থ শিহরিত হওয়া। আর বাস্তবেও, সুর, গান কিংবা গানের কোনো অংশ শুনে শিহরিতই হয়ে ওঠেন আপনি। ত্বকের নীচে যেন বিদ্যুৎ বয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে কোনো চিত্র, চলচ্চিত্রের অংশ কিংবা কোনো মানুষের সাথে কথা বললেও ব্যাপারটি ঘটে থাকে। তবে গানের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটিই বেশি ঘটে থাকে। কিন্তু কেন? কেন এমন কিছু ঘটে? এটা কি স্বাভাবিক নাকি স্বাভাবিক নয়? চলুন জেনে নিই বিস্তারিত।
প্রায় পাঁচ যুগ যাবত বিজ্ঞানীরা গানের মাধ্যমে মানুষের শিহরিত হওয়ার কারণ খুঁজেছেন। নানা রকম ধারণা থেকে সেগুলো সত্যি কিনা সেটাও মিলিয়ে দেখেছেন। আর সেই গবেষণা থেকেই বেরিয়ে এসেছে অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ। যদিও এখনো পর্যন্ত এই ব্যাপারে কাজ করে চলেছেন তারা। অনেকে ভেবে থাকেন, এমন কিছু আমাদের সাথে ঘটে সুরের হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারণে। আমরা যেটা আশা করি, কোনো গান বা সুর যদি তেমনটাই হয় কিংবা আমাদের আশার একেবারে উল্টোদিকে যায় তাহলে এমন অনুভূতি অনুভব করাটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সুর কিংবা গান শ্রোতার মানসিক অবস্থাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার একেবারে ইতিবাচক বিপরীত কোনোকিছু মানসিকভাবে তাড়িত করে।
তবে প্রশ্ন ওঠে পরিচিত সুর বা গানের ক্ষেত্রে। আমাদের খুব পরিচিত গান এবং সুর, যেটা কিনা আমরা অনেকবার করে শুনেছি, সেটা শুনেও কেন আমাদের গায়ের রোম বারবার শিহরিত হয়? বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, এমন হঠাৎ শিহরণ পাওয়া বা গুজবাম্পস হওয়াটা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তাপমাত্রার বেড়ে যাওয়া বা কমার উপরে নির্ভর করে এমন অনুভূতির মুখোমুখি হত মানুষ। যেমন, হুট করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলে আমাদের ত্বকের নীচের এন্ডোথার্মিক স্তর সেই পরিস্থিতিতে শরীরের সাথে মানানসই করে নেওয়ার চেষ্টা করতো। ফলে নিজ থেকেই রোম দাঁড়িয়ে যেত। এতে করে শরীর নিজস্বভাবে একটু হলেও উষ্ণ হয়ে পড়তো। ত্বক আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে গেলে সেটা আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেত। বর্তমানে পোশাক এবং প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এমন অনুভূতি অনুভব করার প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে। তবে মানুষ এখনো শিহরিত হওয়ার সেই অনুভূতিকে ভুলে যায়নি। বরং ব্যাপারটিকে এখন মানসিকভাবে গ্রহণ করেছে মানুষ। সুন্দর কোনো ঘটনা, শব্দ, আবেগ বা ব্যাপার মানুষকে এখনো মানসিকভাবে শিহরিত হতে সাহায্য করে। ফ্রিসো ব্যাপারটি ব্যাপক। তাই সেদিকে না গিয়ে এখানে কেবল সুর ও গানের সাহায্যে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া ফ্রিসোর কথাই উল্লেখ করব।
গান কিংবা সুর শুনে আমাদের মধ্যে যে শিহরণ তৈরি হয় সেটা কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এক নয়। কারো বেলায় ব্যাপারটি ঘটে, কারো বেলায় নয়। সম্প্রতি গবেষকেরা ব্যাপারটিকে আরো ভালো করে বোঝার জন্য একটি পরীক্ষা চালান। পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারী ২০ জন মানুষের মধ্যে দশজন নির্দিষ্ট কিছু গান শুনে শিহরিত হয়ে ওঠে। এসময় এই দুই দলেরই মস্তিষ্ক ডিফিউশন টেন্সর ইমেজিং (ডিটিআই) এমআরআইয়ের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা হয়। গানের সাথে সাথে শিহরণবোধ করেছেন যারা, দেখা যায় তাদের ব্রেইন ফাইবার অন্যদের চাইতে গভীর এবং বেশি। ব্রেইন ফাইবার আমাদের শ্রুত সমস্ত শব্দ এবং আবেগের মধ্যে সংযোগ ঘটায়। ফলে যাদের ব্রেইন ফাইবার বেশি তাদের ক্ষেত্রে এই আবেগ কাজও করে অনেক বেশি পরিমাণে। তবে শুধু গানের ক্ষেত্রে নয়, অন্যদের চাইতে একটু বাড়তি আবেগ এই মানুষগুলো সব সময়েই অনুভব করেন বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। এদের মধ্যে তাই গানের সাহায্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার ঘটনাও বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এই যেমন- গানের মাধ্যম মন ভালো হওয়া কিংবা খারাপ হওয়ার ব্যাপারটি এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে বেশি খেয়াল করা যায়। শারীরিকভাবে কিংবা মানসিকভাবে খারাপ থাকলেও গান অনেক বেশি সাহায্য করে এদেরকে সেই অবস্থা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। অবশ্য সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। গান কিংবা সুর যদি আপনাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে শিহরিত করতে পারে, তাহলে সেটি আপনাকে আপনার অন্যান্য আবেগ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করবে।
অবশ্য অনেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন ফ্রিসো এবং ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। গবেষকেরা ভেবেছেন যে, মানুষ গানের মাধ্যমে আলোড়িত হবে নাকি হবে না, সেটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটবে নাকি ঘটবে না সেটা নির্ভর করে তাদের ব্যক্তিত্বের উপরে। আর এই কথাটিকে মাথায় রেখেই গবেষণাগারে বেশ কিছু মানুষের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়। না, মস্তিষ্কের উপরে কোনো পরীক্ষণ চালানো হয়নি এবার। বরং মানুষ যেন নিজেই তার শিহরণের সময়টিকে জানাতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সেইসাথে তাদের ত্বকের উপরেও খেয়াল রাখা হয়েছে। তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন গান শোনানো হয় এবং বিভিন্ন মাত্রায় তাদের মধ্যে শিহরণ কাজ করে। কারো ক্ষেত্রে সেটা ক্ষণস্থায়ী হয়, কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। প্রতিটি গানের কিছু স্থান ছিল যেগুলোতে অনেক মানুষই শিহরণ অনুভব করেছেন। সেসব স্থানের সাথে অংশগ্রহণকারীদের শিহরণ বোধের স্থান মিলে যায় কিনে সেটাও খেয়াল রেখেছেন গবেষকেরা। পরীক্ষা শেষে দেখা যায় যে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা শিহরণবোধ করেছেন তাদের সবাই ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে কাছাকাছি। নতুন কোনো অভিজ্ঞতা পেতে এই মানুষগুলো অপেক্ষা করে থাকে। তাদের ব্যক্তিত্বের মোট দুটো ভাগ আছে। একটি ভাগ অনেক বেশি আবেগী, এবং অন্যভাগ কল্পনাপ্রবণ। ফলে তাদের অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকটা একরকম। সুতরাং এই গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশ পায় যে, কোনো গান কিংবা সুর শুনে মানুষ ফ্রিসো, গুজবাম্পস বা শিহরণবোধ করবে কিনা সেটা শ্রোতার ব্যক্তিত্বের উপরেও নির্ভর করে।
প্রশ্ন হল, ফ্রিসো ব্যাপারটি অনেক বেশি অহরহ ঘটে থাকলেও এটি কি আমাদের জন্য স্বাভাবিক, নাকি না? ফ্রিসো আমাদেরকে প্রভাবিত করে। মানসিকভাবে এবং সেখান থেকে শারীরিকভাবে আমরা ফ্রিসোর মাধ্যমে প্রভাবিত হই। এর প্রভাব ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’ভাবেই কিন্তু হতে পারে। গানের মাধ্যমে আপনি যেমন নিজের মনকে প্রফুল্ল করে তুলতে পারেন, তেমনি হয়তো আপনার মন অনেক বেশি হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে এই গান শুনেই। অনেকসময় সহিংস মনোভাবের অধিকারী করে তুলতে পারে কাউকে কোনো গান কিংবা সুর। তবে ফ্রিসোকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারলে গানের ক্ষেত্রে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। এই যেমন মিউজিক থেরাপি। এই থেরাপির ক্ষেত্রে গান এবং সুরকে মানুষকে সুস্থ করে তুলতে ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে এই কাজটি যে তাদের ক্ষেত্রেই বেশি কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা যায় যাদের ব্রেইন ফাইবার বেশি কাজ করে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিক দিয়ে পুরো ব্যাপারটিকে ইতিবাচক একটি ব্যাপারও বলা যায়।
ফিচার ইমেজ: Soul Post