নলখাগড়ার ভাসমান দ্বীপে ব্যতিক্রমী জীবন-যাপন

ইনকা সভ্যতার সময়কার কথা। রাজ্যসীমা বাড়াতে নানা এলাকা দখল করছিলো ইনকারা। বিভিন্ন আদিবাসীদের উপর হামলা করে সেসবের দখল নিত তারা। ইনকাদের এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে উরো উপজাতিরা (পেরুর প্রাচীন উপজাতি) বসবাসের জন্য নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করলো। সিদ্ধান্ত নিলো জলের উপর বসবাস করবে। শুধুমাত্র নলখাগড়া দিয়ে তৈরি করলো ভাসমান দ্বীপ। সেই দ্বীপেই গড়ে তুললো বাড়িঘর। জীবন-যাপনের সমস্ত আয়োজন হলো ভাসমান দ্বীপেই।

উরোদের ভাসমান দ্বীপ; Image Source: ibtravelperu.com.pe

ইনকা বা স্প্যানিশদের আক্রমণ হলেই তারা এই ভাসমান দ্বীপগুলো ভাসিয়ে দূরে নিয়ে যেতে পারত। এতে যেমন আত্মরক্ষাও হতো তেমনি নিজেদের বাড়িঘরও হারাতে হতো না। সেই থেকে শুরু, এখনও এই নলখাগড়ার ভাসমান দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। উরো উপজাতির বংশধররাই শত শত বছর ধরে এই দ্বীপে বসবাস করে আসছে।

নলখাগড়ার দ্বীপ

‘নলখাগড়ার ভাসমান দ্বীপে বসবাস’ শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি। জলের উপর নলখাগড়া স্তুপ করে তাতে বানানো হয়েছে ঘরবাড়ি। মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত প্রাণীও রয়েছে তাতে। শুকনো নলখাগড়ার দ্বীপেই চলছে রান্নাবান্না। চলছে জীবন-জীবিকার যাবতীয় কাজ।

ঘরবাড়ি, নৌকা সবই তৈরি নলখাগড়া দিয়ে; Image Source: getaroom.co.in

এখানকার প্রায় সবই নলখাগড়ার তৈরি। বাড়ি বানানো জন্য মাটির পরিবর্তে যে ভিত্তি, সেটি যেমন নলখাগড়া দিয়ে বানানো হয়েছে তেমনি ঘরগুলোও বানানো হয়েছে নলখাগড়া দিয়ে। এখানকার ফার্নিচার, নৌকা, হস্তশিল্প এমনকি ওষুধও বানানো হয় নলখাগড়া দিয়ে। নলখাগড়ার এই দ্বীপে যে ওয়াচটাওয়ার রয়েছে সেটিও নলখাগড়ায় তৈরি। নলখাগড়া দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে দ্বীপটির উপরের অংশ অমসৃণ, পাতলা। এর উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে মনে হয় যেন পানির উপর দিয়ে হাঁটছি! হাঁটার সময় অমনযোগী হলে যেকোনো পাতলা স্থানে পা ফসকে পানিতে ডুবে যেতে পারে।

কোথায় এই দ্বীপ?

পেরু এবং বলিভিয়ার সীমান্তে অবস্থিত ভাসমান দ্বীপ; Image Credit: rheanna

বসবাসের ব্যতিক্রমধর্মী এই দ্বীপগুলো গড়ে তোলা হয়েছে টিটিকাকা হ্রদের মাঝে। টিটিকাকা হ্রদটি পেরু এবং বলিভিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। পেরুর পুনো শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই এই দ্বীপের অবস্থান। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ নৌ-চলাচলযোগ্য হ্রদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৩, ৮১০ মিটার। জলের পরিমাণ হিসেব করলে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় লেক এটি

পৌরাণিক কাহিনী

লেক টিটিকাকা হচ্ছে ইতিহাস, কিংবদন্তি আর রহস্যে ভরপুর এক দ্বীপ। ইনকা মিথোলজী অনুসারে প্রথম ইনকা রাজা ম্যানকো কাপাকের জন্মস্থান এটি।

টিটিকাকা হ্রদের নিচে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ; Image Source: Bolivian Ministry of Culture

ইনকাদের অন্য একটি মিথে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তা দেবতা’ সূর্য, চাঁদ এবং তারা সৃষ্টির আগে এই লেক থেকে উঠেছিলেন। অ্যাটলান্টিস কিংবদন্তিতেও এই লেকের নাম রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এই লেকের জলের নিচে হারিয়ে যাওয়া শহর রয়েছে। অবশ্য গবেষকরা এর জলের নিচে প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন। হতেও পারে এর নিচে সত্যি সত্যি প্রাচীন কোনো শহর ডুবে আছে

কীভাবে ভাসছে এই দ্বীপ?

ভাসমান এই দ্বীপটি গড়ে তোলা হয়েছে টটোরা দিয়ে। টটোরা হচ্ছে লম্বাটে দ্রুত বর্ধনশীল স্থানীয় নলখাগড়া। এর নিচের দিকের ঘন এবং শক্তিশালী শিকড় উপরের অংশকে ধরে রাখে।

নলখাগড়ায় ভাসছে সব; Image Source: denomades.com

এই নলখাগড়া খুবই হালকা, কিন্তু একসাথে জড়ো করলে এগুলো বেশ শক্ত। হালকা হওয়ার কারণে এগুলো ভেসে থাকে। আর শক্ত হওয়ার কারণে অনেক ভারী জিনিসও এই নলখাগড়া ভাসিয়ে রাখতে পারে। নলখাগড়ার এই গুণটিকেই কাজে লাগিয়ে ভাসমান এই দ্বীপটি বানানো হয়েছে।

নলখাগড়ার শিকড়গুলো পচনশীল হওয়ার কারণে নতুন করে আরো বেশি নলখাগড়া এর উপর গাদা করে দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখা হয়। প্রয়োজন হলেই নতুন নলখাগড়া গাদা করে আরো ভাসমান বাড়ি তৈরি করা হয়। ফলে নলখাগড়ার এই দ্বীপটির আকার নিয়মিতভাবেই পরিবর্তন হয়

কী আছে টিটিকাকায়

প্রি-কলম্বিয়ান সাউথ আমেরিকার স্বাদ নিতে চাইলে টিটিকাকা হ্রদ একটি অবশ্য ভ্রমণ করার মতো স্থান। এখানকার জীববৈচিত্র যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।

টিটিকাকা হ্রদে দেখা মেলে সুন্দর এই পাখিগুলোর; Image Source: laketiticaca.com

এই হ্রদটি পাঁচশটিরও অধিক জলজ প্রজাতির বসতবাড়ি। এর মধ্যে পুনা আইবিস (সারস), চিলিয়ান পিংক ফ্লেমিংগো (রাজহাঁস) এবং ব্যাঙ নজর কাড়ার মতো। অবাক করার বিষয় হলো এই দ্বীপের একেকটা ব্যাঙ এত বড় হয় যে এগুলোর ওজন প্রায় তিন কেজির মতো হতে পারে। এই হ্রদের বেশ কিছু অংশ টিটিকাকা ন্যাশনাল রিজার্ভ দ্বারা সংরক্ষিত।

জীবন-যাপন

বর্তমানে দুই হাজারেরও বেশি উরো বংশধর ভাসমান এই দ্বীপগুলোতে বাস করে। বড় দ্বীপগুলো ১০-১২টির মতো পরিবার ধরে রাখতে পারে। ছোটগুলো ২-৩টি পরিবার। এখানে বসবাসকারী উরোদের নিজস্ব ভাষা হচ্ছে পুকিনা। কিন্তু সময়ের আবর্তে সেই ভাষা হারিয়ে গেছে। এখন তারা আইমারা ভাষায় কথা বলে

আপনি হয়তো ভাবতেই পারেন- শুকনো নলখাগড়ার উপর রান্নাবান্না কীভাবে সম্ভব? উরোরা রান্নার জন্য পাথর, মাটির চুলা ব্যবহার করে যেন আগুন বাইরে ছড়িয় পড়তে না পারে। এখানে রয়েছে বিশেষ ধরনের টয়লেট যেখানে নলখাগড়ার নিচের শিকড়গুলোই এই বর্জ্য শোষণ করে নেয়। পেরুর সরকার এই দ্বীপগুলোতে বেশ কিছু সৌরবিদ্যুত প্যানেল দিয়েছে। এতেই চলে লাইট, টিভি আর ফোন চার্জের কাজ। ফলে কিছুটা হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এখানে।

বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটে নলখাগড়ার উপর; Image Source: steemit.com

ভালোভাবে দেখাশোনা করে রাখতে পারলে এই ভাসমান দ্বীপ ত্রিশ বছর পর্যন্ত অনায়াসে টিকতে পারে। তবে নলখাগড়া পচে দ্বীপ নষ্ট হওয়ার আগেই নতুন করে নলখাগড়া যোগ করলেই বাসস্থান হারানোর ভয় নেই। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। পুরোনো নলখাগড়ার জায়গায় নতুন নলখাগড়া যোগ করলেই আগের মতো হয়ে যায়।

খাদ্যের যোগান

উরোদের খাদ্য এবং ওষুধ প্রায় সবই আসে এই টটোরা নামক নলখাগড়া থেকে। নলখাগড়ার নিচের সাদা অংশটি আয়োডিনের যোগান দেয়। ব্যথাযুক্ত স্থানে এই নলখাগড়া জড়ালে সেগুলো ব্যথা শুষে নেয়। বাইরে গরম পড়লে উরোরা নলখাগড়ার সাদা অংশ কেটে কপালে লাগায়। এতে বেশ ঠান্ডা লাগে। সাদা অংশ মাদকতা কাটাতেও ব্যবহার করা হয়। এই নলখাগড়ার ফুল থেকে চা বানানো যায়।

উরোদের খাদ্যের বড় একটা অংশ যোগান দেয় হ্রদের মাছ; Image Source: whoatravel.com

এই ভাসমান দ্বীপের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এখানে মাছ ধরা খুব সহজ। নলখাগড়ার গাদা ফুটো করে তার মধ্য দিয়ে বড়শি ঢুকিয়ে সহজেই মাছ ধরা যায়। এটা অনেকটা বরফ ফুটো করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার (আইস ফিশিং) মতোই। বেশি মাছ ধরতে হলে অবশ্যই নৌকা নিয়ে বের হতে হয়। মাছ যেন সংরক্ষণ করে রাখা যায় সেজন্য এই দ্বীপগুলো আদর্শ স্থান। নলখাগড়া সরিয়ে তার মধ্যে জাল বেঁধে রাখলেই মাছগুলো জালের মধ্যে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। এতে প্রয়োজনের অধিক মাছ সংরক্ষণ করে রাখতে পারে উরোরা।

আয় রোজগার

ভাসমান এই দ্বীপটিকে বেষ্টন করে আছে বে অফ পুনো। দ্বীপটিতে দুই হাজারেরও বেশি উরো বংশধররা বাস করে। তাদের প্রধান জীবিকা হচ্ছে মাছ ধরা এবং বুননশিল্প।

বিভিন্ন হস্তশিল্প আয় রোজগারের অন্যতম পথ; Image Source: Peru for Less

তবে বর্তমান সময়ে এসে পর্যটন খাত থেকেও তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। উরোরা নিজেদের জন্য মাছ ধরে। অতিরিক্ত মাছ শহরে বিক্রি করে। বিভিন্ন ধরনের পাখি, যেমন- গাঙচিল, হাঁস, রাজহাঁস শিকারও করে উরোরা। তারা বিভিন্ন কারুশিল্পের দোকানও দিয়ে থাকে, যেগুলোর মূল ক্রেতা পর্যটকরা।

কখন কীভাবে যাবেন

উরোদের এই ভাসমান দ্বীপ ভ্রমণের জন্য প্রথমেই যেতে হবে পেরুর পুনো শহরে। পুনো শহরে যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে লিমা, আরিকিপা ও কুস্কো থেকে। যদি বলিভিয়া থেকে যেতে চান তবে লাপাজের কোপাকাবানা থেকেও যাওয়া যাবে। নিজস্ব গাড়ি নিয়েও যেতে পারবেন, তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার হাজার মিটার উচু হওয়াতে আপনি যদি আগে থেকে উচ্চতার সাথে অভ্যস্ত না হন তবে সমস্যা হতে পারে। টিটিকাকা হ্রদে পৌঁছালেই পাওয়া যাবে নলখাগড়ার তৈরি বেশ বড় বড় নৌকা। এসব নৌকায় চড়ে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাওয়া যাবে সহজেই।

নলখাগড়ার তৈরি সুদৃশ্য এই নৌকাগুলো দিয়েই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে হয়; Image Source: getaroom.co.in

মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস এখানে শীতকাল। আর এ সময়টাই এখানে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস গরমকাল। এ সময় প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে বৃষ্টি আপনার ভ্রমণে বাধ সাধতে পারে। তবে আপনি যদি পুনো এবং কোপাকাবানার জনপ্রিয় উৎসব ডি লা ক্যান্ডেলারিয়ার অভিজ্ঞতা নিতে চান তবে আপনাকে ফেব্রুয়ারিতেই যেতে হবে।

বিভিন্ন মাসে টিটিকাকা হ্রদের তাপমাত্রার অবস্থা; Image Source: laketiticaca.com

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে সারা বছরই তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিরও নিচে নামতে পারে। তবে এখানকার গরমকাল মানে কিন্তু অতটা গরম নয়। এসময় তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির কাছাকাছিই থাকে। তাই গরমকাল ভেবে বোকামি না করে অবশ্য গরম কাপড় সঙ্গে নিয়ে যাবেন।

পর্যটকের চাপ

প্রতি বছর অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু এই দ্বীপগুলোতে ভ্রমণে আসে। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়। ব্যতিক্রমী জীবনযাপন আর হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করে। ফলে অসংখ্য মানুষের চাপ সইতে হয় নলখাগড়ার এই দ্বীপগুলোকে।

অসংখ্য পর্যটকের চাপ নিতে হয় নলখাগড়ার এই দ্বীপগুলোকে; Image Source: cindysafari.com

এজন্য ভাসমান দ্বীপটি ঠিকঠাক রাখা এখানকার বাসিন্দাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশাল সংখ্যক পর্যটকের ব্যবস্থাপনা করা বেশ কষ্টসাধ্য। ফলে এখানকার বাসিন্দাদের নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের বাইরে এসে আরও বেশি সময় ধরে পরিশ্রম করতে হয় পর্যটকদের ব্যবস্থাপনা এবং দ্বীপ ঠিক রাখার জন্য। পর্যটনশিল্প এখানকার বাসিন্দাদের হয়তো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে, তবে তাদের চিরাচরিত জীবনধারাকে হুমকির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

This article is about the lifestyle of floating uros island's people of Preu who live in the Lake Titicaca. They lead an exceptional life in a different way. Everything of this island's are made of totora bulrush.

Necressary references have been hyperlinked inside.

Feature Image © Serjio74/Shutterstock

Background Image © VasToLorde/wallpaperswide.com

Related Articles

Exit mobile version