সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবনের ঝড়-ঝাপ্টা দূর করার জন্য চায় প্রশান্তিময় ঘুম। এই ঘুম সেসব কর্মব্যস্তময় মানুষের কাছে পরের দিনের কাজ করার টনিক। আর যারা শান্তির সেই ঘুমের দেখা পান না, তাদের জন্য পরের দিনটা যেন এক দুঃসহ পরিস্থিতি। ভালো ঘুম না হলে পরের দিনে কাজে মনঃসংযোগ করা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। শুধু কি তা-ই? সারাক্ষণ মেজাজ থাকে খিটখিটে। খেতে অরুচি কিংবা সবকিছুতেই যেন ভুল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ঘুম না হওয়ার কারণে তাদের মনে এই প্রশান্তির ছোঁয়াটুকুও জোটে না। তবে কিছু ঘরোয়া প্রক্রিয়া আর জীবনযাপনে কিছুটা নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চললে ঘুমের সমস্যা সহজেই দূর করা যায়।
ঘুমের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা এবং সুন্দর, সৌম্য বেডরুমের পরিবেশ নিশ্চিত করা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া আরো তিনটি সুন্দর পদ্ধতি নিয়ম করে অভ্যাস করলে ঘরোয়াভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
পদ্ধতি ১: ঘুমাতে যাওয়ার সময় চাপমুক্ত থাকা
- ঘুমানোর সময় অবশ্যই এমন কিছু মনে আনবেন না যা আপনার মনকে অস্থির করে তোলে। মনে রাখতে হবে যে, মনের মধ্যে বিরাজ করা এসব অস্থিরতা সাময়িক এবং নিজেকে তা বোঝাতে চেষ্টা করুন। তাছাড়া ঘুমানোর সময় ঘুম থেকে উঠার সময় বা ঘুমাতে যাওয়ার সময় সম্পর্কে কোনোপ্রকার চিন্তা মাথায় আনা থেকে বিরত থাকুন।
- ঘুমানোর সময় চেষ্টা করুন সব রকম দুশ্চিন্তা ভুলে যেতে এবং চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে।
- দ্রুত ঘুম আসার জন্য কিছু অভ্যাস নিয়মিত গড়ে তুলুন। যেমন, উল্টো দিক থেকে সংখ্যা গণনা, সুন্দর কোনো দিন বা ভ্রমণের স্মৃতি মনে করা। ভাবতে থাকুন, আপনি এখন আপনার প্রত্যাশিত কোনো স্বপ্নরাজ্যে আছেন এবং আপনার মনোজগতে তা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করুন।
- ঘুমানোর আগে শুনতে পারেন কোনো মৃদু সঙ্গীত অথবা আপনার ভালো লাগার কোনো অনুভূতি ঘুমানোর পূর্ব মুহূর্তে লিখে রাখার অভ্যাস গড়ে তোলাটাও ভালো একটা ঘুম এনে দিতে সাহায্য করতে পারে।
- সন্ধ্যে ৬টার পর থেকে এমন সব কাজে নিজেকে নিযুক্ত রাখুন যেসব কাজ আপনাকে শৈশব থেকে শুরু করে বর্তমান সময়েও আনন্দ দিয়ে আসছে।
- ঘুমাতে যাওয়ার আগে তো বটেই, এমনকি সবসময় টিভি শো বা মুভি নির্বাচন করার সময় ভুতুড়ে যেকোনো সিনেমা পরিহার করে চলুন।
- শুধুমাত্র যে বয়স্করাই নির্ঘুম জেগে থাকেন তা কিন্তু নয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে। তাই পিতা-মাতার উচিত বাচ্চার খেয়াল রাখা এবং বাচ্চাদের ঘুমানোর সময় নির্ধারণ করে দেয়া, যাতে তারা সেই সময়েই ঘুমাতে বিছানায় চলে যায়। ঘুমানোর সময় বাচ্চাকে বই পড়ানোর অভ্যাস তৈরি করাতে পারলে বাচ্চা মজার কোনো বই পড়তে পড়তে সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে।
- অনেক সময় বাচ্চারা দুঃস্বপ্ন দেখার কারণে ভয় পেয়ে ঘুম যেতে চায় না। বাচ্চা যদি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, তবে তাকে নিশ্চিত করুন যে সে নিরাপদ স্থানেই আছে।
- বাচ্চাকে সবসময় কাছাকাছি কোনো স্থানে ঘুমানোর ব্যবস্থা রাখুন আর খেয়াল রাখুন তার ঘুমানোর পরিবেশ যেন খুব আরামদায়ক হয়। বাচ্চাকে সবসময় আনন্দ প্রদানকারী বই, খেলনা বা জিনিসপত্রের সাথে পরিচিত করান যাতে তার মনে ভালো চিন্তা খেলা করে এবং মস্তিষ্কের বিকাশ সুষ্ঠুভাবেই ঘটে।
পদ্ধতি ২: ঘুমের প্রশান্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
- ঘুমানোর আগে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এতে আপনার চারপাশের পরিবেশ ঘুমানোর সময় সম্পর্কে আপনার মস্তিষ্ককে সিগন্যাল পাঠায়। শুতে যাওয়ার আগে অন্তত পূর্বের ২০/৩০ মিনিট সময় রাখুন প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। প্রয়োজনে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে নিন, বেডরুমে হালকা আলো জ্বালিয়ে পরিবেশ শীতল করে নিন, বিছানায় শুয়ে টেবিল লাইটের আলোতে পড়তে পারেন যেকোনো ভালো মানের ফুরফুরে মেজাজের বই। এতে আপনার ভালো ঘুম হতে বাধ্য।
- বেডরুমের আলো সন্ধ্যা থেকেই হালকা মেজাজের এবং শীতল রাখতে চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে নীল বা সবুজ আলো ঘরে অন্যরকম প্রশান্তির আভা এনে দিতে পারে। যদি অন্ধকারকে একান্তই ভয় পেয়ে থাকেন তবে বেড সুইচের সাহায্যে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর ব্যবস্থা রাখতে পারেন যাতে করে ঘুম এলেই আলো নিভাতে বিছানা ছেড়ে উঠতে না হয়।
- যেহেতু আপনার ঘুম নিয়েই সমস্যা তাই অন্তত এক ঘন্টা আগে থেকে সকল প্রকার স্ক্রিন, যেমন টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেম, এমনকি সেল ফোনও বন্ধ বা সাইলেন্ট মুডে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। রাতের ঘুমটাই যেহেতু অধিক দরকারি, সেহেতু দিনের বেলায় চেষ্টা করবেন কোনো প্রকার ন্যাপ বা হালকা ঘুম না নিতে। এতে করে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না।
- খুব হালকা যোগ ব্যায়াম আপনার শরীরের পেশীগুলোকে প্রশান্তি এনে দিয়ে ভালো ঘুম হতে সাহায্য করতে পারে। এর জন্য আপনি সাপ্তাহিক কোনো যোগ ব্যায়াম ক্লাসে যোগদান করতে পারেন। এবং নিয়মিত ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ যোগাসনের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- খাদ্যাভাসের প্রতি যত্নশীল হোন। সকালের নাস্তায় স্বাস্থ্যকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন। বিকেল ৪টার পর চা, কফি অর্থাৎ ক্যাফেইন জাতীয় পানীয়, এমনকি যেকোনো প্রকার চকলেট গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। প্রচুর পানি পান করুন।
- ঘুমানোর আগে হালকা স্ন্যাক্স, যেমন সিরিয়াল বা এক গ্লাস গরম দুধ গ্রহণ করতে পারেন, তবে নজর রাখবেন তা অবশ্যই যেন ভারী পর্যায়ের কিছু না হয়। অনেক সময় ক্যাফেইনমুক্ত চা পানও প্রশান্তি এনে দিতে পারে।
- আপনার বাড়িতে কোনো পোষা প্রাণী থাকলে সে ব্যাপারে একটু কঠোর হোন। আপনার যদি পোষা প্রাণীটিকে সাথে নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে এবং মাঝরাতে তা আপনার ঘুম ভাঙ্গানোর প্রধান কারণ হয়ে থাকে তবে শিগগির সে অভ্যাস পাল্টিয়ে ফেলুন।
পদ্ধতি ৩: সতর্ক সুরক্ষা ব্যবস্থা
- অনেক সময় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যেমন- আগুন লাগা, ঝড়-বৃষ্টি বা কোনো খারাপ আবহাওয়া সংবাদ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। তাই আশপাশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সংবাদ সম্পর্কে জানুন এবং যতটুকু সম্ভব তার প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান।
- ঘুমানোর আগে অবশ্যই সমস্ত বাসার প্রধান লকিং সিস্টেম যাচাই করে নিতে ভুলবেন না। এটাও এক ধরনের নিরাপত্তা যাচাই পরীক্ষা, যা আপনার মস্তিষ্কে বার্তা পৌঁছে দিবে যে আপনি নিরাপদ স্থানেই রয়েছেন।
- যদি আপনার একান্তই একা ঘুমাতে অস্বস্তি হয় বা একা ঘুমানোর কারণে ঘুম না আসলে তখন আপনার কাছাকাছি থাকার জন্য পরিবারের অন্য সদস্যের সাহায্য নিন, প্রয়োজনে একসাথে হালকা মেজাজের গল্প বা কোনো সুখকর স্মৃতিচারণ করতে করতে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
এসব স্বাস্থ্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত উপায় নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে আত্মস্থ করা গেলে অচিরেই আপনি ঘুমের সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পেতে পারেন। নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট রাখুন, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখুন, আর যতটুকু সম্ভব চাপমুক্ত জীবনযাপন করার চেষ্টা করুন। আরেকটি কথা না বললেই নয়, ফাস্ট ফুড থেকে দূরে থাকুন, স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। তাহলে খুব সহজেই অনিদ্রাজনিত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।
ফিচার ইমেজ: nycva.org