ছোটবেলা থেকেই শাকসবজি খাওয়ার ব্যপারে আমাদের প্রচণ্ড অনীহা, আর ফলস্বরূপ আমাদের বাবা-মায়ের আপ্রাণ চেষ্টা জোরজবরদস্তি করে সেসব খাওয়ানোর। কিন্তু কেন জোর করে শাকসবজি খাওয়ানো এত জরুরি ছিল? ফাস্ট ফুড আর সফট ড্রিংকসের বদলে কেন এই শাকসবজিই আসলে আমাদের পরম বন্ধু? কারণ, বিভিন্ন রকমের ভিটামিন আর মিনারেল ছাড়াও শাকসবজিতে থাকে ফাইবার, যা আমাদের পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখতে মোটামুটি অপরিবর্তনীয় একটি উপাদান।
ফাইবার কী?
ফাইবার মূলত একধরনের কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা। উদ্ভিজ্জ বিভিন্ন কার্বোহাইড্রেট, যেমন- সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ, লিগনিন, পেকটিন ইত্যাদি ডায়েটারি ফাইবার হিসেবে পরিচিত। আরও পরিষ্কার করে বললে, শর্করার যে অংশ আমাদের পরিপাকতন্ত্র হজম করতে পারে না, তা-ই ফাইবার। ভাবছেন, যে বস্তু হজমই করা যায় না, সে আবার এত জরুরি হয় কী করে? যখন বেশিরভাগ খাদ্যোপাদান ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত হয়ে পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন ধাপে শোষিত হয়ে যায়, তখন ফাইবার মোটামুটি অপরিবর্তিত অবস্থায় পুরো পরিপাকতন্ত্র ভ্রমণ করে। ফলস্বরূপ আমাদের দেহে উৎপন্ন অতরল বর্জ্য মোটামুটি নির্বিঘ্নে নিঃসৃত হতে পারে।
বিভিন্ন প্রকারের ফাইবার
মূলত দুই ধরনের ফাইবার পাওয়া যায়- দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয়। দ্রবণীয় ফাইবার পানির সাথে স্বল্পমাত্রায় দ্রবীভূত হয়ে পিচ্ছিল ধরনের মিশ্রণ তৈরি করে। ওটমিল, চিয়া বীজ, আপেল, কিছু কিছু বাদাম, ডাল ইত্যাদি দ্রবণীয় ফাইবার। এই খাবারগুলো দেহে গ্লুকোজ লেভেল আর রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অদ্রবণীয় ফাইবার পানিতে একদমই দ্রবীভূত হয় না। গম, শাকসবজি, ফলমূলের খোসা, কাঠবাদাম, আখরোট, বিভিন্ন ধরনের শস্যবীজ অদ্রবণীয় ফাইবার। এই ধরনের ফাইবার খাদ্যকে সহজে পরিপাকতন্ত্রের ভেতর দিয়ে ভ্রমণে সাহায্য করে। এছাড়াও ফাইবার খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে মোট ক্যালরি ইনটেক নিয়ন্ত্রণে রাখে, নিয়ন্ত্রণে রাখে বার বার খিদে পাওয়ার অভ্যাসও। কোনো কোনো খাদ্যে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় দুই ধরনের ফাইবারই থাকতে পারে।
কী পরিমাণ ফাইবার খাবেন?
বিবিসি নিউজের একটি জরিপ অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী ফাইবার খান না। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ৩০ গ্রাম ফাইবার প্রয়োজন, একজন নারীর ক্ষেত্রে সেই মাত্রা ২৫ গ্রাম। ১৪-১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য এই পরিমাণ যথাক্রমে ২৮ ও ২২ গ্রাম। ৯-১৩ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েশিশুর প্রয়োজন যথাক্রমে ২৪ ও ২০ গ্রাম ফাইবার। ৪-৮ বছর বয়সী শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক পরিপাক কার্যক্রমের জন্য প্রতিদিন দরকার হয় ১৮ গ্রাম ফাইবার।
কীভাবে বাড়াবেন খাবারে ফাইবারের পরিমাণ?
দীর্ঘদিন ধরে ফাইবার নিচ্ছেন না বলে হুট করেই খাবারে একগাদা ফাইবার যোগ করে বসবেন না! আচমকা খাদ্যাভ্যাসে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যোগ করলে হতে পারে বদহজম, অম্ল, গ্যাস ইত্যাদি সমস্যা। ধীরে ধীরে ছোট ছোট পরিবর্তন এনে শুরু করতে পারেন আদর্শ খাদ্যাভ্যাস। যেমন-
১) সকালে ময়দার বদলে ব্যবহার করুন লাল আটা।
২) ওটমিল, কিনোয়া, চিয়া সীড ইত্যাদি হতে পারে নাশতার উপকরণ।
৩) অল্প অল্প করে বাড়িয়ে নিন শাকসবজির পরিমাণ।
৪) হালকা খিদে পেলে ফাস্ট ফুডের বদলে খান ফল-মূল অথবা বিভিন্ন রকমের বাদাম।
৫) মাঝে মাঝে মাংসের বদলে বিভিন্ন রকমের ডাল, সীমজাতীয় সবজির বীজ ইত্যাদি খেতে পারেন।
শুধু কোলেস্টেরল আর গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ নয়, ফাইবার কোলন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, অন্ত্রে ক্যান্সার প্রতিরোধে রাখে কার্যকর ভূমিকা। কোষ্ঠকাঠিন্য, আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) জাতীয় পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা এড়ানো যায় পর্যাপ্ত ফাইবার গ্রহণের মাধ্যমে। তাছাড়া, ওজন নিয়ন্ত্রণ করে দখলে রাখে পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম) জাতীয় সমস্যাগুলোও। তাই প্রতিদিন পরিমাণমতো ফাইবার গ্রহণ এবং পানি পান করার অভ্যাস আপনাকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকে অনেকাংশেই সুরক্ষিত রাখবে।