দূরত্ব কি হতে পারে ভালোবাসার অন্তরায়?

প্রেম, স্বর্গ থেকে নেমে আসা মর্ত্যের এক বিশেষ উপহার। সবাই নিজের এই বিশেষ সম্পর্কটির কথা খুব রূপকথার মতো করে মনের মধ্যে সাজায়। কেউ কেউ মনের আঙিনায় আসন্ন সম্পর্কের ‘নীল নকশা’ও করে ফেলে। কিন্তু কেউই কখনো তাদের কল্পনায়, তাদের সেই নীল নকশায় ‘দূরত্ব’ শব্দটিকে স্থান দিতে চায় না। সবাই কাছাকাছি থাকতে চায়, দূরত্ব কারো সয় না!

সঙ্গীর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া যেন একটি অলিখিত চুক্তির মতন। “তার সময়ের সবচেয়ে বেশি অংশ তো আমারই পাবার কথা”, এমনটিই ভাবনা অধিকাংশের। এখন এসব রূপকথার মতো ভাবনার মধ্যে যদি এসে দাঁড়ায় দূরত্ব, সময়ের সবটুকু পাবার বদলে যদি মাসে কিংবা দু’তিন মাসেও একবার দেখা না হয় প্রিয় মানুষটির সাথে, তখন কী হয়? আপনি কি যত্ন নেয়া ভুলে যাবেন? আপনি কি তার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করা ছেড়ে দেবেন? ঐ বিশেষ ব্যক্তিটি কি তখন আর আপনার প্রিয়ের তালিকায় শীর্ষে থাকবেন না? আপনি কি তখন আর মন উজাড় করে ভালোবাসবেন না? অনেক প্রশ্ন এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু উত্তরগুলো প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি সহজ।

হোক না এখানে রাত ওখানে দিন, তাতে কিছু এসে যায় না!, www.pixastock.com

চিঠির যুগ আর নেই আজকাল, দূরে থাকা প্রিয় মানুষটির চিঠির জন্য চিঠি পায়ে বাঁধা কোনো পায়রার দরকার পড়ে না আজ আর। মুঠোফোন, ইন্টারনেট সবসময়ই তো যুক্ত রাখছে আমাদের! কিন্তু তারপরও, দূরে থাকা সম্পর্কগুলো একটু জটিল হয়। ভালো থাকার উপায়গুলো তাতে একটু অন্যরকম হয়।

দূরে থাকলে সবকিছু বুঝতেই খুব বেগ পেতে হয়। বেগ পেতে হয় কারো ক্লান্তি বুঝতে কিংবা কখনো রাগ বুঝতে, মান ভাঙতে! চ্যাটবক্সের কোন শব্দ যে কোন মানে করে দেয়া হলো, আর কোন বাক্য যে কোনদিকে ধেয়ে আসছে, সবই বুঝতে বড্ড বেগ পেতে হয়! দিনশেষে ক্লান্ত কারো যদি দিনটি কেমন গেলো বলার আগেই ঘুম পেয়ে যায়, মুঠোফোনের ও’ প্রান্তে আরেকজন কি মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন না? যদি তাই থাকেন, এ-ও কি খুব ভালো কথা? অবশ্য এর উল্টোটিও ঘটে। যেমনটি এ যুগের হাবভাব বুঝে এ যুগেরই এক কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘মুঠোফোনের কাব্য’তে বলেছেন,

         “পাগলী আমার ঘুমিয়ে পড়েছে মুঠোফোন তাই শান্ত, আমি রাত জেগে দিচ্ছি পাহারা মুঠোফোনের এই প্রান্ত”।

খুব কি কঠিন এমন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কিংবা মানিয়ে চলা, যাতে দূরত্ব খুব বড় ভূমিকা পালন করে? যেখানে দু’জনের চারপাশ আলাদা, দিনগুলো খুব বেশিই আলাদা, পরিবেশের সাথে সাথ অভ্যেসগুলোও আলাদা, তখন কি শুধু যোগাযোগের প্রচন্ড সহজ মাধ্যমগুলো সহজেই করে দিতে পারে সবকিছু সহজ?

সবসময় সহজ মনে হবে না কিছুই, www.wikihow.com

দূরে থাকা কখনো কখনো কমিয়ে দেয় দূরত্বও

ওপার বাংলার সিনেমা ‘অন্তহীন’ এর একটি কথা মনে পড়ে গেলো,

“Sometimes absence is required to feel someone’s presence intensely”- কারো উপস্থিতি প্রবলভাবে অনুভব করতে চাইলে কখনো কখনো তার অনুপস্থিতিরও প্রয়োজন হয়।

যারা দূরে থাকেন, তারা জানেন কাছে থাকতে পারাটা কত দামী! প্রতিদিন কিংবা দু’একদিন অন্তর অন্তর যে জুটিটির নিয়ম করে দেখা হচ্ছে, পার্কে বসে বাদাম চিবুচ্ছেন, ক্লাস কিংবা অফিস শেষে ক্লান্ত মুখে বসছেন গিয়ে একটি রেঁস্তোরায়, তাদের কাছে দেখা হওয়া বিষয়টি একসময় আটপৌরে হয়ে যায়। সত্যি হয়ে যায়। খুব বিশেষ বলে যে একটি স্থান থাকে সাক্ষাতের, তা কেন যেন হারিয়ে যায়।

এই ব্যাপারটি ঘটার ভয় নেই দূরে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার! তারা সহজে সাধারণ হয়ে যান না একে অপরের কাছে। প্রিয়জনের হাতের একটু ছোঁয়া, একটা মুচকি হাসি আর এক মুহূর্তের চোখাচোখিও যেন বিশেষ হয়ে ওঠে এই দূরে থাকা সম্পর্কে!

প্রতীক্ষা কি সবসময়ই কষ্টের?

ছোট ছোট আনন্দগুলো ভাগ করে নিন, www.boredpanda.com

প্রেমের ক্ষেত্রে প্রতীক্ষা যত দীর্ঘ হয়, অনুভূতি তত গভীরতর হয়। একেকটি দিন গোনা, কখন কর্পোরেট জীবন বাস্তবতা থেকে হাঁফ ছেড়ে কয়েকটা দিন ছুটি মিলবে আর ক’দিন পর দেখা পাবেন তার! কি মিষ্টি ব্যাপারগুলো, তাই না? একটি লম্বা বাস কিংবা ট্রেন জার্নি একদম ক্লান্তির মনে হয় না, যখন ঐ প্রান্তে অধীর অপেক্ষায় কেউ একজন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন কারো মুখের তৃপ্ত হাসি দেখে মনে হতে বাধ্য, প্রতীক্ষা সবসময় কষ্টের না!

মিলনের চেয়ে তাই বিরহ মধুর

বিরহের গান তো গেয়ে গিয়েছেন কত কবি আর গায়ক, “প্রিয় যদি দূরে চলে যায়, সে যে আরো প্রিয় হয় জানি”। কারণ যে প্রিয়, সে কখনো সত্যি দূরে চলে যায় না, আর সে যে দূরে যেতে পারে না এর জন্যই কখনো কখনো দূরে থাকা দরকার! গন্তব্যের চেয়ে যখন পথ চলতে বেশি আনন্দ হয়, তখন বলাই যায়, মিলনের চেয়ে তাই বিরহ মধুর। গন্তব্যের চিন্তা না করে দূরে থেকেও একসাথে পথ চলুন। হাতটা নাহয় নাই ধরা থাকলো, মনটা তো কাছে আছে! আর চোখের আড়াল হলেই কিন্তু মনের আড়াল হয় না!

আপনার কাছে তার দাবিটুকু বুঝুন

দূরে থেকেও একসাথে ভালো থাকার চেষ্টা করুন, www.krazyinlove.com

আপাতদৃষ্টিতে দূরে থাকা সম্পর্কগুলো খুবই কঠিন মনে হবে, কিন্তু একটু চেষ্টা করলে এর চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। দিনের শুরু দু’জনে একসাথে করুন, পারলে তার ঘুমটা ভাঙান। ঘুম ঘুম গলায় তার ‘শুভ সকাল’ বলাটা কখন যে ব্যস্ত একটি দিনের শুভ শুরু করে দেবে, আপনি টেরই পাবেন না!

কাজের ফাঁকে একটু খোঁজ নিন সে কী করছে, তার কাজ ঠিকঠাক চলছে কি না, সময় করে জানিয়ে দেন “ভালোবাসি”! ব্যস্ত দিনের শেষে দু’চারটে কথা, আপনার ক্লান্তির ভার হালকা করে দিতে পারে। কার কেমন কাটলো দিনটি, গল্পের ফুলঝুরি ফুটবে দু’দিকে। খুব কঠিন তো নয়, দূরে থেকে ভালো থাকা, শুধু আপনার সঙ্গীর, আপনাদের সম্পর্কের আপনার কাছে দাবিটুকু বুঝুন, তাতেই হবে।

এটিকে বরং একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিন

মাঝে মাঝে একলা লাগলেও এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিন! www.tumblr.com

নাহয় একটু কষ্ট হবে, মাঝে মাঝে খুব একলা লাগবে, মনে হবে যদি প্রিয় মানুষটি এত দূরে না থাকতো! মনে হবে, যদি নিয়মিত দেখা হতো, তবে হয়তো এত একলা লাগতো না। প্রায়ই নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হবে, মনে হতেই পারে দূরত্ব বেড়ে ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে আকাশ! অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে যাবে প্রায় বিনা কারণে, পাহাড় ডিঙানো কঠিন মনে হবে। কিন্তু তারপরও দিন শেষে জিতিয়ে দিন আপনাদের সম্পর্ককে, প্রতিকূলতাকে নিজেদের সবল দিক ভেবে নিন। দূরে থাকাটাকে বরং একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভেবে নিন, একসাথে দু’জনে মোকাবিলা করুন দূরত্বের।

ভালোবাসুন, অন্তত দু’টো মুখে একসাথে তৃপ্তির হাসি ফোটান!

কাছে কিংবা দূরে, তবু ভালোবাসুন,
lombok.bizz

নিজেদের একটা জগত থাকুক আপনাদের, যাতে প্রায়ই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারেন একসাথে। কল্পনায় সে জগতে ঘুরতে যান, যখন তখন! দেখা হলে কী কী করবেন প্ল্যান বানান, মুহূর্তগুলো জমিয়ে রাখুন, দূরত্বের ক্ষতি একসময় পুষিয়ে নেবেনই নেবেন! ভালো থাকার জন্য কাছে নয়, পাশে থাকাটা জরুরি। তাই আর কিছু না হোক, অন্তত দু’টো মুখে হাসি ফোটান! কাছে কিংবা দূরে, তবু ভালোবাসুন!

Related Articles

Exit mobile version