আমাদের সমাজে বিবাহিতা নারীদের অব্যক্ত কষ্টের কাহিনী

পড়ন্ত বিকেলে মৃদু আলো আঁধারের লুকোচুরিতে, এক কাপ কফি হাতে বসে জীবনের ডায়েরীটা খুলে বসলে আপনি হারিয়ে যাবেন অতীতের কোনো এক আনন্দঘন বা বিমর্ষ স্মৃতির পাতায়। আজ আপনাদের সাথে জীবনযুদ্ধে লড়াই করা এক মেয়ের ধুলো পড়া ডায়েরীটার কিছু লেখা সবার সাথে শেয়ার করব। হয়ত এমন ঘটনা আপনার জীবনেও ঘটেছে , হয়ত আপনিও এমন অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছেন, হয়ত আপনার নিঃশব্দ আর্তনাদগুলো হাহাকার করছে।

ভেবে নেই মেয়েটির নাম নীলা। নীলকণ্ঠ পাখির মতো হয়তো সে-ও কিছু কষ্টের বিষ ধারণ করে আছে। অফিস থেকে ফিরে নীলা ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় বসে। আজ অফিস থেকে একটু আগেই সে বেরিয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে । এই সময়টা সাধারণত বাসায় কেউ থাকে না। অন্তিম (নীলার স্বামী) বাসায় ফিরতে এখনো অনেক দেরী। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে একসময় সে আনমনা হয়ে যায়। ফিরে যায় অতীতে, যখন সে সদ্য বিবাহিতা।

নীলার বিয়ে হয়েছে আজ ৫ বছর হলো। এই পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে সে অনেকটা সংগ্রাম করেই এতদূর এসেছে। বিয়ের সাতদিনের মাথায় যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে খুব সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে নালিশ করা হয় নতুন বউয়ের নামে, তখনও নীলা বুঝে ওঠেনি তার আগামী দিনগুলো কেমন হতে চলেছে। বিয়ের রেশটাই তখনও কাটেনি যে! যা-ই হোক, সেদিন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক কটু কথা বলে, নীলা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারে না, নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে। অপেক্ষায় থাকে, যে নতুন  মানুষটা তার জীবনের চলার পথের সাথী হয়েছে, সে সত্য-মিথ্যার যাচাই অবশ্যই করবে এবং সত্যের পক্ষেই থাকবে। নীলার ভুল ধারণা ভাঙে, অন্তিম সত্যের সঙ্গ দেয় না। নীলা কোথায় যেন অনেক বড় একটা ধাক্কা খায়, বুঝতে পারে তার এ চলার পথ সহজ নয়। পায়ের নীচের মাটিটুকু তার স্থিতিশীল নয়।

শুরু হয় পথচলা, দিনের পর দিন এহেন নানা রকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে নীলার জীবনের রেলগাড়িটা চলতে থাকে। দিনের পর দিন মিথ্যে অপবাদগুলো মাথায় চেপেছে নীলার। স্বামীর সংসারে এসে সে একটা নির্ভরতার আশ্রয় পায় নি। স্বামীর কাছে সে ঘরে পড়ে থাকা এক ফেলনা, অপ্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে, যাকে অন্তিম চাইলেই ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে যখন তখন।

অন্তিমের কাছে নীলার জন্য কোনো সময় নেই। সময় নেই ৩৬৫ দিনের মধ্যে একবারের জন্য হলেও জিজ্ঞেস করার যে, “নীলা তুমি কেমন আছো?” অসুস্থ হলে নীলাকে কখনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না অন্তিম, তার কাছে মনে হয় নীলা অভিনয় করছে। প্রচন্ড জ্বরে যখন নীলা একটু ঔষুধ এনে দেয়ার কথা বলে, তখনও অন্তিমের মনে হয়- এ নিছক অভিনয়।

মন খুলে নীলা কখনো অন্তিমের সাথে গল্প করতে পারে না, কারণ নীলা যা-ই বলুক না কেন, প্রতিটা কথার ক্ষেত্রেই সে অনেক কটু মন্তব্য করে। নীলা যা-ই করুক না কেন, অন্তিমের কাছে সবই ভুল মনে হয়। সকলের সামনে নিজের বউকে অপদস্থ করার কোনো সুযোগ সে ছাড়ে না। এমনকি নিজের স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরীর লেখাগুলোও ( নীলা এবং অন্তিমের বৈবাহিক জীবন নিয়ে লেখা) গোপনে স্ক্যান করে সবাইকে মেইল করে জানানোর মতো নিচু মনমানসিকতার কাজ করতেও পিছপা হয় না সে।

 

নীলা এই ঘটনা জানতে পারে অনেক দিন পর। যেদিন জানতে পেরেছিল, সেদিন সারারাত সে বিছানায় স্থবির হয়ে বসেছিল আর চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছিল। নীলা বুঝতে পারে না, অন্তিম কি করে এমন একটা কাজ করল। কি এমন অনৈতিক কিছু লেখা ছিল সেই ডায়েরীতে! নীলার কাছে আজও এই প্রশ্নের উত্তর অজানা। সেই ডায়েরীর মাঝে সবরকম কথাই লেখা ছিল, যা একজন স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্চনীয়। নীলার  শ্বশুরবাড়ির সকলের কাছেই মেইলটা করা হয়েছিল। নীলা সেই যে ডায়েরীটাকে ড্রয়ারবন্দী করেছে, আজও সাহস পায় না ডায়েরীটা খুলে দু’কলম লিখতে।

আজ ৫ বছর যাবত কোনো ভালো একটা দিনের কথা নীলার মনে পড়ে না। নীলা বহুবার জানতে চেয়েছে অন্তিমের এমন করার কারণ কি, কিন্তু প্রতিবারই সে কোনো জবাব পায় না। বহুভাবে সে চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা ভালো করার, কিন্তু একতরফা কোনো কিছু কখনো হয় না। আর অন্তিমও বোধহয় সঠিকভাবে জানে না যে, সে কি চায়। এই সম্পর্কটা থেকে নীলা কখনো বের হয়ে আসতে পারবে না, কারণ সে নারী। আর নারীদের জন্য সমাজের কিছু বেঁধে দেয়া নিয়মের মধ্যে এটা পড়ে না যে, যত যা-ই ঘটুক না কেন, একজন নারী কখনো সংসার ছেড়ে যেতে পারবে না।

ঘুণে ধরা এই সম্পর্কটা থেকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত অশান্তি হতে কিছুটা রেহাই পাওয়ার জন্য নীলা নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখতে শুরু করে। চাকরী, সংসার সব কিছু নিয়ে এখন নীলা অনেক ব্যস্ত। শত ব্যস্ততার মাঝেও কখনো কখনো উঁকি দেয় কষ্টগুলো, নীলা তার ব্যস্ততার মাত্রাটাও বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই চলছে তার জীবন।

আজ হঠাত পড়ন্ত বিকেলে একলা বসে নীলার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু আজ নীলা কাঁদছে না, তার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘশ্বাস।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়ভারটা সমাজ বোধয় শুধু মেয়েদের জন্যই রেখেছে। সেখানে পুরুষের ভুমিকা নামমাত্র। নামমাত্র বললেও মনে হয় একটু বেশি ই বলা হয়। পুরুষের ভাবনাটা এমন যে, নারীরা তাদের ঘরের আশ্রিতা মাত্র, বাবার ঘর ছেড়ে তার সংসারে থাকতে এসেছে। যে সংসারকে “আমাদের” এর চেয়ে “আমার” সংসার বলে আখ্যায়িত করতেই পুরুষরা বেশি পছন্দ করে। এই “আমাদের” আর “আমার” এই দুটি শব্দ থেকেই বোঝা যায় যে, এক জন পুরুষ একজন নারীকে কতটুকু সম্মান আর অধিকার প্রদান করে থাকে।

পুরুষের এই “আমার” সংসারে এক জন নারীর সর্বদা একতরফা চেষ্টা থাকে সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখার। সে চেষ্টা করে প্রতিটা সকাল যেন শুভ হয়, প্রতিটা দিন যেন স্বামীর মুখের হাসি অটুট থাকে। সে দিনের পর দিন চেষ্টা করেই চলে, এর মাঝে সে হারিয়ে ফেলে নিজের হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ। পরিণত হয় এক যন্ত্রে যার মূল লক্ষ্য থাকে সংসারের শান্তি। সংসারে শান্তির বিনিময়ে একজন নারী পায় অজস্র তীক্ষ্ণ  কথার বাণ, অজস্র অপমান, চাপা কষ্ট আর কিছু নীরবতা। সঙ্গী হয় রাতের স্তব্ধতা, নীরবতা আর অশ্রু। সব কিছু মেনে নিয়ে একজন নারী সংসারের এক নিত্য প্রয়োজনীয় উপদান হিসেবে বেঁচে থাকে। যার প্রয়োজন সংসারের সর্বত্র, কিন্তু গুরুত্ব সংসারে নেই বললেই চলে। অনেক পুরুষই বলে, “মেয়ে তুমি এসবের জন্যই জন্ম নিয়েছ। এসবই তোমার প্রাপ্য। এসব মেনে নিতে পারলে থাকো, আর না পারলে দরজা তো খোলাই আছে, যেতে পারো।

আমাদের চারপাশে কত মানুষ আছে, যারা শুধু সংসার করার জন্যই নামেমাত্র একটা বিয়ে করে বউ নামক একটা স্থায়ী দাসী সমাজের বৈধ সার্টিফিকেটে বাসায় নিয়ে আসে। যে দাসীকে প্রহার করা যায়, নিজের মা-বোনের মিথ্যা অভিযোগে যার মনটা ছুরি-কাচি দিয়ে চাইলেই কুচিকুচি করে কাটা যায়, যাকে কথায় কথায় বুঝিয়ে দেয়া যায় যে সে ঘরের আশ্রিতা ছাড়া আর কেউ-ই না, যাকে খুন করে জানোয়ারের মতো ফ্যানের সাথে ঝুলিয়েও রাখা যায়। অথচ অনেক পুরুষই মনে রাখে না তার সারা জীবনের সঙ্গিনী হওয়ার জন্য একটা মানুষ তার চিরচেনা পরিবেশ, বাবা-মা, ছোট ভাই-বোনের নিষ্পাপ মুখগুলোর মায়া ছেড়ে, অজানা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন নিয়ে, একটা অপরিচিত মানুষের সাথে নিজের জীবনকে বেঁধে নেয়।

বেঁচে থাকুক সুপুরুষরা! বেঁচে থাকুক ভালবাসা।

Related Articles

Exit mobile version