জন্মের পরপরই একটি শিশু ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে শেখে না। ভাষা শেখার জন্য শিশুর মস্তিষ্ক তখন যথেষ্ট পরিপক্ক থাকে না। জন্মের প্রায় চার মাস পর্যন্ত একটি শিশুর ভাষা কান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ সময় তার ভাষা জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। চার মাস বয়স থেকে শিশু চিৎকার করে, কখনো ফিসফাস, কখনো হাত-পা ছুঁড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করতে চায়। যেমনটা প্রাপ্তবয়স্করা কথা বলার সময় অবাচনিক যোগাযোগ হিসেবে করে থাকে।
বাকপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়ার মাধ্যমে শিশু সাত মাসের মধ্যে প্রথম অক্ষরের মতো উচ্চারণ করতে শেখে। মোটর স্নায়ু তাকে এই নড়াচড়ায় সাহায্য করে, তবে তখনো পর্যন্ত তার অক্ষরজ্ঞান নেই। যেসকল শব্দ এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করা যায়, ৯ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে শিশু এই ধরনের শব্দগুলো উচ্চারণ করতে শেখে। যেমন- মা, বাবা, পাপা, দাদা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে স্বরধ্বনির চেয়ে ব্যাঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ সহজ বলে শিশুরা প্রথমে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করতে শেখে।
দশ মাস বয়স থেকেই একটি স্বাভাবিক শিশু বস্তু বা প্রাণীকে নির্দেশ করার মতো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এ সময় থেকে তার সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতি যেমন রাগ, অভিমা্ন, আনন্দ ইত্যাদির অভিপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করে।
একটি নির্দিষ্ট শব্দের মাধ্যমে সে একটি নির্দিষ্ট বস্তুকেই নির্দেশ করে থাকে। যেমন ‘টেডি বিয়ার’ বলতে সে একটি খেলনাকেই বোঝায় বা চেয়ার বলতে সে তার বাসার চেয়ারটিকেই বোঝায়। অন্য কোনো চেয়ারকে সে চেয়ার বলতে রাজি হয় না, বা বোতল বলতে সে কেবল কাঁচের বোতল এবং গ্লাস বলতে সে পানি খাওয়ার গ্লাসকেই নির্দেশ করে। কখনো আবার একটি শব্দ দিয়ে একাধিক বস্তুকে বোঝায়, যেমন সে মুখে উচ্চারণ করছে ‘কাক’ কিন্তু নির্দেশ করছে কোকিল বা ময়নাকে। আবার মুখে বলছে ‘কুকুর’ কিন্তু নির্দেশ করছে গরু, ছাগল ইত্যাদির দিকে। যেহেতু সবগুলো প্রাণীর অঙ্গসংগঠন একইরকম, তাই সে একটি শব্দকে প্রতিশব্দ হিসেবে অন্যান্য সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। আমাদের পরিবারের শিশুদের লক্ষ করলেই আমরা তাদের ভাষা শেখার এই ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়াগুলো খেয়াল করতে পারবো।
পর্যায়ক্রমিকভাবে বৃদ্ধি পায় শব্দভাণ্ডার
নিজের শব্দভাণ্ডার বাড়ানোর একটি অন্যতম উপায় হলো, আপনি যে শব্দটি নতুন শিখলেন তা ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। দুই থেকে তিনবার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে শব্দটি আপনার মাথায় গেঁথে যাবে এবং আপনি সেটা অনেকদিন পর্যন্ত মনে রাখতে পারবেন। অভিধানজ্ঞান বৃদ্ধির এই সহজ পদ্ধতিটি মানুষ শিখেছে শিশুর কাছ থেকে। একটি শিশু যখন থেকে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, তখন থেকেই সে নতুন শব্দকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। এই পদ্ধতি অনুসরন করেই সে নিজের শব্দভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে।
জন্মের ৯ মাস বয়স থেকে একটি শিশু তার শব্দভাণ্ডারে শব্দের মজুদ তৈরি শুরু করে। জন্মের পরবর্তী বিভিন্ন ধাপে শিশু কীভাবে শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে, তার উপর পৃথক দুটো গবেষণা করেন নেলসন (১৯৭৩) ও ফেনসন (১৯৯৩)। বয়সের বিভিন্ন ধাপে একটি শিশু কতটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে তার উপর মূলত গবেষণাটি হয়। নেলসন ১৭ জন শিশুর উপর এবং ফেনসন প্রায় ১৭৮৯ জন শিশুর উপর এই গবেষণা চালান।
গবেষণায় দেখা যায় ১৩ থেকে ১৫ মাস বয়সী শিশুরা গড়ে ১০টি করে শব্দ বলতে পারছে। আবার ১৭ থেকে ২০ মাস বয়সে ৫০টি শব্দ শিখতে পারে। ১৮৬ থেকে ৩১০টি শব্দ শিখতে পারে ২ বছর বয়সে। এ সময়ে সে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২টি করে শব্দ শেখে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর বতিক্রমও দেখা যায়। এ গবেষণায় মজার একটি তথ্য উঠে আসে। তা হলো, ১৩ মাস বয়সী একটি শিশু মুখে ১০টি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেও সে প্রায় ৫০টি শব্দের অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ শিশুরা যতটি শব্দ বুঝে কখনোই ততটি শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে পারে না।
শিশুর শব্দ বোঝা ও বলার সময়ের মধ্যে পার্থক্য হল প্রায় ৫ মাস। অর্থাৎ যা সে বুঝতে পারছে, সে শব্দগুলো বলতে তার ৫ মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমরা অনেক কথাই বলি যা শিশুরা বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না বা প্রকাশ করতে পারে না। তাই তাদের সামনে বাজে ভাষা ব্যবহারে সংযত থাকা উচিত।
জন্মের দ্বিতীয় বছরের মাথায় শিশু দু-তিনটি শব্দ জোড়া লাগিয়ে ভাব প্রকাশ করতে শেখে। কিন্তু ব্যাকরণের কোনো ব্যবহার সে তখনো করতে পারে না বিধায় বাক্য অসম্পূর্ণ থাকে যেমন, ‘দোকানে বল’ বা ‘ভাত না’ ইত্যাদি। বাক্য গঠনে পটিয়সী হয়ে উঠে আরও দুই থেকে ৬ মাস পর। যখন সে আমাদের মতোই ব্যাকরণ মেনে বাক্য বলতে শেখে। এসময় তার বাক্য গঠনে প্রায় অনেকটাই আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি, যোগ্যতা ইত্যাদি ফিরে আসে। বাক্যগুলোকে সে আর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ করে না এবং শব্দের উচ্চারণেও আসে পূর্ণতা। যেমন ‘সে যাই’ কে বলে ‘সে যায়’ কিংবা যেখানে ‘হ্যাঁ’ বলা দরকার সেখানে ‘না’ না বলে ‘হ্যাঁ’ বলা ইত্যাদি।
ব্যাকরণহীন কিন্তু মনের ভাব প্রকাশমূলক বাক্য গঠনে কখনো কখনো শিশুর আরো কম সময় লাগে। অনেক সময় ১৪ থেকে ১৮ মাস বয়সেই শিশু দুই তিন শব্দের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। যেখানে সাধারণত অন্যান্য শিশুর ২ বছর লেগে যায়। তবে এগুলো নির্ভর করে শিশুর ভাষা চর্চার উপর। যেসব বাবা-মা শিশুর সাথে কম কথা বলেন তাদের ভাষা শিখতে সাধারণত দেরি হয়। তবে দুই বছর বয়স পার হয়ে গেলেই শিশু তার মাতৃভাষার শৈলী মোটামুটি আয়ত্তে আনতে পারে এবং ব্যাকরণিকভাবে বাক্য গঠন করতে থাকে।
মুখস্থ করতে হয় না ব্যাকরণের নিয়ম
শিশুর ব্যাকরণ শেখার পদ্ধতিটি আমাদের ব্যাকরণ শেখার থেকে আলাদা। যেমন আমরা যখন ইংরেজি ব্যাকরণ শিখি, তখন আমাদের প্রায় সবকিছুই মুখস্থ করা লাগে। কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলার সময় আমরা সেই ব্যাকরণগুলো আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ু থেকে এনে এনে বাক্য গঠন করি না। কথা বলার সময় মূলত আমাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কথা বলি। ঠিক তেমনি শিশুও তার মাতৃভাষার ব্যকরণ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে আয়ত্ত করে। তাকে কখনো ব্যাকরণ মুখস্থ করতে হয় না। তাই কোনো বাঙালি শিশুকে অন্য কোনো ভাষার দেশে বড় করলে তার মানসিক ব্যাকরণ ও বাক্য গঠনের প্রবৃত্তি সে দেশের ব্যাকরণের মতোই গড়ে উঠবে।
শিশুর ভাষা শিখার এই পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি আমাদের ভিনদেশি ভাষাশিক্ষাকে অনেক সহজ করে ফেলেছে। কোনোরকম ব্যাকরণ না জেনেও আমরা কেবল পড়ে, শুনে আর লিখে লিখেই কোনো একটি ভাষা আয়ত্তে আনতে পারি খুব সহজেই। শিশুর মস্তিষ্ক আমাদের পরিপক্ক মস্তিষ্কের চেয়েও অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক পরিপক্কতার কারণে দ্রুত কাজ করতে পারে। আর ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সে ভাষার শব্দভাণ্ডার মজুদ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিশুর শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি ও মাতৃভাষার ব্যাকরণকে আয়ত্তে আনার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমরা খুব সহজেই বিদেশী ভাষায় পারদর্শী হতে পারি।
ফিচার ইমেজ: jugantor.com