আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা,
আলিফ লায়য়য়য়য়য়য়লা…
দেখো সব নতুন কাহিনী,
মন ভরে দেখার বাণী,
কত যুগ পেরিয়ে গেছে,
নতুন তবু রয়ে গেছে”
এই লাইনগুলো পড়ে সকলেই আশা করি ফিরে গেছেন সেই ছোটবেলার স্মৃতির ভাণ্ডারে, বিটিভির পর্দায়। আরব্য রজনীর আলিফ লায়লার কোনো এক পর্ব হয়ত এই মুহুর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এমন মানুষের জুড়ি মেলা ভার যে ছোটবেলায় আলিফ লায়লা দেখে নি। ছোটবেলায় আলিফ লায়লার এই জিঙ্গেলটা কানে আসলেই একটা অন্যরকম ফিলিংস আসত। প্রতি পর্বের ওই সময়টুকু যেন দু’চোখ টেলিভিশনের পর্দায় আটকে যেত। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিল যে ১ মিনিটের জন্যও যদি অন্য দিকে তাকাই, তাহলে বোধহয় বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করে ফেলব। আলিফ লায়লার বহু চরিত্রের মাঝে অনেক সময় নিজেকে বিশেষ কোনো চরিত্রে কল্পনা করতাম আমরা অনেকেই।
আলিফ লায়লা হলো আরব্য রজনীর গল্প।আরব্য রজনীর সকল গল্পই সম্রাট শাহরিয়ারকে তাঁর স্ত্রী শেহেরেযাদ কাহিনীগুলো শোনায়। রয়েছে ইতিহাস দ্বারা অণুপ্রাণিত গল্প, প্রেম কাহিনী, বিয়োগাত্মক কাহিনী, রম্যরচনা, কবিতা এবং প্রহসন। গল্পগুলোকে বিভিন্ন কাল্পনিক ও ঐতিহাসিক চরিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। হাজার বছর কেটে গেলেও এর কাহিনিগুলো পুরনো হয় নি। শিশুরা যখন পক্ষীরাজ ঘোড়া, বোতলে ভরা জীন, আর মন মাতানো সুন্দরী পরীদের অলীক কল্পনায় ডুবে যায় তখন তাদের মনে বীরত্ব, সততা ও অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসে।
আলিফ লায়লা সম্পর্কিত কিছু তথ্য
১) নির্মাতাঃ সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড
২) প্রস্তুতকারক দেশঃ ভারত
৩) অনুবাদিত ভাষাঃ হিন্দী, উর্দু, বাংলা
৪) মোট পর্বের সংখ্যাঃ ২৬০
৫) প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্যঃ প্রায় ২৩ মিনিট
৬) বাংলাদেশে প্রচারের সালঃ নব্বইয়ের দশক
৭) বাংলাদেশে প্রচারকারী চ্যানেলঃ বিটিভি
৮) গল্পসমূহঃ ১.১ বণিক এবং দৈত্য, ১.২ বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং কালো কুকুর, ১.৩ বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং ছাগল, ১.৪ জেলে এবং দৈত্য – হাকিম ডুবান, ১.৫ আলাদিন এবং বিস্ময়কর চেরাগ, ১.৬ আলী বাবা এবং চল্লিশ চোর, ১.৭ নাবিক সিনবাদের সাতটি সমুদ্রযাত্রা, ১.৮ রাজকুমার জালাল তালিব এবং তিন মুক্তো, ১.৯ বাগদাদের খলিফা হারুন আল রশিদের রাত্রিকালীন রোমাঞ্চ সফর, ১.১০ তিন কালান্দার, বাদশাহের পুত্রগণ ও বাগদাদের মহিলাদের গল্প, ১.১১ অন্ধ বাবা আবদাল্লাহ জামান ও সাহারাই দরবেশের গল্প, ১.১২ জিশান ও সোফান ইজবার গল্প, ১.১৩ দুই ভাইয়ের গল্পঃ জালাল বেলাল, ১.১৪ তিন কালান্দার, ১.১৫ রাজকুমার আফাত ও ফিরোজা বনাম ফিরোজ বক্স ও ১.১৬ সিনবাদ (৪ খুলি অভিযান)
স্মৃতিচারণ
ছোটবেলায় আলিফ লায়লার কিছু কিছু পর্ব দেখে বেশ ভয় পেতাম। যেমন- সোফানিজবা যখন মানুষ রূপ থেকে রাক্ষস রূপ ধারণ করে মানুষের রক্ত খেত, এই দৃশ্যটা আমার কাছে খুব ভয়ের লাগত। সোফানিজবা মানুষ রূপ থেকে রাক্ষস রূপ ধারণ করতে করতেই আমি হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলতাম, কিন্তু কী হচ্ছে দেখার লোভও সামলাতে পারতাম না। তাই চোখ ঢাকা অবস্থায়ই হাতের আঙ্গুল কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে দেখার চেষ্টা করতাম মাঝে মাঝে। আরো একজনকে ভয় পেতাম, সে হচ্ছে ডাকু কেহেরমান। ডাকু কেহেরমানের হাসিটা কানে আসতেই আমার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যেত ভয়ে। এক্ষেত্রে ভয় থেকে বাঁচার জন্য দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরতাম আর চোখ দিয়ে দেখতাম। আলিফ লায়লা দেখে মাঝে মাঝে এতটাই ভয় পেতাম যে রাতের বেলা পাশের ঘরে যেতেও কেমন যেন লাগত। এমনকি রাতের বেলা ওয়াশরুমে যাওয়া থেকেও পারতপক্ষে বিরত থাকতাম। এত ভয় পাওয়ার পরও আলিফ লায়লার পরবর্তী পর্ব দেখার আগ্রহটা বিন্দুমাত্র কমত না, বরং বেড়ে যেত।
সেই সময় আলিফ লায়লার বিভিন্ন পর্বের ছবি সম্বলিত খাতা পাওয়া যেত এবং স্কুলগামী ছোট ছেলেমেয়ে মাত্রই এমন একটি খাতা থাকতেই হবে। এছাড়াও মালিকা হামিরার আকরামের মত দেখতে প্লাস্টিক আকরাম পাওয়া যেত বিভিন্ন দোকানে। আর এটা একটা নিজের কাছে থাকা মানে, সহপাঠীদের কাছে আমি একটু বিশেষ আদরণীয়!
আলিফ লায়লা জিংগেল
অডিও ট্র্যাক: youtube.com/watch?v=RcETZPQhZDU
আলিফ লায়লার কিছু চরিত্র
আসুন পরিচিত হই আলিফ লায়লার সেই পরিচিত কিছু মুখের সাথে, যারা আলিফ লায়লা মাত্রই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সিন্দবাদ
সিন্দবাদ আল্লাহর একজন সৎ বান্দা এবং পরোপকারী ব্যক্তি । তিনি বাগদাদের একজন বিখ্যাত সওদাগ। জীবন বাজি রেখে তিনি মানুষের উপকার করেছেন। সাতবার সমুদ্রযাত্রায় গিয়েছেন এবং অচেনা সাগরের বুকে ভেসে বেড়িয়েছেন। কখনো তার জাহাজ ভেঙেছে ভয়ঙ্কর ঝড়ে, কখনো গিয়ে পড়েছেন একচোখা দৈত্যের কবলে। কখনো দ্বীপ ভেবে ভুল করে পা রেখেছেন বিশাল তিমির পিঠে, কখনো লড়াই করেছেন রক-পাখির বিরুদ্ধে।সাহস, দৃঢ়তা, সততা এবং আল্লাহর প্রতি অসীম বিশ্বাসের কারণে তিনি প্রতিটি বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছেন এবং অসংখ্য মানুষকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, হয়ে উঠেছিলেন জগৎজোড়া খ্যাতিমান এবং দয়ার সাগর হিসেবে।
ভিডিওঃ youtube.com/watch?v=7pfTx0y2OaY
আলাদিন
আলাদিন এক দরিদ্র গায়ের এক দরিদ্র বালক ছিল। আলাদিন আর তার মা একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকত। কিন্তু সে সবসময় স্বপ্ন দেখত যে সে একদিন অনেক ধনী হবে আর তার মাকে একটি বিশাল বাড়ি কিনে দিবে। একদিন দূরদেশ থেকে এক দুষ্ট জাদুকর এলো গ্রামে এবং নিজেকে আলাদিনের চাচা হিসেবে পরিচয় দিল আলাদিনের কাছে। দুষ্ট জাদুকর এসেছিল একটি আশ্চর্য জাদু প্রদীপের খোঁজে এবং আলাদিনকে তার দরকার ছিল একটি গুহা থেকে সেই আশ্চর্য প্রদীপটি সংগ্রহ করার জন্য। সেই গুহায় এর আগে যে-ই, নেমেছে সেই প্রাণ হারিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই সে আলাদিনের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই দুষ্ট জাদুকর আশ্চর্য জাদু প্রদীপটিকে হাসিল করতে পারে না। আর এদিকে সেই আশচর্য প্রদীপ আর তার মধ্যে থাকা জীনের সহায়তায় আলাদিন আর তার মা অনেক সুখে শান্তিতে থাকতে লাগল।
ভিডিওঃ youtube.com/watch?v=MclMhyxs1aY
দস্যু কেহেরমান
একহাত কাটা আর এক চোখে কালো পট্টি বাঁধা দস্যু কেহেরমানের কথা আমাদের সকলেরই মনে আছে। অসৎ এক জলদস্যুর, সৎ ব্যক্তি সিন্দবাদের হাতে পরাজয় ও পরিণতির কাহিনীটি আসুন আমরা দেখে নেই নিম্নোক্ত ভিডিওটি থেকে।
ভিডিওঃ youtube.com/watch?v=UCPQVdL4BOo
সোফানিজবা ও মালিকা হামিরা
মানুষের বেশধারী রাক্ষুসী সোফানিজবার মানুষ থেকে রাক্ষসে রূপান্তরিত হয়ে রক্তপান, মালিকা হামিরার বিচ্ছুরূপী আকরাম এর মাধ্যমে জাদু প্রয়োগ এসবই আলিফ লায়লা মাত্র আমাদের দৃশ্যপটে ভাসমান।
আলিফ লায়লা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
প্রচন্ড বিপদের মাঝে মানুষকে কিভাবে বেঁচে থাকতে হবে, যেকোনো সমস্যার মোকাবিলা কিরকম সাহস ও সততার সাথে করা উচিত, অভিভাবকদের প্রতি মানুষের কি দায়িত্ব ও কর্তব্য, স্ত্রী, সন্তান,বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য মানুষদের কিভাবে ভালবাসতে হয়, সত্য ও সততাকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়- শিক্ষাগুলো আমরা আলিফ লায়লার গল্পগুলো থেকে পেয়ে থাকি।
আলিফ লায়লার মোহে আটকানো সেই দিনগুলোর কথা আসলেই ভোলা সম্ভব না।
তথ্যসূত্র