আজকাল টিভি বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধু শব্দটিকে মহিমান্বিত করতে করতে একেবারে ভিন্ন এক মাত্রায় নিয়ে গেছে, যা অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে নিতান্তই অজানা-অচেনা কোনো ব্যক্তিকে তথাকথিত বন্ধু বানিয়ে ফেলা সম্ভব বলে, বন্ধু শব্দটি অনেকাংশেই তার চিরাচরিত আবেদন হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু পারিপার্শ্বিক প্রভাবকসমূহের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, একদম নির্মোহভাবে যদি আমরা চিন্তা করে দেখি, তাহলে কিন্তু প্রমাণ পেয়ে যাব, সত্যিই বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্ভব।
মানুষ হিসেবে যেকোনো খুশির সংবাদ, কিংবা যেকোনো দুঃখবোধ, সবকিছুই আমরা চাই কোনো একজন বিশেষ মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে। এবং সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই একজন বন্ধু হয়ে থাকে আমাদের প্রথম পছন্দ। কেননা বন্ধুই হলো সেই ব্যক্তি, যে আমাদেরকে চেনে, জানে, বোঝে এবং অনুভব করে।
একজন বন্ধুর সংস্পর্শে আমরা যে মানসিক নৈকট্য লাভ করতে পারি, তা আর কারও সাথেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোনের মতো রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের সাথে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়, তখনো আমাদের শেষ আশ্রয় হিসেবে রয়ে যায় বন্ধুরাই।
কথিত রয়েছে, সে-ই সত্যিকারের ভাগ্যবান মানুষ, যার একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধু আছে। কিন্তু ভালো বন্ধু পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষত, ভালো বন্ধু পেতে চাইলে, আগে আমাদের নিজেদেরও বন্ধু হিসেবে ভালো হওয়া প্রয়োজন। আমরা নিজেরাই যদি অন্যের বন্ধু হিসেবে খুব ভালো না হই, তাহলে আমাদের ভাগ্যেও কীভাবে ভালো বন্ধু জুটবে, বলুন!
এখন প্রশ্ন হলো, একজন ভালো বন্ধু হওয়ার উপায় কী? এ ব্যাপারে অসাধারণ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছেন প্রাচীন রোমের দার্শনিক মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো। তার লেখা “ডি অ্যামিসিডিয়া” (ইংরেজিতে How to Be a Friend) বইটিকে অনেকেই মনে করে থাকে বন্ধুত্ব বিষয়ক সর্বকালের সেরা বই হিসেবে।
ক্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে, ষাটোর্ধ্ব বয়সে রোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও বাগ্মী হিসেবে বিবেচিত সিসেরো যখন জুলিয়াস সিজার কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হন, তখন মনের জ্বালা মেটাতে কলম ধরেন তিনি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বিবিধ বিষয়ে দারুণ সব রচনা সম্পন্ন করে ফেলেন। এর মধ্যে একটি ছিল বন্ধুত্ব বিষয়ক, যেখানে উঠে এসেছিল প্রিয়তম বন্ধু অ্যাটিকাসের (টাইটাস পম্পোনিয়াস) সাথে তার সম্পর্কের খুঁটিনাটি।
তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ রোমানই বন্ধুত্ব বলতে বুঝে থাকত ব্যবহারিক একধরনের সম্পর্ক, যা গড়ে ওঠে পারস্পরিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। অর্থাৎ স্বার্থই ছিল বন্ধুত্বের মূল কাঠামো। এমন বন্ধুত্বের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতেন না সিসেরো। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, মামুলি সব জাগতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠেও বন্ধুত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের ছোট্ট বইটিতে তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য স্মরণীয় বেশ কিছু নীতি। সেগুলোর মধ্য থেকে সেরা দশটি এখানে তুলে ধরা হলো।
বিভিন্ন ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে: সিসেরো স্বীকার করেন যে আমাদের জীবনে অসংখ্য ভালো মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাদেরকে আমরা বন্ধু বলে মনে করি। এদের মধ্যে রয়েছে আমাদের ব্যবসায়িক সহযোগী, প্রতিবেশী, কিংবা যেকোনো ধরনের পরিচিত ব্যক্তি। তবে তিনি এসব সাধারণ বন্ধুত্বের থেকে সেসব বন্ধুকে আলাদা করেছিলেন, যাদের সাথে সরাসরি আমাদের আত্মার যোগাযোগ হয়, এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক গভীরে পৌঁছায়। এমন বন্ধুত্ব খুবই বিরল, কেননা এর জন্য আমাদের প্রচুর সময় ও নিজ সত্তাকে ব্যয় করতে হয়। অবশ্য এমন বন্ধুরাই আমাদের জীবনকে বদলে দেয়, ঠিক যেভাবে আমরা বদলে দিই তাদের জীবন।
কেবল ভালো মানুষেরাই সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে: মন্দ নৈতিক চরিত্রের অধিকারীদেরও বন্ধু থাকে বটে, কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব কেবল উপযোগের উপর নির্ভর করে। কারণ, সত্যিকারের বন্ধুত্বের জন্য চাই বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও প্রাথমিক মানবিকতা। জালেম ও দুশ্চরিত্ররা হয়তো বন্ধু হয়ে একে অপরকে ব্যবহার করে, ঠিক যেভাবে তারা ভালো মানুষকেও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। কিন্তু খারাপ মানুষদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না জীবনে সত্যিকারের বন্ধুত্ব খুঁজে পাওয়া।
আমাদের উচিত বন্ধু নির্বাচনে যত্নশীল হওয়া: বলা হয়ে থাকে, বন্ধুত্ব বলে-কয়ে হয় না। নিজে থেকেই জন্ম হয় বন্ধুত্বের। তবে কখনো কখনো আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। বন্ধুত্ব জমে ওঠার আগেই সম্ভাব্য বন্ধুকে আমাদের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তাকে বন্ধু বানানো যায় কি না সে ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। কারণ একবার যদি কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, এবং তারপর তার সাথে মনের মিল না হয়, সেক্ষেত্রে জীবন খুবই অগোছালো ও গোলমেলে হয়ে পড়তে পারে। তাই শুরুতেই তাড়াহুড়া না করে, বন্ধুত্ব তৈরিতে যত্নশীল হতে হবে, দেখেশুনে পা বাড়াতে হবে।
বন্ধুত্বের পুরস্কার বন্ধুত্ব নিজেই: সিসেরো এ কথা মানেন যে বন্ধুত্বের ফলে কিছু ব্যবহারিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় — উপদেশ, সঙ্গ, কঠিন সময়ে সমর্থন — কিন্তু দিনশেষে বন্ধুত্ব কোনো ব্যবসা নয় যেখানে লাভ-ক্ষতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কষা হবে। বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বন্ধুত্ব নিজেই।
বন্ধুরাই আমাদেরকে শ্রেয়তর মানুষে পরিণত করে: আমরা কেউই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারি না। আমাদের দরকার একজন সঙ্গীর। এবং সেই সঙ্গীর মাঝে আমরা এখন বন্ধুর খোঁজ করি। বন্ধুরা হলো অনেকটা আয়নার মতো। তাদের চোখে আমরা নিজেদেরকে দেখতে পারি। তারা আমাদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। আমাদের ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করে, মন্দ দিকগুলোকে চিহ্নিত করে। এভাবে আমরা নিজেদের উন্নতিসাধন করতে পারি। কিন্তু বন্ধুহীন হয়ে পড়া মানে নিজের সত্তাকেও হারিয়ে ফেলা।
নতুন বন্ধু বানালেও পুরনোদের ছাড়া যাবে না: সেই বন্ধুরাই তো আমাদেরকে সবচেয়ে ভালো জানে ও বোঝে, যাদের সাথে আমাদের সবচেয়ে বেশিদিনের পরিচয়। বিশেষত যাদের সাথে আমরা সেই শৈশবকাল থেকে সময় কাটিয়ে এসেছি, বন্ধু হিসেবে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। নতুন বন্ধুরা হয়তো আমাদের এমন অনেক বিষয় আছে যা জানে না। কিন্তু শৈশবের বন্ধুদের কাছে কোনো কিছুই অজানা নয়। তাই তাদের পক্ষে আমাদেরকে বোঝা অপেক্ষাকৃত সহজ। সুতরাং, নতুন কোনো ভালো বন্ধুর সন্ধান পেলেও, অকারণে পুরনো বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছেদ করা অনুচিত।
বন্ধুরা সবসময় পরস্পরের প্রতি সৎ থাকে: সততা হলো বন্ধুত্বের অন্যতম প্রধান ভিত। একজন প্রকৃত বন্ধু সবসময়ই আমাদেরকে সেসব কথা বলবে, যেগুলো আমাদের শোনা দরকার। এবং তারা আমাদেরকে এমন কোনো কথা বলবে না, যা আসলে মিথ্যা অথচ শুনে আমরা খুশি হবো। আমাদের চারপাশে এমন অজস্র ব্যক্তি আছে যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে নানাভাবে খুশি করার চেষ্টা করে। একমাত্র প্রকৃত বন্ধুরাই আমরা রাগ করব বা কষ্ট পাব জেনেও সত্য কথা কখনো আমাদের থেকে গোপন করে না। এখানে একজন প্রকৃত বন্ধুর সাথে একজন শত্রুর বেশ মিল। তাই আমরা অনেকসময় ভুলবশত প্রকৃত বন্ধুকে শত্রু ভেবে বসতে পারি। কিন্তু আমাদের করণীয় হলো, যাকে বন্ধু বলে মানি, তার যেকোনো কথাতেই রাগান্বিত না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় সে কী বলতে চায় তা শোনা ও ভাবা।
এক বন্ধু কখনোই অন্য বন্ধুকে ভুল কিছু করতে বলে না: এক বন্ধু অপর বন্ধুর জন্য অন্য যেকোনো কিছু হারাবার ঝুঁকি নিতে পারে, শুধু সম্মান ছাড়া। যদি কখনো কোনো বন্ধু আমাদেরকে মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে বা অন্য যেকোনো লজ্জাজনক কাজ করতে বলে, তখন সেই বন্ধুটির ব্যাপারে পুনরায় ভেবে দেখা আবশ্যক। হয়তো বন্ধুটি আসলে তেমন নয়, যেমনটা আমরা শুরুতে ভেবেছিলাম। বন্ধুত্বের সূচনাই হয় ভালোর মাধ্যমে। কিন্তু সেই ভালোর মাঝে যখন খারাপ কিছুর প্রবেশ ঘটে, তখন বন্ধুত্বের আদিমতম ভিতটাই নড়ে যায়।
সময়ের সাথে বন্ধুত্বের চরিত্র বদলায়: জগতে কোনো কিছুই অপরিবর্তনশীল নয়। ব্যতিক্রম নয় বন্ধুত্বও। সময় আমাদের সবাইকে ধীরে ধীরে পাল্টে দেয়। দশ বছর আগে আমরা যেমন ছিলাম, এখন অবশ্যই আমরা আর তেমন নেই। তাই বন্ধুত্বও যে কালের প্রবাহ ও সকল ঝড়-ঝাপ্টা সামলে একই রকম থাকবে, তেমনটি আশা করা অনর্থক। তবে এ কথা সত্য যে, বন্ধুত্বের চরিত্র বদলে গেলেও, একদম ভেতরের বীজটা সেই শুরুর মতোই থাকে। সকল প্রতিবন্ধকতা পার করে এসেও যে বন্ধুত্ব টিকে থাকে, সেটিই তো প্রকৃত বন্ধুত্ব।
বন্ধু ছাড়া জীবন অর্থহীন: কিংবা সরাসরি সিসেরোর ভাষাতেই বলা যায়,
“মনে করো, ঈশ্বর তোমাকে খুব দূরের এমন একটি স্থানে নিয়ে গেলেন, যেখানে তোমার জাগতিক সকল চাহিদাই পূরণ করা হবে, শুধু কেড়ে নেয়া হবে আর কোনোদিন কোনো মানুষের সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা। এমন একটি জীবন যাপন করে টিকে থাকতে হলে কি তোমাকে ইস্পাতের মতো দৃঢ় হতে হবে না? একাকী থাকতে গিয়ে তুমি কি জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই হারিয়ে ফেলবে না?”
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/