আমাদের চারপাশের পৃথিবী ভয় এবং উদ্বেগে পরিপূর্ণ। টেলিভিশন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজনীতির আলোচনা- সব যেন আমাদের জন্য ভীতির বার্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী দেখতে কিংবা চালচলনে একটু অদ্ভুত হলে তাকে নিয়ে মনে আসে নানা দুশ্চিন্তা, আছে অশরীরী কোনো কিছুর প্রতি ভয়। সবচেয়ে বেশি যে ভয়টি আমাদের জেঁকে ধরে তা হলো জীবনযুদ্ধে ব্যর্থতার ভয়। ভয়ের বিষয় যা-ই হোক না কেন, মোট কথা হলো, অমূলক ভয়ভীতি আমাদের আমাদের শরীর এবং মনের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে,
ভয় হচ্ছে কুসংস্কারের জনক, কুসংস্কারের সাথে জন্ম নেয় নিষ্ঠুরতা। যদি আপনি ভয়কে জয় করতে পারেন তবেই আপনি এগোতে পারবেন প্রজ্ঞার পথে।
তাই জেনে নেওয়া দরকার ভয়ের আদ্যোপান্ত, অর্থাৎ কেন মানুষ ভয় পায়, ভয় পেলে মানবশরীর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং ভয়কে জয় করার উপায়।
প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার ভয়ের উৎস কোথায়। মনে হতে পারে উদ্বেগ বা ভয় এই অনুভূতিগুলো আপনাআপনি কোনো পূর্বাভাস ছাড়া প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু যেটা বুঝতে হবে তা হচ্ছে- ‘Emotions always follow perception‘ অর্থাৎ আপনার যেকোনো অনুভূতি সবসময় পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। আপনার পাঁচটি প্রধান ইন্দ্রিয়- দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ, স্পর্শ এবং গন্ধ- আপনার আশেপাশের পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন রাসায়নিক ও স্নায়বিক সংকেত বা সিগনালগুলোকে বৈদ্যুতিক সিগনালে পরিণত করে। এই বৈদ্যুতিক সিগনাল পরবর্তীতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলকে সক্রিয় করে এবং পাশাপাশি এই বিশেষ অঞ্চলে সিগনালগুলো সংরক্ষিত থাকে। তাই অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ভীতিকর ঘটনা ও তার প্রভাব ঐ সময়ে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন- পরবর্তীতে অনুরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে আপনি ভীত হয়ে পড়েন। এজন্য হয়তো আপনার দুই বছর বয়সে গায়ের উপর দিয়ে মাকড়শা হেঁটে যাওয়ায় আপনি যে ভয় পেয়েছিলেন, এখনও দূর থেকে মাকড়শা দেখলে আপনার ত্বকে সুড়সুড়ি অনুভব করেন এবং নিজের অজান্তেই ভীত হয়ে ওঠেন। কারণ আপনার মস্তিস্ক এখনও অতীতে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর স্মৃতিটি সংরক্ষণ করে রেখেছে।
ভয়ের উৎস যখন জানা গেল, এখন জানা দরকার ভয় পেলে আপনার মস্তিস্ক কীভাবে কাজ করে। ভয় পেলে আপনার মস্তিষ্কে একধরনের চেইন রিঅ্যাকশন বা বিক্রিয়া শুরু হয়। এই বিক্রিয়া শুরু হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে এমন কোনো অনুভূতি বা উদ্দীপনার উপস্থিতি যা আপনার মাঝে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সাথে সাথে বিক্রিয়া শুরু হয় মস্তিষ্কে। মানব মস্তিষ্কের পাঁচটি অংশ এই বিক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। শুরুতেই আপনার শরীরের ইন্দ্রিয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য পৌঁছে যায় থ্যালামাসে। থ্যালামাস থেকে এখন বিক্রিয়াটি দুটি আলাদা পথে যেতে পারে (রসায়নের ভাষায় Path of Reaction)- একটি পথ ঊর্ধ্বগামী এবং অপরটি নিম্নগামী। বিক্রিয়াটি কোন পথ ধরে এগোবে তা নির্ভর করে আপনি বর্তমানে যে পরিবেশে আছেন তার তীব্রতা ও প্রভাবের উপর।
নিম্নগামী পথ ধরে বিক্রিয়াটি তখনই এগোবে যখন কোনো পরিস্থিতি আপনার জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ, যেমন কেউ আপনার গলায় ছুরি ধরে রেখেছে। এরকম জরুরী অবস্থায় আপনার দরকার দ্রুত তথ্য মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া, তাই বিক্রিয়াটি এই পথ ধরে এগোবে, কারণ এই পথটি দ্রুততম যদিও সবচেয়ে কম যুক্তি মেনে চলে। থ্যালামাস থেকে এখন তথ্য যাবে অ্যামিগডালায় এবং এই অংশের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে আপনি যে পরিবেশে আছেন সে পরিবেশটি আপনার জন্য কতখানি বিপদজনক তা নিখুঁতভাবে নিরীক্ষণ করা।
অ্যামিগডালা উদ্ভূত পরিস্থিতির পাশাপাশি থ্যালামাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিচার করে এবং শরীরের অন্যান্য অঞ্চলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সিগনাল পাঠায়। হাইপোথ্যালামাস সাথে সাথে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে জাগিয়ে তোলে এবং আপনার হৃদপিণ্ড আরো অক্সিজেন পেতে দ্রুত পাম্পিং শুরু করে। আপনার চোখের পিউপিল প্রসারিত হয় যাতে আপনি আরো ভাল দেখতে পান এবং পেশীতে রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে আপনাকে বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করে, আপনার ইন্দ্রিয়কে প্রায় অতিমানবীয় পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং আপনার মাঝে Flight or Fight Response ট্রিগার তৈরি করে আর আপনাকে বার্তা পাঠায়- প্রস্তুত হও!
কিন্তু পরিস্থিতি যদি এতটা গুরুতর না হয়, তখন বিক্রিয়াটি ঊর্ধ্বগামী পথটি বেছে নেয় যা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম। যেমন, অনেকে তেলাপোকা ভয় পান। হঠাৎ দেখলেন তেলাপোকা মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটা বিপদজনক না হলেও আপনার জন্য ভীতিকর। তখন অ্যামিগডালা সিগনাল পাঠায় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে। এই কর্টেক্স থেকে সিগনাল যায় হিপোক্যাম্পাসে যা আপনার মস্তিষ্কের তথ্যকেন্দ্র এবং হিপোক্যাম্পাস তখন বর্তমান ও অতীতের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজে এবং জমা থাকা স্মৃতিগুলো স্ক্যান করে আপনাকে জানিয়ে দেয় এমন ঘটনা আপনার সাথে আগেও ঘটেছিল কিনা। যেহেতু এই পথটি যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম তাই আপনাকে জানিয়ে দেয় এই পরিবেশ আপনার জন্য জীবননাশী নয় এবং ধীরে ধীরে আপনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে। ভাবতেও অবাক লাগে যে, মানব মস্তিষ্ক এতগুলো কাজ সেকেন্ডের চেয়েও কম সময় করতে পারে!
এসব শারীরিক পরিবর্তনগুলো আপনার কাছে হয়তো বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু এই সামগ্রিক প্রক্রিয়া সবকিছুর পিছনে যে হরমোনটি দায়ী তার নাম অ্যাড্রেনালিন। এই হরমোনটি আপনার হার্টবিট ও রক্তচাপ বাড়ায়, ফুসফুস অক্সিজেনে পূর্ণ করে পেশীতে রক্ত পাঠায় আর চোখের পিউপিল প্রসারিত করে এবং আপনার শরীরকে flight or fight এর জন্য প্রস্তুত করে।
এই ইমার্জেন্সি রেসপন্স সিস্টেম অবশ্যই উপকারী, কিন্তু সবসময় এই সিস্টেম যে আপনার জন্য হিতকর হবে তা কিন্তু নয়। ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার এক গবেষণায় বলা হয়েছে-
ধরুন, আপনি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। আপনার মস্তিষ্ক এখন অ্যামিগডালা থেকে প্রাপ্ত সিগনালগুলো প্রবাহিত হওয়ার জন্য পথ গঠন করবে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম রাস্তাগুলোকে শর্ট সার্কিট করে দিবে। এরকম ওভারএক্টিভ পর্যায়ে আশেপাশের যত তথ্য- ছবি, শব্দ, গন্ধ, আবহাওয়া, স্পর্শ- সবকিছুকেই নেতিবাচক স্মৃতি হিসেবে মস্তিষ্কের তথ্যকেন্দ্রে জমা রাখবে। তাই ভবিষ্যতে যেকোনো একটি নেতিবাচক অনুভূতির সামান্যতম উপস্থিতি আপনাকে কাবু করে ফেলবে। হয়তো এমন কোনো জায়গায় আছেন যেখানে আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, তারপরও আপনি ভীত হয়ে পড়বেন এবং নিজেও বুঝবেন না কেন এমনটা হচ্ছে।
এই সমস্যাটি যাদের PTSD (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) আছে তাদের জন্য মারাত্মক। কিন্তু একবার এটাও ভেবে দেখা দরকার যে, এই সাড়া দেওয়ার সিস্টেম না থাকলে কি হতো? আমাদের পূর্বপুরুষরা তখন কোনো বন্যপ্রাণী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হলে দৌড়ে না পালিয়ে হয়ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। তাতে যা হতো আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগেই মানব জাতি বিলুপ্ত হয়ে যেত! তবে আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানব মস্তিষ্ক কিন্তু কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তাই হয়তো কোনো ভয়ের সিনেমা দেখছেন এবং মস্তিষ্ক ঘটনাটি বাস্তব নাকি কল্পকাহিনী তা না বুঝেই কাজ করা শুরু করে দিচ্ছে।
গুরুতর পরিস্থিতিতে ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি অহেতুক ভয়ভীতি ঝেড়ে ফেলতে চান তাহলে এই উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন-
- কোন বিষয়ে ভয় পান সে ব্যাপারে সচেতন হন। যেমন- জনসম্মুখে কথা বলতে বা প্রেজেন্টেশন দিতে ভয় পান। আগে ভয়ের জায়গাটি চিহ্নিত করুন এবং কাগজে লিখে ফেলুন।
- বিশ্বাস করতে পারেন এমন কারো সাথে ভয় পাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কথা বলুন। দেখবেন যত ভয়ের ব্যাপারটি নিয়ে মজা করতে পারছেন তত ভয় কমে যাচ্ছে। বেশি গুরুতর সমস্যা হলে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে পারেন।
- এতদিন তো অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছেন। এখন দরকার মস্তিস্কে নতুন ইতিবাচক তথ্য পাঠানো। তাই প্রতিদিন নিজেই নিজেকে ইতিবাচক কথা বলুন বা অটোসাজেশন দিন।
- ভয়ের ব্যাপার নিয়ে বই বা কোনো আর্টিকেল পড়ুন। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার মতো আরো অনেকে একই ব্যাপারে ভয় পায় এবং ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক।
- যখনই ভয় পাচ্ছেন চোখ বন্ধ করুন এবং নিজের জন্য একটি শান্ত ও নিরাপদ জায়গা কল্পনা করুন। যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আরামবোধ করবেন চোখ বন্ধ রেখে নিজের মাঝে ইতিবাচক অনুভূতি সঞ্চালন করুন।
অবশেষে ভয়কে জয় করার জন্য নিজেই নিজেকে পুরস্কৃত করুন। পুরস্কার যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, দেখবেন ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে আপনিও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন।