‘ইন্ট্রোভার্ট’ বা ‘অন্তর্মুখী’ শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই শব্দটি আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকি। ইন্ট্রোভার্টের সাথে আরেকটি শব্দ আমরা সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করি, আর তা হলো ‘লাজুক’। মূলত ইন্ট্রোভার্ট হলেই যে লাজুক হতে হবে তার কোনো মানে নেই। ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি নিজের মধ্যে নিজে চিন্তা করতে ভালবাসে। বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে ভাবতে ভালবাসে। গল্প আড্ডায় সময় না কাটিয়ে বই পড়া, লেখালেখি, আঁকাআঁকি বা এই ধরনের সৃষ্টিশীল কাজে ব্যস্ত থাকতে তুলনামূলকভাবে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে।
বাসায় অতিথি এসেছে। রাতুল মায়ের সাথে গল্প করছিল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই দৌড়ে চলে গেল রুমে, আর দরজা দিল বন্ধ করে। আব্বু আম্মু ডাকল একবার, কিন্তু রাতুল তাতে খুব একটা সাড়া দিল বলে মনে হলো না। আসলে বাইরের লোকের সাথে খুব একটা দেখা করতে চায় না রাতুল। এক ধরনের লজ্জা লজ্জা ভাব হয়। কেন যেন সহজ হতে পারে না সে। কাউকে বলেও বোঝাতে পারে না। মা বাবাও খুব একটা ঘাটায় না। এতেই রাতুল খুশি। নাই বা হলো একটা নতুন লোকের সাথে পরিচয়, নাই বা হলো একটু বাড়তি কথা বলা। নিজের মাঝেই আছি, বেশ তো আছি। এমন ভাবাটা প্রতিনিয়ত রাতুলের মনে চলতে থাকে। মা বাবা খেয়ালের ভুলে বলেই বসে, ছেলে খুব ‘ইন্ট্রোভার্ট’।
অবাক করা বিষয় হলো, রাতুলের মতো আমাদের পঁচিশ থেকে চল্লিশভাগ মানুষই ইন্ট্রোভার্ট। তবে প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ যাদের আমরা ‘গিফটেড পারসন’ বলে থাকি তাদের ৬০ ভাগই ইন্ট্রোভার্ট হয়ে থাকেন। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা হলো ইন্ট্রোভার্ট মানুষজন জীবনে উন্নতি করতে পারে না। কিন্তু শুনলে অবাক হতে হয় পৃথিবীর অনেক বড় বড় খ্যাতিনামা লোক আপাতপক্ষে ছিলেন ইন্ট্রোভার্ট। কেউ যদি ইন্ট্রোভার্ট হয়েও থাকেন তাহলে এই বিখ্যাত লোকদের জীবনী জোগাবে নতুন উৎসাহের পাথেয়।
নিজে ইন্ট্রোভার্ট কিনা সেটা বোঝার জন্য দরকার আগে নিজেকে জানা। নিজের গুণ এবং দোষগুলো খুঁজে বের করা। নিজেকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করা এবং তার উত্তর খুঁজে বের করা। কেউ যদি অনেক মানুষের সাথে সময় কাটাবার পর নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে করেন, অফিসে সবার সাথে কথা বলা কিংবা অনেকে মিলে কোথাও বেড়ানোর পর অথবা সবাই মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর যদি কেউ হাঁপিয়ে ওঠেন বা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তবে সম্ভবত তাকে ইন্ট্রোভার্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।
ইন্ট্রোভার্ট হবার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সামাজিক ব্যাপারগুলোতে তারা নিজেকে অনেক বেশি বেমানান ভাবতে পারে, যেখানে অন্যরা বরং এসব উপভোগ করে। তবে এসবের বিপরীতও মাঝে মাঝে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে ইন্ট্রোভার্ট কিন্তু অসামাজিক নয়। সমাজের মধ্যে থেকে নানান আচার অনুষ্ঠান বা সম্পর্ক বজায় রাখতে তারা বেশ আমায়িকভাবেই মিশতে পারে। কিন্তু বিকালবেলা বা অবসরে আড্ডা দেবার চেয়ে বা বন্ধুরা মিলে কোথাও ঘুরতে যাবার চেয়ে কেউ যদি একা একটু বই পড়া, নিজের শখের কাজ গুলো করা, গান শোনা বা টিভি দেখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তবে তিনি সম্ভবত ইন্ট্রোভার্ট। ইন্ট্রোভার্টদের অন্যরা রিজার্ভড, চুপচাপ এমনকি ভুল করে অনেক সময়ই লাজুক বলে থাকে। আসল ব্যাপার হলো, ইন্ট্রোভার্টরা কথা বলার আগে সেটা ভালোমতো ভেবে দেখে, তাই রেসপন্স করতে একটু সময় নেয়। তাছাড়া অধিকাংশ ইন্ট্রোভার্ট অযথা কথা বলতে পছন্দ করে না।
জে. কে. রাওলিং-কে কম বেশি আমরা সবাই চিনি। জনপ্রিয় চরিত্র ‘হ্যারি পটার’-এর উদ্ভাবক এই জে. কে. রাওলিং ব্যক্তিগত জীবনে পুরোদস্তুর ইন্ট্রোভার্ট। তার ভাষ্যে- ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের চিন্তাধারা নিয়ে নিজের মধ্যে থাকে নতুন কিছু তৈরি করার উদ্দেশ্যে। জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে তিনি লেখেন, ১৯৯০ সালের দিকে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডন যাওয়ার পথ একা ভ্রমণ করছিলেন তিনি। ট্রেন চার ঘন্টার বিলম্ব করে। একা একা লাউঞ্জে বসে আছেন। খুব বিষণ্ণ আর একা লাগছিল। মনের মধ্যে কিছু ভাবনা জট পেকে রয়েছে। নিজের মনে ভাবতে ভাবতে একটা ছোট ছেলের চরিত্র মনে এলো।
তার হঠাৎ মনে হলো এই ভাবনাগুলো লিখে রাখা দরকার। তার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজ-কলম কিছুই ছিল না। চাইলেই যে কারও থেকে একটা কলম ধার করে নেয়া যেত। কিন্তু সেই সময় তার নিজেকে এমনি দ্বিধাগ্রস্ত লাগছিল যে শেষপর্যন্ত লজ্জায় আর চাইতেই পারলেন না। কিন্তু পরে অনুধাবন করলেন আসলে কলম না পেয়ে ভালই হয়েছে।
নিজের মনে ছেলেটার চরিত্রকে গড়ে তুললেন। নিজেকে সেই গল্পের চিত্রনাট্যে উপস্থিত করলেন। পুরো ছবিটা তার মনে গেঁথে গেল। একটা ছেলে যে জানত না সে জাদুকর, তার বেড়ে ওঠা, নানান ঘাত প্রতিঘাত পার করা, এসব নিয়ে কল্পনার রাজ্যে চলে গেলেন। এই চরিত্রটিই পরবর্তিতে ‘হ্যারি পটার’ হয়ে আমাদের কল্পনার রাজ্যে সঙ্গী হয়েছে।
শুনলে অবাক হতে হয়- কোটি কোটি সম্পত্তির মালিক ‘মাইক্রোসফট’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বিল গেটসও একজন ইন্ট্রোভার্ট। লেখক এবং ইন্ট্রোভার্ট বিশেষজ্ঞ ‘সুসান কাইন’ বিল গেটসকে ইন্ট্রোভার্ট আখ্যা দিয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিগত জীবনে সফল আরও কিছু নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যেমন- মার্কিন যুক্তরাজ্যের ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন, বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন বাফেট, ফিজিক্সের বিস্ময় আলবার্ট আইন্সটাইন, মহাত্মা গান্ধী, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সি.ই.ও মার্ক জাকারবার্গ এবং আরও অনেকে। ভাবতে অবাক লাগে এত বড় বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সকলেই আত্মকেন্দ্রিক লোকজনের উদাহরণ? সত্যি ভাবা যায় না!
আসলে ইন্ট্রোভার্ট হওয়াটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু এর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা সেকেলে। অনেক মনস্তত্ত্ববিদ ইন্ট্রোভার্ট সম্পর্কে অনেক উৎসাহমূলক কথা বলেছেন। তাদের মতে, ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তিরা অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে, তারা অনেক গভীরে চিন্তা করে, তারা চারপাশ সম্পর্কে সদা দৃষ্টিশীল, আত্মসচেতন এবং সৃজনশীল বিষয়ে অনেক বেশি মনযোগী।
ইন্ট্রোভার্ট এবং এক্সট্রোভার্ট নিয়ে দ্বন্দ্ব সর্বদা। দুটোই নদীর এপার-ওপার। আমরা অনেকেই মনে করি, যারা এক্সট্রোভার্ট বা বহির্মুখি, তারাই স্বাভাবিক। আর ইন্ট্রোভার্ট মানেই লাজুক গোছের মানুষ। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ‘ডেভিস এন্ড এলকিন্স কলেজ’-এর অধ্যাপিকা লরি হেলগায়ের মতে, “ইন্ট্রোভার্টরা কিন্তু একেবারেই লাজুক প্রকৃতির মানুষ নন। তারা পছন্দ করেন বেশিরভাগ সময়টা একা একা কাটাতে, কিন্তু লাজুক মানুষেরা একা না থাকলেও তারা লাজুক।”
ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ‘শাইনেস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বার্নার্ডো যে কার্দুসি বলেছেন, “অনেক লাজুক মানুষই সামাজিক হতে চান। কিন্তু নানা রকম দুশ্চিন্তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব তাদের এই সামাজিক হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। লাজুক হওয়ার এটাই যন্ত্রণা।”
এর থেকে বোঝা যায় লাজুক মানুষেরা ভেতরে ভেতরে অনেক মানুষের সাথে মিলে মিশে থাকতে চায়, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের অভাবে তারা এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করে। এই অস্বস্তি একবার কাটিয়ে উঠতে পারলে দিব্যি এক্সট্রোভার্টের মতো মিশে যেতে পারে যে কারও সাথে। এদেরকে শাই-এক্সট্রোভার্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অনেক খ্যাতিমান অভিনেতা, গায়ক কিংবা সাংবাদিক (যেমন জনি ডেপ, বারব্রা স্ট্রাইস্যান্ড কিংবা ক্রিস্টেন স্ট্যুয়ার্ট)-এর মাঝে এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কার্দুসির মতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা কেবলমাত্র কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই লাজুক হয়ে পড়েন। যেমন-উচ্চপদাধীকারী কিংবা অপরিচিত মহিলার সামনাসামনি হলে। এই ধরনের মানুষেরা সচরাচর এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চান।
ইন্ট্রোভার্ট বা এক্সট্রোভার্ট, এই দুটোর মধ্যে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, তা নিয়ে তর্কের সুযোগ নেই। কেননা প্রত্যেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভালো-মন্দ দুটোই আছে। ইন্ট্রোভার্ট-এক্সট্রোভার্ট সম্পূর্ণ দুটি বিপরীত চরিত্র হলেও মাঝে মাঝে অনেকের মধ্যে দুই ধরনেরই বৈশিষ্টের মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য বেশি প্রকাশ পায়, তাদেরকে সেটাই অভিহিত করা হয়। তবে দুটো দিকেরই ভাল বা খারাপ দিক রয়েছে।
ইন্ট্রোভার্ট হলেই যে তাকে এক্সট্রোভার্ট হওয়ার চেষ্টা করতে হবে তা কিন্তু নয়। ইন্ট্রোভার্ট হয়েও নিজেকে অনেকের মাঝে তুলে ধরা যায় নিজের কাজ, ক্ষমতা বা মানবীয় গুণাবলীর দ্বারা। তাই কেউ যদি নাক সিটকিয়ে আপনাকে ‘ইন্ট্রোভার্ট’ বলে আখ্যা দেয়, তাহলে মুখ কাচুমাচু করে আরও নিজের মাঝে সিটিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের সুন্দর দিকগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই হবে সেই ব্যবহারের প্রকৃত জবাব।