তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের প্রবল গতিময় সময় চলছে এখন। সবকিছুতে সবার সাথে সবসময় আপডেটেড থাকা চাই-ই চাই! একটু সময় অভ্যস্ত মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকলেই মনে হয় কী যেন এক বিচ্ছিন্নতা এসে গেল! কিন্তু তা কাছে থাকলেও কি আপনি বিচ্ছিন্ন নন কারো কাছ থেকে? নিজের কিংবা আপনার আপনজনদেরই সাথেই নয়তো সে বিচ্ছিন্নতা? দূরের কারো সাথে অকারণ সফল যোগাযোগ আপনার কাছের মানুষটির সাথেই নীরবতা এনে দিচ্ছে না তো? সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলা কিংবা নিজের একাকিত্বের সাথী করে নেয়া আপনার অতি প্রিয় মোবাইল ফোনটি কি সত্যি আপনাকে সবকিছুর সাথে যুক্ত করে চলছে? নাকি একইসাথে বিপরীতমুখী কিছুও ঘটছে? কিছু বিষয়ে গভীর বিচ্ছিন্নতা আর বিষণ্ণতা কি আপনাকে ঘিরে ধরছে না এই মোবাইল ফোনেরই বদৌলতে?
পাঠক, ভেবে দেখুন, সকালে ঘুম ভেঙে সবার আগে আপনি কী খোঁজেন? হলফ করে বলতে পারি, অধিকাংশের কাছেই জবাব মিলবে এই যে, তারা তাদের মোবাইল ফোনটি খোঁজেন। প্রতি রাতে ঘুম না ভাঙা পর্যন্তও এটাই চলে। কাজের ফাঁকে, কাজের মাঝে, আড্ডা কিংবা মিলনমেলায় একেবারে চার্জটুকু না ফুরানো পর্যন্ত কারণে-অকারণে আমাদের হাতে শোভা পায় বিভিন্ন নামি-দামী কিংবা কম দামী ব্র্যান্ডের হাতের মুঠোয় থাকা একটি মুঠোফোন! গ্যালাপের একটি পরিসংখ্যানে দেখে গিয়েছে, ৮১% ব্যবহারকারী জেগে থাকার প্রায় সবটুকু সময়ই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।
বর্তমান যুগের সবচেয়ে বর্তমান ও সাধারণ একটি আসক্তি- মোবাইল ফোন আসক্তি। আজকের তরুণ বেকার কিংবা কর্মজীবী মধ্যবয়সী, দুপুরে কাজশেষে ঘর্মাক্ত গৃহিণী, উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী সকলেই বিভিন্ন মাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন এই আসক্তিতে। নির্দিষ্ট একটি সীমার বাইরে ভালো কিছুও হয়ে ওঠে আসক্তির নামান্তর। আপনজনদের সাথে আরেকটু ঘনিষ্ঠতা, নিজের সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলোকে আরেকটু ডানা মেলতে দেয়া, চারপাশের পৃথিবীটাকে মোবাইল ফোনের স্ক্রীনের চেয়ে আরেকটু বেশি নিজের চোখে দেখার জন্য হলেও জরুরি হয়ে পড়েছে এই আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করা। The Rise of Addictive Technology and the Business of Keeping Us Hooked বইটির লেখক অ্যাডাম অল্টার আমাদের বলেছেন কীভাবে পাঁচটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা সহজ হবে বর্তমান যুগের প্রায় সকলের কাঁধে চেপে বসা মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক।
১. ‘না’ বলার উপর জোর দিন
অ্যাডাম অল্টারের মতে, “আমি আমার মোবাইল ফোনটি প্রতিদিন এক ঘন্টার বেশি ব্যবহার করি না” এমনটা না বলে বরং জোর দিয়ে বলতে শেখা উচিত, “আমি আমার মোবাইল ফোনটি প্রতিদিন এক ঘন্টার বেশি ব্যবহার করতে পারবো না”। এর পেছনে তিনি এই যুক্তি দেখান, আপনি যখন কোনোকিছু “করি না” বলেন তখন আপনি কাজটি করা না করার ভার বা সিদ্ধান্ত নিজের উপরই ছেড়ে দেন। এতে করে সেই সিদ্ধান্ত বদলের ক্ষমটাটুকুও আপনি নিজেকেই দিয়ে দেন। ফলে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটা খুবই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অপরদিকে আপনি যখন কোনোকিছু করতে গিয়ে “পারি না” বলেন, তখন এতে আপনার অক্ষমতা প্রকাশ পায়। আপনি নিজেই নিজের কাছে অপারগতা স্বীকার করেন এবং আপনার না পারাটকু হয়ে ওঠে আরো দৃঢ়। ঠিক এভাবেই আজ নিজেকে বলুন, আপনি এক ঘন্টার বেশি সময় আপনার মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করতে ‘পারবেন না’!
২. কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি করুন আপনার ফোনের সাথে
খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন না হলে মোবাইল ফোনটি একেবারে কাছে রাখার দরকার নেই। শুয়ে-বসে হাত বাড়ালেই ফোনটি পাবেন, আসক্তি দূর করতে চাইলে এমন নৈকট্য পরিহার করুন। বিছানায় শুয়ে আছেন? কিছুটা দূরে ঐ টেবিলে রাখুন ফোনটি, একেবারে বালিশের পাশেই রাখার দরকার নেই। জরুরি কল আসতে পারে? রিংটোন দিয়ে রাখুন লাউড ভলিউমে, দরকার হলে উঠে গিয়ে যাতে ধরতে পারেন। আসক্তির বস্তুটি কাছে রেখে নিজেকে বারবার দমিয়ে রাখার চাইতে বস্তুটিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখাই শ্রেয়। আর যদি ফোনটি অগত্যা কাছে রাখতেই হয়, তবে অকারণ বা কম দরকারি অ্যাপ নটিফিকেশনগুলো অফ করে রাখুন। দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় বের করে সেগুলো চেক করে নিলেই হবে, এর জন্য অতটা তৎপরতা না থাকলেও চলবে! বিনোদনমূলক বা সামাজিক মাধ্যম সংক্রান্ত যে অ্যাপগুলো ফোন হাতে থাকলেই অবিরত চেক করতে থাকেন, এমনকি দেখার তেমন কিছু না থাকলেও, সেগুলো হোমপেজ থেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রাখুন।
৩. ‘লুডিক লুপ’ থামিয়ে দিন
‘লুডিক লুপ’ কী? একই কাজ বারবার করতে থাকার ধারণাকেই গবেষকেরা নাম দিয়েছেন ‘লুডিক লুপ’। কখনো কি এমন হয়েছে যে আপনি ভেবেছেন চটজলদি ফোনটা একনজরে দেখেই রেখে দেবেন? এবং তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গিয়েছে কিন্তু আপনার সেই ‘একনজর দেখা’ শেষ হয়নি? হঠাৎ ঘুম ভাঙার মতো বলে উঠেছেন, “এতো সময় পেরিয়ে গিয়েছে!”
কেন হয় এমন? কারণ এতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে আজকের দিনে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলোর তৈরি করা লুডিক লুপ! ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি সবকিছু একবার করে একনজর দেখতে দেখতে আপনি কখন যে লুডিক লুপে পা দিয়ে দেন, তা টেরই পান না! খুব সহজেই এই লুপটি আপনার জন্য হয়ে ওঠে একটি স্বস্তিকর জায়গা এবং তারপর ফোন হাত থেকে রাখার কথা আপনি ভাবতেই পারেন না! এই স্বস্তির জায়গাটি সৃষ্টি হতে দেবেন না। কখন থামতে হবে, নিজেকে বলে নিন। এই বারবার ঘুরতে থাকার চক্রটি একটি জায়গায় ভেঙে দিন। নিজেকে জোর করুন, জোর দিয়ে থামাতে শিখুন। বেরিয়ে আসুন মোবাইল ফোন আসক্তির এই লুডিক লুপ থেকে।
৪. অভ্যাস না ভেঙে, নতুন অভ্যাস গড়ুন
প্রিয় ফোনটি দূরে থাকছে? এবার প্রিয় বইটি কাছে এনে রাখুন। হাত বাড়ালেই হয়তো ফোনটি পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বইটি তো রয়েছে! এভাবেই অভ্যাস ভাঙার চেয়ে বেশি কাজে লাগবে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা। হতেই পারে বই আপনার পছন্দের নয়। কিন্তু এমন অনেক জিনিস আছে আপনার পছন্দের, মোবাইল ফোনটি দূরে সরিয়ে এবার তাদের সঙ্গে সময় কাটান। বই, গীটার, রং-তুলি-ক্যানভাস এমন যা কিছু আপনার সৃষ্টিশীলতার পালে হাওয়া দেয়, অভ্যাস গড়ে তুলুন তাদের সঙ্গে। খারাপ কিছুকে সরিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা পূরণ করুন এবার ভালো কিছু দিয়ে।
৫. ডক্টর জেকিল, মিস্টার হাইডের জন্য প্রস্তুত থাকুন!
রবার্ট লুই স্টিভেনসনের বিখ্যাত বই ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেইস অফ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’-এর মূল দুটো চরিত্রকে এখানে স্মরণ করেছেন অ্যাডাম অল্টার। রাতের বেলা নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত রূপান্তর থেকে নিজেকে সাবধান করে দিতে দিনের বেলায়ই ডক্টর জেকিল যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন! একজন মোবাইল ফোন আসক্ত হিসেবে আপনাকেও ঠিক এরকমই কিছু একটা করতে হবে! সেটা হতে পারে আপনার নিজস্ব উপায়ে এবং একদমই নিজস্ব ভঙ্গিতে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আড্ডায় গিয়েছেন এমন সময় মোবাইল ফোনটি কিছুটা দূরেই রাখুন যাতে আপনার বারবার ফোনে হাত দেয়াটা আড্ডায় আপনার বিচ্ছিন্নতা না এনে দেয়। পড়াশোনা করতে বসার আগে আপনার ফোনটা বাড়ির কারো কাছে রেখে দিন অথবা কিছুসময়ের জন্য বন্ধ করে রেখে দিন, পড়া শেষ হলে সুইচ অন করবেন। এমন করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপায়ে নিজেকে প্রস্তুত করে রাখুন মোবাইল ফোনটি যথাসম্ভব কম সময় ব্যবহার করতে। নিজেকে এতোটুকু প্রস্তুত করে রাখুন যাতে কাজের সময়ে অকারণে মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে আপনি নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন।