ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স: মন বুঝতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা

আমরা  অনেকে প্রায়ই আফসোসের সুরে বলে থাকি “কেউ আমায় বুঝলো না”। খুব করে চাই, কেউ যদি বুঝতে পারতো আসলে কী চলছে আমাদের মনের মধ্যে! আচ্ছা একবার ভাবুন তো আমরা যদি বুঝতে পারতাম কী চলছে অন্যদের মনের মধ্যে, তাহলে কত ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতো? কত সম্পর্ক ভাঙার বদলে আরো দৃঢ় হতো?

আচ্ছা আরেকজনের কথা বাদ দেই আমরা, নিজেদের অনুভূতিগুলোই ঠিকমতো বুঝতে পারি কি? ধরুন আপনার মন খারাপ। কিন্তু আমাদের অনুভূতি কি এতই সরল যে স্রেফ মন খারাপ বা ভালো এ দুটো শব্দ  দিয়েই প্রকাশ হয়ে যায়? উত্তর হলো- না। আপনি কি ধরতে পারছেন আপনার আসলে কোন ধরণের মন খারাপ? আপনি কি হতাশ, নাকি বিষণ্ণ? নাকি কোনো অনুতাপে ভুগছেন? আমরা আমাদের অনুভূতির এ সূক্ষ্ম রূপগুলো ধরতে পারি কি?

Image Courtesy: assets.entrepreneur.com

অনুভূতির এ সূক্ষ্ম রূপগুলো নিয়েই ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর কাজ। নিজের এবং অন্যের আবেগ বুঝতে পারা, অনুভূতির সূক্ষ্মতর রূপগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারা এবং কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়া বা কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাই হলো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স।

জীবনের বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিয়ন্ত্রিত হই আবেগ দ্বারা। আবার এ আবেগের কারণেই সূত্রপাত ঘটে দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ সমস্যার। আবেগকে ঠিকমতো বুঝে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এড়ানো যায় এসব সমস্যা, অর্জন করা যায় অনেক লক্ষ্য। এ কারণেই ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর গুরুত্ব এত বেশী। এমনকি সফলতার ক্ষেত্রে ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকে (‘ই আই’ বা ‘ই কিউ’) ‘আই কিউ’ এর চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়।

Image Courtesy: mind-setdevelopments.co.uk

ড্যানিয়েল গোলম্যান তার ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর মডেলে পাঁচটি দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন:

১। আত্মসচেতনতা: নিজের অনুভূতি, দুর্বলতা, সবলতা, মূল্যবোধ ও লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ সকল কিছু মাথায় রাখাই আত্মসচেতনতা। এছাড়াও অন্যদের উপর নিজের সহজাত ও প্রতিক্রিয়াশীল অনুভূতিগুলোর (যেমন হতে পারে অতিরিক্ত বিশ্বাস প্রবণতা বা রেগে যাওয়া ইত্যাদি ) প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত।

২। আত্মনিয়ন্ত্রণ: নিজের ক্ষতিকর আবেগ বা মনোবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা বা পরিবর্তিত অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এর অন্তর্ভুক্ত।

৩। সামাজিক দক্ষতা: সম্পর্কের মাধ্যমে সহযোগী বা অধীনস্থ কর্মীদের কোনো একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা।

৪। সহমর্মিতা: কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অন্যদের অনুভূতির বিষয়ে সজাগ থাকা।

৫। প্রেরণা: কোনো কিছু অর্জনের জন্য নিজেকে তাড়িত করা।

Image Courtesy: sessioncam.com

ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্টদের কিছু বৈশিষ্ট্য

অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স এর দক্ষতাও অনুশীলনের মাধ্যমে শাণিত করা যায়। তবে এমনটাও হতে পারে যে এটি কি তা না বুঝেই সহজাত ভাবে আপনি উচ্চ ‘ই আই’ সম্পন্ন। নিচে উল্লিখিত ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিদের অভ্যাসগুলো খেয়াল করুন। আপনার অভ্যাসের সাথে কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

১। তারা অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন থাকেন

উচ্চ ‘ই কিউ’ সম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজেকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমি এমন অনুভব করছি কেন?’, ‘আমি এমনটা করলাম কেন?’ এ সকল প্রশ্নের মাধ্যমেই মূলত ‘ই আই’ এর শুরু। প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে একজন তার প্রতিক্রিয়াশীল অনুভূতিগুলোর বিষয়ে সচেতন হন এবং একে ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন।

২। তারা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে আগ্রহী হন

তারা জানেন যে তিনি নিজেকে বা নিজের কাজকে যে দৃষ্টিতে দেখেন অন্যরা সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে না। তাই তারা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেমনই হোক না কেন অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে জানতে আগ্রহী হন।

Image Courtesy: dharmaconsulting.com

৩। তারা সঠিক সময়ে বিরতি দিতে জানেন

হুট করে কোনো কথা বলতে গিয়ে বা কোনো কিছু করতে গিয়ে থেমে একটু ভেবে নেয়া, বিষয়টি সহজ মনে হলেও আসলে ততটা সহজ নয়। তবে এ একটুখানি ভেবে নেয়া আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক সমস্যা থেকে, টিকিয়ে রাখতে পারে অনেক সম্পর্ককে, এমনকি আপনি হয়ে উঠতে পারেন আগের চেয়ে ভাল কর্মীও। ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিরা সঠিক সময়ে এ বিরতিটি দিতে পারেন।

৪। তারা অন্যের অবস্থান থেকে ভাবার চেষ্টা করেন

কোনো বিষয়ে কাউকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করার পূর্বে উচ্চ ‘ই আই’ সম্পন্ন মানুষেরা ঐ ব্যক্তির অবস্থান থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। সে কেন এমনটা করল? তার এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে কী কাজ করছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে তারা সবার মধ্যে একধরণের মিলবন্ধন খুঁজে পান।

৫। ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট ব্যক্তিরা সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন

নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত কে-ইবা শুনতে চায়! তবে ‘ই আই’ সম্পন্ন ব্যক্তিরা বুঝতে পারেন সমালোচনা ঠিক ভদ্র ভাবে না আসলেও তার মধ্যেও কিছু সত্যতা লুকিয়ে থাকে। তাই তারা সমালোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়াও সমালোচনা থেকে অন্যরা কিভাবে চিন্তা করে তাও বুঝতে পারেন তারা।

৬। অন্যদের মনোভাবও গুরুত্ব পায় তাদের কাছে

কোনো একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার পর তারা নিজের অজান্তেই ঐ ব্যক্তিকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এর ফলে তাদের কথাগুলি অন্যদের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে তারা তা বুঝতে পারেন। তাই তারা কী বলছেন এর পাশাপাশি কিভাবে বলছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তাদের কাছে।

৭। তারা নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চান

নিজের ভুলগুলি স্বীকার করে আবার তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কাজটি সহজ না। কিন্তু ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট ব্যক্তিরা নিজেদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের ভুলগুলো ধরতে পারেন এবং ‘আমি দুঃখিত’ বা ‘আমি ক্ষমা প্রার্থী’ এ শব্দগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত তাই ক্ষমা প্রার্থনা করতে দ্বিধা করেন না।

৮। তারা ক্ষমা করে দেন

তারা বুঝতে পারেন যে কেউই আসলে নিখুঁত নয়। তাই ক্ষমা করতে না চাওয়া আসলে একটি ক্ষতকে নিরাময় হওয়ার সুযোগ না দেয়ার মতো। যখন দোষী ব্যক্তি তার জীবনে এগিয়ে চলছে, তখন অযথা অসন্তোষ ফুঁসে না রেখে ক্ষমা করার মাধ্যমে তারা নিজেদেরও এগিয়ে চলার সুযোগ করে দেন।

Image Courtesy: quotesnpictures.com

৯। তারা তাদের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন

প্রচলিত কথায় আছে, “একটা পাখিকে হুট করে আপনার মাথায় এসে বসার থেকে হয়তো আপনি থামাতে পারবেন না, কিন্তু আপনার মাথায় বসে বাসা বানানোর থেকে তো থামাতে পারেন!”

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট ব্যক্তিরা এটি করার চেষ্টা করেন। কোনো বাজে পরিস্থিতিতে সহজাত কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর থেকে হয়তো তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু এর পরবর্তী বিষয়গুলো তারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তারা ঠিক করেন যে তাদের চিন্তাগুলো কোনদিকে ফোকাস করবেন। তারা সবধরনের নেতিবাচক অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে নিজেকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

Image Courtesy: pbs.twimg.com

১০। তারা কাউকে বিচার করেন না

কারো সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে, পরিস্থিতি, প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিশ্লেষণ না করে কাউকে বিচার করে ফেলা বা কোনো আখ্যা দিয়ে ফেলা খুবই বাজে অভ্যাস। কিন্তু ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্টরা এ কাজটি কখনোই করেন না। তারা মানুষকে জানেন, বিশ্লেষণ করেন কিন্তু কারো উপর কোনো লেভেল এঁটে দেন না কখনোই। তারা জানেন যে, একজন মানুষের একটা খারাপ দিন এমনকি একটা খারাপ বছরও যেতে পারে।

অন্য সব দক্ষতার মতো ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকেও নৈতিক, অনৈতিক দুই ভাবেই ব্যাবহার করা যায়। এর মাধ্যমে আমরা যেমন মুক্তি পেতে পারি অনেক নেতিবাচক অনুভূতি থেকে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে করতে পারি অনেক অর্জন, তেমনি অনেকে এ দক্ষতার মাধ্যমে অন্যকে অনেক নেতিবাচক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও প্রভাবিত করতে পারে। তাই অর্জন করতে হবে এর ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধের দক্ষতাও।

This article is in Bangla. This artilcle is about emotional intelligence.

References:

1. inc.com/justin-bariso/15-signs-youre-emotionally-intelligent-without-even-realizing-it.html

2. en.wikipedia.org/wiki/Emotional_intelligence

3. www.psychologytoday.com/basics/emotional-intelligence

Featured Image: pressone.ro

Related Articles

Exit mobile version