ময়নসিংহের একটি যৌথ পরিবারকে নিয়ে একটি ফিচার করা হয়েছিলো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি’র এক পর্বে। বৃদ্ধ আব্দুর রহমান, তার পাঁচ বিবাহিত সন্তান ও তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি মিলে চল্লিশজন সদস্যের বিশাল একটি পরিবার। সবাই থাকেন একইসাথে। তাদের প্রধান আয়ের উৎস মৎস্য ব্যবসা। বয়স্ক পুরুষ সদস্যরা সকলে সেই হ্যাচারির কাজ করেন, আর নারীরা সামলান ঘরকান্নার দায়িত্ব। নিত্যদিন তিন বেলা একই হাড়িতে রান্না চড়ে তাদের, একই সাথে বসে খাওয়া দাওয়া সারেন সকলে। সবমিলিয়ে তারা বেশ সুখেই আছেন মিলেমিশে, ভালোবেসে।
এমন একটি একান্নবর্তী পরিবারকে একসাথে দেখার বিষয়টি একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে তা কষ্টও জাগায়। এই অর্ধশতক আগেও তো গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই ছিল এমন যৌথ পরিবার, আর এখন কিনা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খুঁজে ফিরতে হয় তাদের। এ ধরনের একান্নবর্তী পরিবার নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে। পরিবারের সকল সদস্য একসাথে থাকছেন, পরিবারের যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ করতে বসছেন সকলে মিলে, চাচাতো ভাই বোনেরা সবাই একসঙ্গে বেড়ে উঠছে, রাত্রে দাদির আঁচল ধরে রূপকথার গল্প শুনতে বসছে একসাথে- এমনই ছিল পরিবারগুলোর আবহ। যেন এক নিবিড় বন্ধন, আত্মার আত্মীয়তায় জড়িয়ে থাকতেন সবাই।
সময়ের আবর্তনে এসব কোনো এক উপন্যাসের দৃশ্য মনে হচ্ছে। আমাদের আজকের প্রজন্মের সৌভাগ্য হয়নি এমনভাবে বেড়ে ওঠার। আমরা একক পরিবারে বেড়ে উঠেছি। বিচ্ছেদের হার দেখে, এখন তো এই একক পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত হওয়ার সময় চলে এসেছে। এমনটি কেন হলো? অনেকেই অবশ্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের উপর দায় চাপান। কিন্তু কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি এভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে এটি মেনে নেয়া যায় না। এর পেছনে কাজ করেছে আরো বড় কোনো নিয়ামক। সেটি নিয়েই আলোচনা করব আজকের লেখায়।
পরিবারিক কাঠামোতে এই পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনকে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের পরপরই মূলত এই পরিবর্তনগুলো আসতে শুরু করে। এই যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়াও পরিবর্তন এসেছে পরিবারের কর্তৃত্বে, পরিবারে নারীর অবস্থান বদলেছে, সঙ্গী-সঙ্গিনী নির্বাচনে এসেছে সদস্যদের স্বাধীনতা, পরিবারের দায়-দায়িত্বও কমেছে অনেকটা। চলুন দেখে নেই পরিবর্তনগুলো।
আগেকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। ক্ষেতে বা খামারে পুরো পরিবার একইসাথে কাজ করে নিজেদের জীবিকার যোগান দিতো। এই ক্ষেত বা খামারের মালিকানা থাকতো পরিবারের সকলের, তাই দেখা যেত চাচাতো ভাইয়েরা একসাথে একই ক্ষেতে কাজ করছেন। পরিবারের একেকজনকে একেক কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হতো, যার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হতো তাকে তা-ই করতে হতো।
পরিবারের অন্যান্য দায়িত্বও আরো বেশি ছিল তখন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার তেমন একটা প্রচলন ছিলো না, পরিবারের হাতেই ছিল শিক্ষা ও কাজের জন্য প্রশিক্ষণের ভার। কারো অসুখ হলে সেবাদান, শিশুদের লালন পালন, বৃদ্ধদের যত্নআত্তি করা- এসব দায়িত্বই পালন করতে হতো পরিবারকে। এরপর শিল্পায়ন হলো, আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠলো বিভিন্ন ফ্যাক্টরি আর প্রতিষ্ঠান। জমির উপর নির্ভর করে সবাই একসাথে থাকার প্রয়োজনীয়তা আর রইলো না। কাজের সন্ধানে যার যেখানে সুযোগ হলো সেখানে ছুটতে লাগলো। এক্ষেত্রে বিশাল পরিবারের চেয়ে একক পরিবারেই সুবিধা বেশি।
এখন কাজ আর কারো ওপর অর্পিত হয় না, যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে আসলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা। পরিবার মুক্তি পেল শিক্ষা দান ও কাজের প্রশিক্ষণ দেয়ার ভার থেকে। খাদ্য উৎপাদনের সম্পূর্ণ ভারও পরিবারের কাঁধে আর নেই, এর জন্যে ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। অসুস্থদের সেবার জন্যে গড়ে উঠেছে প্রচুর হাসপাতাল। আমাদের সমাজে বাচ্চারা এখনো অনেকাংশে পরিবার দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছে, বৃদ্ধরা সেবা পাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে এরজন্যে আলাদা লোক নিয়োগ দেয়া, চাইল্ড কেয়ার সার্ভিস বা বৃদ্ধাশ্রমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
আগে এসব কারণে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। এখন সেই প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে। তাই পরিবার প্রথার ভাঙ্গনও ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে পরিবারগুলোর মধ্যে বন্ধন সম্পূর্ণ মুছে গেছে। পরিবারগুলো ভিন্ন হয়ে ঘর বাঁধলেও বন্ধন সম্পূর্ণ মুছে যায়নি, তবে আগের চেয়ে যে কমেছে এটি সত্যি।
পরিবারে কর্তৃত্বের পরিবর্তন এসেছে। আগেকার পরিবার প্রথায় সিদ্ধান্ত নেয়ার চূড়ান্ত ক্ষমতা ছিল বয়োবৃদ্ধদের হাতে। কাজ এবং জীবন সম্পর্কে যেকোনো পরামর্শ নেয়ার জন্য সবাই তাদের দ্বারস্থ হতো। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা উপদেশ দিতেন। কিন্তু শিল্পায়নের ফলে এ চিত্র বদলে গেছে। নতুন দুনিয়ায় পরামর্শের জন্য কেউ এখন বয়স্কদের ওপর ভরসা করতে পারেন না। নতুন প্রজন্মের চাকরির জন্য বা বাচ্চাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতাও বয়স্করা রাখেন না। এসকল কারণেই বয়স্কদের হাত থেকে সংসারের কর্তৃত্ব ফস্কে গেছে।
পরিবর্তন এনেছে বিবাহ ও যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আগেকার সময়ে বিবাহ ছিল এক ধরনের অর্থনৈতিক চুক্তির মতো। দুই পরিবার তাদের সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সন্তানদের বিবাহ ঠিক করতো। পাত্র-পাত্রীর প্রেম ভালোবাসা নয়, দুই পক্ষের সম্পদ ও মর্যাদাই সেখানে মূখ্য বিবেচ্য বিষয় হতো। তবে এ চিত্র বদলে গেছে প্রায়, বিবাহের ক্ষেত্রে এখন আর পারিবারিক পছন্দ মেনে নিতে তরুণরা আগ্রহী নয়। পরিবারের সিদ্ধান্তের চেয়েও তাদের কাছে গুরুত্ব বাড়ছে নিজেদের পছন্দ ও অনুভূতির।
এসব কারণে শিল্পায়নের ফলে মানুষের আদর্শ ও চিন্তাধারাতে পরিবর্তন এসেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে। মানুষ এখন পরিবার কাকে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে, তার চেয়ে নিজের কাকে ভালো লাগে তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। এছাড়া এখন বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী তাদের আগের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের ভিন্ন বাসস্থানে সরে যাচ্ছে, তারা নিজেদের সংসার সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে সাজাতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
এসব বিষয় থেকেও টের পাওয়া যায় মানুষের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার প্রবণতা। এছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উদ্ভবের কারণে খোলামেলা যৌনতারও পসার ঘটেছে। সমাজ বা ধার্মিক অনুশাসনের চেয়ে ব্যক্তিগত চাহিদাই গুরুত্ব পায় তরুণদের মাঝে। যা-ই হোক, এতগুলো কারণ দেখানোর পরও একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়। শিল্পায়ন তো কেবল সুযোগ করে দিল যৌথ পরিবার ভাঙ্গার, তাতেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে গেল এ আদি প্রতিষ্ঠানটি? তবে কি এর ভিতই নড়বড়ে ছিল? এ প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়।
যৌথ পরিবারে যে কেবল সুবিধাই ছিল তা নয়। একটা বিশাল পরিবারে ছেলে-মেয়েদের নিজেদের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা খুব কমই থাকতো। অধিকাংশ সময়ই দেখা যেত বয়স্কদের অযৌক্তিক মতামত চাপিয়ে দেয়া হতো তাদের ওপর। আর এতজন একসাথে থাকার ফলে ঝগড়া-বিবাদও খুব দুর্লভ কিছু ছিলো না। প্রায়ই দেখা যেত, একজন অন্যজনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও নাক গলিয়ে বসে আছে। এসব বিষয় থেকেও মানুষ মুক্তি চাইতো।
এগুলোও যৌথ-পরিবার প্রথা ভাঙ্গার একটা বড় কারণ। তাই এ পরিবর্তনের সবগুলোকেই নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করাটা অনুচিত হবে। দিন দিন মানুষের একা হয়ে যাওয়া, বন্ধন কমে আসা এগুলো নেতিবাচক সন্দেহ নেই, তবে ইতিবাচক কিছু বিষয়ও আছে। আগের মতো বস্তুগত নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় এখনকার আত্মীয়তার সম্পর্কগুলোকে অনেকটাই বিশুদ্ধ অনুভূতির সম্পর্ক বলা যায়, যেগুলো কেবলমাত্র স্বার্থের জন্য রক্ষিত নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার ফলে মানুষ নিজের মতো করে নিজের জীবনকে সাজিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ পাচ্ছে। বাড়ছে প্রত্যেকের নিজের পছন্দ, মতামত ও চাহিদার মূল্য।
বস্তুত ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক দেখে-শুনে এ পরিবর্তন আসে নি। পরিবর্তন এসেছে সমাজের অন্য পরিবর্তনগুলোর সাথে নতুন করে খাপ খাইয়ে নিতে। শিল্পায়ন, নগরায়নের সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই পরিবার বদলেছে নিজেকে। সময়ের সাথে সাথে হয়তো এ প্রতিষ্ঠানটি বদলে যাবে আরো।