একজন আদর্শ সমস্যা সমাধানকারী চিন্তাশীলতার দিক দিয়েও আদর্শ হওয়াটা জরুরি। তারা কখনো কোনো সমস্যার ব্যাপারে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয় না। সমস্যাগুলোকে তারা চ্যালেঞ্জ এবং জীবনের অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করে এবং নিরপেক্ষভাবে সমাধান করার চেষ্টা করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তারা অনুমান এবং যুক্তির সমন্বয়ের উপর নির্ভর করে। অনুমান আমাদের আবেগ এবং সহজপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে যুক্তিগুলো পুরোপুরি চেতনা, জ্ঞান এবং চিন্তাশীলতার সমন্বয়ে তৈরি হয়। সমস্যা সমাধানে অভিজ্ঞ মানুষগুলো এই দু’টির সমন্বয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট সমস্যার ব্যাপারে সর্বোচ্চ পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে এবং সবচাইতে কার্যকরী সমাধানে এসে পৌঁছায়। তারা খোলা মনের, কিন্তু যুক্তিনির্ভর।
এছাড়াও একজন আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো নিয়েই এখন আলোচনা করা হবে।
১) সমস্যা এবং সমাধানগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে
একজন আদর্শ সমস্যা সমাধানকারী হওয়ার জন্য সমস্যা এবং সমাধানের মাঝে পরিষ্কার পার্থক্য করতে পারাটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তারা ‘কোনটি সমস্যা?’ এবং ‘সমাধানের পর কী ধরনের ফলাফল আসতে পারে?’ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে। প্রথমে তারা প্রকৃত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সেই অনুযায়ী সমাধানের জন্য যা যা প্রয়োজন, সেসব কাজ করার মাধ্যমে সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়।
২) প্রতিবন্ধকতাগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকে
মাঝে মাঝেই কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে এমন একটি সমাধানের পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়, যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অর্থাৎ পদ্ধতিটি নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান করলেও নতুন কিছু সমস্যা তৈরি করবে। আর আমরা অনেক সময়ই নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানটির উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে কী কী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে, সে ব্যাপারে অসচেতন হয়ে পরি। ফলে পরবর্তীতে বেশ কঠিন মূল্য দিতে হয়।
আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা কোনো একটি সমাধানে পৌঁছানোর আগে, সমাধানের পদ্ধতিটা প্রয়োগের ফলে কী কী নতুন সমস্যা তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখে। তারা সম্ভাব্য সমস্যাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। সে অনুযায়ী নতুন করে সমাধানের পদ্ধতিটি সাজায়।
৩) সমস্যা দেখে একটি নির্দিষ্ট সমাধান প্রত্যাশা করতে পারে
একজন আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীর আরেকটি গুণ হলো, তারা আগে থেকেই একটি নির্দিষ্ট সমাধান প্রত্যাশা করতে পারে, তবে প্রত্যাশাটি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। এটিকে অনুমান নির্ভর প্রত্যাশা মনে হলেও, আদতে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পাওয়া অভিজ্ঞতা দ্বারা সমস্যার ধরণ বুঝে পরিস্থিতি বিবেচনা করার ফল।
৪) কখনো অন্যের জন্য সমস্যা তৈরি করে না
তারা ন্যায্য সমাধান তৈরির ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের সমাধানের পদ্ধতিগুলো আরেকজনের সমস্যা তৈরি করে না। তারা বেশ ভালো করেই জানে, সাময়িকভাবে এই সমাধানগুলো কাজ করলেও, একটি নির্দিষ্ট সময় পর বেশ নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তাই তারা সমস্যাগুলোর জন্য এমন সব সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, যেগুলো অন্য কারোর সমস্যা হিসেবে প্রতীয়মান হবে না।
৫) একাধিক সমাধান পদ্ধতি প্রয়োগে আগ্রহী
একটি সমস্যা সমাধানের জন্য আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা কয়েক ধরনের সমাধান পদ্ধতি চিন্তা করে। একটি পদ্ধতি কাজ না করলে আরেকটির মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করে। এছাড়াও, সাময়িকভাবে প্রথম পদ্ধতিটি কাজ করলেও, পরবর্তীতে তার চাইতে ভালো এবং বেশি কার্যকর সমাধানের জন্য অন্যান্য পদ্ধতিগুলোকে কাজে লাগায়। তারা জানে, সমাধানের সবচাইতে উত্তম পদ্ধতিটিই মানুষকে আরো কার্যক্ষম করার পাশাপাশি পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে।
৬) পর্যাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে তারা সহজ সমাধান পদ্ধতি বের করে
কোনো একটি প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের যেমন পর্যাপ্ত প্রোগ্রামিং জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তেমনি অন্যান্য যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যাটি যে ক্ষেত্রেরই হয়ে থাকুক না কেন, সেক্ষেত্রে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা বাধ্যতামূলক।
আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা তাদের ক্ষেত্রগুলোতে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে। জটিল বিষয়গুলো সহজ করে বুঝে প্রয়োগ করার সক্ষমতা তাদের থাকে। একটি জিনিসের পিছনে কী কী বিজ্ঞান কাজ করে, গণিতের কোন সূত্রটি প্রয়োগ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা ওয়াকিবহাল। অর্থাৎ তারা নিজের ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত প্রায় সব রকমের জ্ঞান রাখে। আর জ্ঞানগুলোকে কাজে লাগিয়ে সবচাইতে সহজ সমাধান পদ্ধতিগুলোর উদ্ভব করে। পদ্ধতিগুলো সরলীকরণের মাধ্যমে উপস্থাপনের ফলে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ পড়ে যায় এবং সাধারণের জন্য আরো বেশি সহজবোধ্য হয়। আর এখানেই তাদের সফলতা।
৭) তারা নিজেদের অজ্ঞতাকে মেনে নেয়
আমাদের মাঝে অনেকেই আছে, যারা নিজেদের জ্ঞান দিয়েই সব ধরণের সমস্যা সমাধান করতে চায়। তারা নিজেদের অজ্ঞতা স্বীকার করতে চায় না। নিজেদের থাকা জ্ঞানের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে কোনো সমাধানে না আসতে পারলেও, অভিজ্ঞ হিসেবে যে খ্যাতি জন্মেছে, সেই খ্যাতি রক্ষার জন্য দক্ষ কারো কাছে সমাধানের জন্য যায়। ফলে তাদের তৈরি সমাধানে বেশ বড় রকমের দুর্বলতা থেকে যায়, পরবর্তীতে যেগুলো দীর্ঘমেয়াদী খারাপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা এর পুরো উল্টো। তারা নিজেদের অজ্ঞতাগুলো স্বীকার করে নিয়ে দক্ষ কারো কাছ থেকে সাহায্য নেয়। সমাধানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে বেশ ভালোভাবে কোনো সমস্যা সমাধানের পরেও আরো ভালো কিছুর প্রত্যাশায় অভিজ্ঞদের পরামর্শ চায়।
৮) তারা বেশ খোলা মনের হয়ে থাকে
আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা নিজেদের সমাধান পদ্ধতিগুলো নিয়ে অন্যদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে পছন্দ করে। অভিজ্ঞদের সাথে আলোচনা মাধ্যমে নিজেদের আরো বেশি সমৃদ্ধ করে তোলে। নিজস্ব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নতুনদের পরামর্শ দিয়ে থাকে। এছাড়াও, একই সমস্যা নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার ব্যাপারে তারা আগ্রহী।
৯) তারা সবচাইতে সমৃদ্ধ সমাধানগুলো প্রয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী
কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য যদি নিজেদের করা সমাধান পদ্ধতির চাইতে আরো ভালো কোনো সমাধান পদ্ধতি থাকে, তাহলে তারা সেটাই বেছে নেয়। এমনকি ঐ সমাধানকারীকে পুরো কৃতিত্ব দিতেও কার্পণ্য করে না।
১০) সবসময় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে
কোনো সমাধান মন্তব্য, ভোট, কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদন করা হলেই সেটি আদর্শ সমাধান নয়। আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা সবসময় নিরলসভাবে তাদের করা সমাধান পদ্ধতিগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে যায়। সমাধান পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হওয়া তথ্য-উপাত্তগুলোকে বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ‘বাস্তব জীবনের সেটি কার্যকর হচ্ছে কিনা’ নিশ্চিত হওয়ার পর সেটিকে আদর্শ সমাধান হিসেবে প্রকাশ করে।
১১) সর্বোপরি, তারা হতাশ হয় না
আদর্শ সমস্যা সমাধানকারীরা বেশ ভালো করেই জানে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাদের সমাধানগুলো কাজে আসবে না অথবা সাময়িকভাবে কাজে আসলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা হারাবে। তাই তারা এ ধরনের পরিস্থিতির স্বীকার হলে কখনো হতাশ হয় না। বরং আগের সমাধান পদ্ধতিটি তৈরি করার সময় যে ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে নতুন তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তির সমন্বয়ে উন্নতি সাধন করার চেষ্টা করে।