পড়াশোনা বা কর্মজীবন, যে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন একটানা অনেকদিন পড়াশোনা বা কাজকর্মের পর অবসাদ পেয়ে বসে আমাদের প্রত্যেককেই। এই অবসাদকে দূর করে আবারো চাঙ্গা হতে যে জিনিসটা সবচেয়ে কাজে দেয়, তা হলো ভ্রমণ। একটানা দীর্ঘদিন কাজকর্মের ফলে দেহ মনে যে আড়ষ্টভাব চলে আসে, তা দূর করতে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন বেরিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প এখনো পাওয়া যায় না।
ভ্রমণ যে শুধু মনকে চাঙ্গা ভাব এনে দেয়, তা-ই নয়। শরীরের উপরও এর রয়েছে অনেক প্রভাব। তাই একটা সময় ছিলো যখন স্বয়ং ডাক্তাররাও রোগ মুক্তির জন্যে কিছুদিনের জন্যে এদিক সেদিকে বেড়িয়ে আসতে বা ‘বায়ু বদল’ করে আসতে বলতেন। তাই একইসাথে দেহ-মন দুটোর উপরই ভ্রমণের রয়েছে চমৎকার প্রভাব।
কিন্তু ভ্রমণও যে পুরোপুরি ঝক্কিবিহীন একটা ব্যাপার, তা নয়। ভ্রমণ আয়োজনের মধ্যেও রয়েছে হাজারটা আয়োজনের ব্যাপার। ফলে দেখা যায় যায় যে প্রায় সময়ই ভ্রমণ করতে গিয়ে হাজারটা ঝামেলায় অবসাদ দূর হওয়ার চেয়ে উল্টো আরো অবসাদ পেয়ে বসতে পারে। তাই ঠিকভাবে না এগোলে বা প্রস্তুতি না নিলে অবকাশ যাপনটাই পণ্ড হয়ে যেতে পারে।
ভালোভাবে অবকাশ যাপন বা ছুটি কাটানোর জন্যে প্রথমেই মনে হতে পারে সঠিক পরিকল্পনাই একমাত্র রাস্তা, এটা ঠিক যে পরিকল্পনা করেই এগোতে হবে। কিন্তু এখানে শুধু পরিকল্পনাই একমাত্র ব্যাপার নয়। আরো দশটা ব্যাপারেও নজর রাখা প্রয়োজন, এও মাথায় রাখতে হবে যে সবসময় সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবে না। ফলে যা ভাবলেন বা পরিকল্পনা করলেন, সেভাবে সব কিছু ঘটবে নাও পারে, সেটাও মেনে নেওয়া জরুরি।
একটা দুর্দান্ত ছুটি কাটানোর জন্যে বেশ কিছু টিপস আপনার জন্যে দরকারি হতে পারে। নিচে একটা ভাল ভ্রমণের আগে ও পরে কি কি করণীয় তার কিছু পরামর্শ দেয়া হলো। অবশ্যই সবক’টাই যে সবার জন্যে প্রযোজ্য হবে তাও নয়, এবং এগুলোর কোনোটাই মূলত সেই অর্থে নতুন কিছুও নয়। কিন্তু টিপস আকারে একসাথে এগুলো মগজে গেঁথে নিলে, সেটা আপনার ভ্রমণে বেশ কাজেই আসবে।
পরিকল্পনাই সব কিছু নয়
শুরুর টিপসটাই একটু বেতোয়াক্কা ধরনের বলে মনে হতে পারে, এ আবার কেমন কথা! পরিকল্পনা করব না? ভুল বুঝবেন না পাঠক, পরিকল্পনা তো অবশ্যই করতে হবে। আর দশটা যেকোনো কাজের ন্যায় ভ্রমণের আগেও চাই সঠিক ও বিস্তারিত পরিকল্পনা। যে কারণে বিশ্ববিখ্যাত সমরবিদ সান জু বলেছিলেন “পরিকল্পনা ঠিক থাকলে আগেই যুদ্ধের অর্ধেক বিজয় হয়ে যায়”। তাই ভ্রমণে কী করবেন না করবেন, তা বিস্তারিত অবশ্যই পরিকল্পনা করে নিন।
যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- এমন অনেক কিছুই ঘটবে যা আপনার পরিকল্পনায় ছিলো না। এমন অনেক সমস্যা এসে হাজির হবে, যার প্রস্তুতি আপনার ছিলো না। এবং এটা মেনে নেয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। এরকম অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যেও মানসিকভাবে প্রস্তুতি রাখুন।
বিস্তারিত ঘাঁটাঘাঁটি করুন
যে দেশে বা যেখানে যাচ্ছেন, সে জায়গাটা সম্পর্কে ইন্টারনেট হোক বা বইপত্র হোক কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে বিস্তারিত জেনে নিন। সেখানকার আবহাওয়া, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা, রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ঠিকানা।
এগুলো ছাড়াও কোথায় কোথায় ঘুরবেন, সেগুলোর কিছুটা ইতিহাস ও মজার ফ্যাক্টগুলো জেনে নিন। তা নাহলে গোয়েন্দা ফেলুদার ভাষায় “সে জায়গায় ঘুরে এসেও জায়গাটা অচেনাই থেকে যাবে”। তাই ফেলুদার সবক’টা উপন্যাসে দেখা যায়, ফেলু মিত্তির যে জায়গাতেই যান, তার আগে বিস্তারিত পড়াশোনা করে নেন।
ব্যাগ গোছানোর আগে তালিকা করে নিন
ভ্রমণে যাওয়ার জন্যে ব্যাগ গোছানোর আগে কী কী দরকার বা কী কী নিয়ে যাবেন, তার একটা তালিকা করে নিন। এতে দুটো সুবিধা হবে।প্রথমত, ভ্রমণে কোন কোন জিনিস দরকার হবে, তা ঠিকঠাক নির্ধারণ করা যাবে, কিছু নেয়া বাদ থাকবে না। ফলে পৌঁছে হোটেলে ওঠার পরে “এই রে! তোয়ালেটা আনতে ভুলে গেছি” জাতীয় সমস্যা হবে না।
একইভাবে ফিরে আসার সময় এই তালিকাটাকে ‘চেকলিস্ট’ এর মতো ব্যবহার করে মালপত্র মিলিয়ে ব্যাগ গোছাতে আপনার সুবিধা হবে। ফলে “এই রে! তোয়ালেটা হোটেলে ফেলে এসেছি” এর মতো ব্যাপারটাও ঘটবে না।
ব্যাগ হালকা রাখার চেষ্টা করুন
ভ্রমণে আপনার মূল ফোকাস থাকা উচিত ভালো সময় কাটানোর দিকেই। ফলে সকালে এক পোশাক, বিকেলে আরেক পোশাক এই করতে গিয়ে আপনার লাগেজ হয়ে যেতে পারে ব্যাপক ভারি। পেশাদার ভ্রমণকারী বা পরিব্রাজকদের মতে লাগেজ অবশ্যই হালকা হতে হবে। নতুবা একটা ভারি ব্যাগই আপনার ভ্রমণের বারোটা বাজানোর জন্যে যথেষ্ট হতে পারে।
ইন্টারনেটে ভ্রমণের জন্যে কীভাবে লাগেজকে হালকা রাখা যায়, তার অনেক টিপস খুঁজে পাবেন, সেগুলো আমলে নিন। একটা সহজে বহনযোগ্য ব্যাগে শুধুমাত্র দরকারি জিনিসপত্রই নেবার চেষ্টা করুন।
আগেভাগে রওনা দিন
আপনার ট্রেন দশটায়, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় পাঁচ মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছে তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে টিকিট কেটে ট্রেন অবধি পৌঁছালেও বগি সিট খুঁজে পেতে গিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়ার উপক্রম, এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক যে আমাদের অনেকের সাথে ঘটে।
ভ্রমণের শুরুতেই এ জাতীয় ঝক্কি আপনার পুরো যাত্রার আনন্দই মাটি করে দিতে পারে। তাই কষ্ট হলেও পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে বাস, ট্রেন বা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন। প্রায় সময় আমরা ভোরে ঘুম থেকে ওঠার ভয়ে বা আগেভাগে গিয়ে বসে বসে সময় কাটানোর ভয়ে দেরিতে রওনা দিই। এ অভ্যাস ত্যাগ করে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে আগে স্টেশন বা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন। সাথে পরিবার বা বাচ্চাকাচ্চা থাকলে স্টেশন বা এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা যদি আগে থেকে করে রাখতে পারেন (যেমন কোন বন্ধুর গাড়ি বা আগে থেকে ভাড়া করে রাখা কোনো বাহন), সেক্ষেত্রে আপনার অনেক সুবিধা হবে।
কিছু জিনিস অবশ্যই সাথে নিন
হয়তো বা পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে যাচ্ছেন না, যাচ্ছেন সমুদ্র সৈকতে। কিন্তু এরকম জায়গাতেও আপাতদৃষ্টিতে দরকারি নয় এমন জিনিসও প্রয়োজন হতে পারে। যেমন পলিব্যাগ। চেষ্টা করুন ‘জিপ লক’ জাতীয় কোনো পলিব্যাগ সাথে রাখার। পানিতে নামলে বা বৃষ্টিতে মোবাইল, টাকা-পয়সা ইত্যাদি রাখতে সুবিধা হবে। সাথে ছোট একটা টর্চলাইট রাখুন। চাদর জাতীয় কিছু একটা নিন, সেটা যে ঋতুই হোক। বাস ট্রেনের জানালার ছোট ছিদ্র দিয়ে আসা তীব্র গতির বাতাস গরমকালেও আপনার শীত ধরিয়ে দিতে পারে।
টাকা পয়সা ও কাগজপত্রের ক্ষেত্রে সতর্কতা
আপনার পাসপোর্ট, ভিসা, পরিচয়পত্র, দরকারি কাগজপত্র ইত্যাদির একটা স্ক্যান করা ডিজিটাল কপি সাথে রাখুন। যাতে হারিয়ে গেলেও আপনি এসব ডিজিটাল কপির সাহায্যে অন্তত পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন। নিজের ম্যানিব্যাগ, মোবাইল, ব্যাগ ইত্যাদি সব সময় দৃষ্টিসীমার ভেতরে রাখুন। সবসময়ই নিরাপত্তা আগে, যদি নিরাপদ বোধই না হয় তাহলে শান্তিতে ঘুরতে পারবেন না।
কাস্টমস কর্মকর্তাদেরকে সহযোগিতা করুন
বিমান বন্দরে সবার কাছেই একটা বিরক্তির নাম কাস্টমস বিভাগের চেকিং। অনেকেই যে ভুলটা করেন, তা হলো চেকিংয়ের সময় অসহযোগিতা করা বা এড়ানোর চেষ্টা করা। মজার বিষয় হলো অযথা তর্ক করতে গিয়ে যে সময়টা নষ্ট হয়, সেটা না করে বরং চেকিংয়ে সহযোগিতামূলক আচরণ করলে আরো দ্রুত হয়তো আপনার চেকিং শেষ হতো। তাই এড়ানোর চেষ্টা না করে সহায়তা করুন।
এরকম ছোট ছোট কিছু ব্যাপার মাথায় নিয়ে চললে আপনার ভ্রমণ হবে অনেক ঝামেলামুক্ত আর আনন্দদায়ক। তাই ঝামেলা ও দুশ্চিন্তাবিহীন ভ্রমণ করতে এগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে আপনি নিজেও আরো কিছু টিপস যোগ করতে পারেন। আপনার যাত্রা ও ভ্রমণ, দুটোই স্বাচ্ছন্দ্যময় হোক।
ফিচার ছবি- rs-insurance