‘ডেডলাইন’ অথবা ’সময়সীমা’ এই শব্দটি আমাদের নিত্যদিনের জীবনে অতি পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাসাইনমেন্ট, গবেষণার অগ্রগতি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প প্রস্তাবনা ইত্যাদি প্রায় সকল কাজেরই একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আর প্রকল্পটি যদি হয় দেশীয় কোনো উন্নয়নমূলক কাজ, তবে সময়কে সীমায় বেঁধে দেওয়া একেবারেই মানায় না।
প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা অতিক্রম করাই ব্যক্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রেওয়াজ হয়ে গেছে কিংবা নিদেনপক্ষে শেষ সময় ছুঁই ছুঁই করা অবস্থায় গিয়ে কাজটি হয়তো শেষ হয়। বিষয়টি কেন হয়? কেন বিপরীত ঘটনাটি আমাদের অভিজ্ঞতার খাতায় প্রায় জমা হয় না বললেই চলে? নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই কেন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না?
ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা সিরিল নর্থকোট পারকিনসনের একটি বিখ্যাত উক্তি, যা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে পারকিনসন’স ল নামেই সুপ্রতিষ্ঠিত।
Work expands so as to fill the time available for its completion.
কোনো কাজ তার জন্য বরাদ্দ সময়ের সবটুকু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তার ব্যাপ্তিকে বাড়িয়েই চলে।
পারকিনসনের একটি কাজ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। তার মূল প্রবন্ধটি ছিল ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে। ১৯১৪ থেকে ১৯২৮ সালের মাঝে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে মোট জাহাজ সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়, কর্মকর্তাদের সংখ্যা কমে যায় এক-তৃতীয়াংশ, অথচ নিযুক্ত আমলাদের সংখ্যা এক বছরেই বেড়ে যায় ৬%। কর্মকর্তা ও জাহাজ সংখ্যা উভয়েই কমে যাওয়ার পরও শুধু ব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে আমলাদের উপস্থিতির হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কম কাজের কারণে স্বাভাবিকভাবেই কম জনবলই যথেষ্ট কিন্তু ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ দেখে মনে হচ্ছিল, এ যেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনার সায়েন্স অভ কমপ্লেক্স সিস্টেমসের অধ্যাপক স্টেফান থার্নার পারকিনসনের সূত্রের উপর আরও বিস্তারিত কাজ করেন। তার মূল কাজের অনুপ্রেরণা ছিল স্বীয় কর্মস্থল মেডিসিন বিভাগ যখন ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা থেকে পৃথক হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত। ২০০৪ সালে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনার যাত্রা শুরু হওয়ার ৪ বছরের মাথায় এর কর্মীসংখ্যা মাত্র ১৫ থেকে ১০০ তে উন্নীত হয়, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিজ্ঞানীর সংখ্যা অপরিবর্তিত ছিল। থার্নারের ভাষ্য ছিল,
আমি কিছুতেই অনুধাবন করতে পারছিলাম না যে, মূলত কী হচ্ছে এখানে? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমার বদলে বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
থার্নার এরপর পারকিনসনের পুরো বইটা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হয়ে তার উপর ভিত্তি করে একটি গাণিতিক রূপরেখা তৈরি করলেন। এই বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল,
কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক অঙ্গের কলেবর যদি ৬% বৃদ্ধি পায়, তবে আজ হোক বা কাল সে প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস অনিবার্য। সম্পর্কিত সকল ব্যক্তি শুধু আমলাতান্ত্রিকতার দিকেই ঝুঁকবে, কিন্তু উৎপাদন নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা থাকবে না।
এবারে থার্নারের একটি নিজস্ব গবেষণার দিকে নজর দেওয়া যাক। দেশের শাসন ব্যবস্থার ভার যার ওপর ন্যস্ত থাকে, সে সরকারকে নিয়ে থার্নার গবেষণা করেছেন। সরকারকে যদি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করি, তবে এর সদস্য সংখ্যা ঠিক কত হলে তাকে আদর্শ সরকার বলা যাবে? সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মন্ত্রিপরিষদ। থার্নার এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহের মন্ত্রিপরিষদের আকার পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মন্ত্রিপরিষদের আকার মূলত একটি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য, জনগণের উন্নয়নের সূচক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহি, সরকারের কার্যকারিতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদের আকার যত বড় হবে, সরকারের উৎপাদনশীলতা তত হ্রাস পাবে।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের আরম্ভটা হয় খুব ছোট পরিসর থেকে। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, শাখা, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কর্মসংস্থানের সুযোগ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই একটি হায়ারার্কি (প্রাধান্যপরম্পরা) থাকে। অর্থাৎ সভাপতি, একাধিক সহসভাপতি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সহ-উপ-যুগ্ম পরিচালক ইত্যাদি নানা পদবীতে বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ স্থান দখল করে থাকেন। চমকপ্রদ বিষয় হলো, কমবেশি প্রত্যেকেরই আবার নিজেদের ব্যক্তিগত সহকারী থাকেন। এর ফলে কী হচ্ছে? অধস্তন কেউই ‘উপরওয়ালা’র সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পান না।
এই যে বিশাল এক শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি ব্যবস্থা, বাস্তবিক পক্ষে উৎপাদনশীলতার সাথে এর কোনো যোগাযোগ নেই। আর ঠিক এজন্যই বলা হয়, আমলাদের কাজ কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বৃদ্ধি করে যাওয়া। উঁচু পদে আসীন ব্যক্তিবর্গ শুধু কাজ সৃষ্টি বা নানা কিসিমের দায়িত্ব অর্পণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেন, কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে তাদের সেই অর্থে খুব একটা আগ্রহ থাকে না।
এবারে চলুন, পারকিনসনের সূত্রের সম্প্রসারণ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসের দুজন অধ্যাপকের একটি গবেষণাপত্র, জার্নাল অভ এক্সপেরিমেন্টাল সোশ্যাল সাইকোলজি জার্নালে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। তারা পারকিনসনের সূত্রের পরিধি নির্ণয় করার জন্য একটি ভিন্নতর পরীক্ষার নকশা করেন। পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে একটি নির্দিষ্ট কাজ করতে দেওয়া হয় তবে কাউকে ৫ মিনিট আর কাউকে ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। একই কাজ, কিন্তু সময়ের পার্থক্য। পারকিনসনের সূত্র দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয়। এবার দ্বিতীয় দফায় আবার পরীক্ষা চালানো হলো।
এবারে কেউ পেয়েছিলেন আগেরবারের মতোই একই কাজ আর কেউ পেয়েছিলেন প্রথমবারের চেয়ে ভিন্ন কোনো কাজ। প্রথম দফায় যাদের জন্য অধিক সময় বরাদ্দ ছিল (১৫ মিনিট), তারা এবারও প্রদত্ত কাজটি শেষ করতে বেশি সময় নিয়েছিলেন। অন্যদিকে যারা প্রথমবার কম সময় (৫ মিনিট) পেয়েছিলেন তারা অধিক সময় প্রাপ্তদের চেয়ে কম সময়েই কাজ সম্পন্ন করেছেন। অর্থাৎ, দ্বিতীয়বারেও পারকিনসনের সূত্র সঠিক প্রমাণিত হলো। এই পরীক্ষা থেকে ইলিয়ট ও ডেভিড প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, কাজের ভিন্নতা থাকলেও পারকিনসনের সূত্র এর পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েই চলে।
সবশেষে, অত্যন্ত চমকপ্রদ ও চিন্তার উদ্রেককারী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমরা প্রায়ই পারফর্ম্যান্স ও প্রোডাক্টিভিটি শব্দ দু’টি ব্যবহার করে থাকি। সাধারণ আড্ডায় বা কথাবার্তায় এই দুইটি শব্দের অর্থগত পার্থক্য নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়া নিয়ে যদি গবেষণা করতে হয়, তবে এই দুইটি শাব্দিক অর্থ নিয়ে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল হতে হয় বৈকি! ডন ও এলিজাবেথের এই গবেষণায় সময়ের চাপ, কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল দলীয় কাজে সময়ের চাপ বা ডেডলাইনের সত্যিই কোনো অত্যানুকূল মাত্রা আছে কি না?
তাত্ত্বিক দিক থেকে গবেষকদ্বয়ের অবস্থান ছিল কর্মক্ষমতা বা পারফর্ম্যান্স এবং উৎপাদনশীলতা বা প্রোডাক্টিভিটি; এই দু’টি বিষয়কে সম্পূর্ণ আলাদা চোখে দেখা যায় কি না? এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে অফিস মিটিং এর আদর্শ ব্যাপ্তি ও যেকোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য অত্যানুকূল সময়সীমা নির্ধারণ করা। গবেষণা শেষে দেখা যায়, কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলে প্রোডাক্টিভিটি বেড়ে গেলেও পারফর্ম্যান্স কমে যায়। কারণ, সময়ের চাপ মানুষের জ্ঞানীয় দক্ষতা, সৃজনশীলতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে বেশি সময় বরাদ্দ করা হলে, তাতে করে পারফর্ম্যান্স, প্রোডাক্টিভিটিকে সফলতার দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারে না।
অর্থাৎ, ব্যক্তিক অথবা দলীয় যেকোনো কাজেই সময়ের ব্যাপ্তিটা এমন হওয়া আবশ্যক, যাতে করে পারফর্ম্যান্স ও প্রোডাক্টিভিটির মাঝে সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা বিরাজ করে।